কাছ থেকে দেখা ওবায়দুল কাদের > যে কারিশমায় সাধারণ সম্পাদক হলেন
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৭:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ নভেম্বর ২০১৬
- / ১৮৪৪ বার পঠিত
সালেম সুলেরী: অবশেষে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছলেন রাজনীতিক ওবায়দুল কাদের। প্রিয়দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন। ২০১৬-এর ২৩ অক্টোবরের জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে। এতে ৮ম বারের মতো সভাপতি হলেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। আর প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক পদে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। বিশেষ করে, নতুন পদায়নের পরপরই সভাপতির পা ছুঁয়ে কদমবুচি করায়। সমালোচকেরা বলছেন, অধিক আনুগত্যেরই পুরষ্কার এটি।
অন্যদিকে তৃণমূল কর্মী-নেতাদের অধিকাংশের অন্য অভিমত। তাদের মতে নীতি-নির্ধারকেরা যথাযথ কাজটিই করেছে। তৃণমূলের অতীব নিকট এক কেন্দ্রীয় নেতার প্রতি সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। হাটে-মাঠে-ঘাটে-গ্রামে-গঞ্জে-সবটা ছু’য়ে থাকেন তিনি। সম্মেলনের অধিকাংশ কউিন্সিলর ‘মন্ত্রী-বাহাদুর’-কে নিজ-নিজ এলাকাতেই পেয়েছে। অতএব পছন্দের তালিকায় পয়লা নম্বর নাম- ওবায়দুল কাদের।
কিন্তু কিভাবে এতো তৃণমূলে পৌঁছালেন তিনি। ২০০৯-এর জাতীয় কাউন্সিলে হয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য। উচ্চ পর্যায়ের ব্যাপার-স্যাপার। নিচের সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি ছিলেন না। মাঠ পর্যায়ে ছিলো না কাজের তাড়া। কিন্তু জনপ্রিয়তায় পয়লা নম্বর হলেন কী করে।
এই ‘পয়লা নম্বর’ হওয়ার নেপথ্য গল্পটি আমার জানা। প্রক্রিয়াটির কী করে সূচনা হলো- তার নীরব স্বাক্ষীও আমি। যদিও, কাদের ভাই-এর সঙ্গে জানা শোনা সেই ১৯৮২-৮৩ থেকে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই মেয়াদের সভাপতি ছিলেন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকালে প্রথমত রাজনীতি ছিলো নিষিদ্ধ। কাদের ভাই নাম লেখালেন সাংবাদিকতার খাতায়। সহকারী সম্পাদক হলেন দৈনিক বাংলার বাণী’র । বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি আর সাহিত্যÑ চমৎকার ফুটতো ঋদ্ধ কলমে। ঐ সময়ে বাংলার বাণী’তে আমিও নিয়মিত লেখক। কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ এমনকি ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখেছি।
আশির দশকের উপান্তে প্রতিষ্ঠিত হলো সন্দ্বীপ ভবন। মতিঝিলের উপকণ্ঠে আরেক মিডিয়া হাউজ। অভিনয় কুমার দাশ…, এম আখতার মকুল, বেলাল চৌধুরীর পর আমি। নির্বাহী সম্পাদক হলাম সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ-এর। প্রচারণায় শীর্ষ স্থান অর্জন করেছিলাম আমরা। হাউজের প্রতিষ্ঠাতা বা মালিক ছিলেন প্রয়াত ‘দ্বীপবন্ধু’ মুস্তাফিজুর রহমান। বিসিআই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার। পরবর্তীতে সন্দ্বীপ থেকে দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। প্রতীক নৌকা, দল আওয়ামী লীগ।
ওবায়দুল কাদেরও আপাদমস্তক আওয়ামী লীগ করে এসেছেন। জন্ম ভাষা আন্দোলনের মাস, ১৯৫২ তে। সার্টিফিকেট অনুসারে জন্ম তারিখ পয়লা জানুয়ারি। পৈতৃকবাস নোয়াখালি জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার রাজাপুর গ্রামে। পিতা মোশাররফ হোসেন ছিলেন হাইস্কুল শিক্ষক। ওবায়দুল কাদেরও শিক্ষানুরাগী। পড়ুয়া। ঢাকার বইপাড়ার পরিচিত মুখ। ভাষা আন্দোলনের তিথিতে জন্ম। আর স্বাধীনতা আন্দোলনে বিকশিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯ বছর বয়েসেই নিয়েছেন বারুদ মাখানো অগ্নিস্মৃতি।
ছাত্রজীবনেও পশ্চাদপদ ছিলেন না। এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নপর্ব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ ডিগ্রী অর্জন। একাত্তরে থানা মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক হয়েছিলেন। বিএলএফ তালিকায় মুক্তোর অক্ষরে লেখা নাম। মুজিব বাহিনী মানে ছাত্রলীগের পরীক্ষিত নেতা/কর্মী। রাজনীতিতে আজীবন পরীক্ষা দিতে হয়েছে কৌশলী ওবায়দুল কাদেরকে।
পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নামে অমানিষা। প্রায় আড়াই বছর কারার অন্তরালে মার্জিত আসামী ছিলেন। জেলজীবন আবার ফিরে পান ২০০৭-এর ৯ মার্চ। জরুরী বিধিতে গ্রেফতার করে ‘ওয়ান ইলেভেন’-এর সরকার। ১৭ মাস ২৬ দিন সহ্য করেছেন নির্মম পরিহাস। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিতে হয়েছে জবানবন্দি। যুবলীগের কেউ কেউ বাসে আগুন দিতো, বলে ফেলেছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পান।
ওবায়দুল কাদের প্রথম এমপি হলেন ১৯৯৬-এর ১২ জুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে। এলাকা নোয়াখালি-৫। পরাভূত করেছিলেন বিনএপির অন্যতম শীর্ষ নেতা ব্যরিস্টার মওদুদকে । সেবার, প্রথমবারের মতো তিনটি পদবীতে শপথ নেন। প্রথমত সংসদ সদস্য। দ্বিতীয়ত প্রতিমন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। কর্মকাল শুরু ২৩ জুন, ১৯৯৬। সমাপণ ২০০১-এর জুলাই। পাঁচ বছরের মেয়াদ পরিপূর্ণ করতে পেরেছিলেন।
২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও তিনি সগর্ব এমপি। পদ বহাল থাকে ২০১৪-এর বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও। চলমান মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হন ২০১১-এর ২৮ নভেম্বর। জনপথ ও সেতু মন্ত্রী তিনি। ২০১২ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বও পেয়েছিলেন। ঘুষ দুর্নীতির কেলেংকারিতে রেল মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়েছিলো সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে। তৎকালে অবিবাহিত মুজিবুল হক পরে সেই পদে আসীন হন।
মাঝে পাঁচ মাস রেল মন্ত্রণালয় ছিলো অতিথি মন্ত্রীর হাতে। অর্থাৎ জনপথ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পরিচালনায়। ঐ-সময়ে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। যোগাযোগ করলাম কাদের ভাই-এর সঙ্গে। সুতরাং পত্রিকার সম্পাদক আকাশ মাহমুদ ফোনে সংযোগ ঘটিয়ে দিলো।
দীর্ঘদিন পর কথা। শেষ দেখা হয়েছিলো ২০০০ সালের দিকে। তখনও দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী। সাক্ষাতের জন্যে সময় দিয়েছিলেন পল্টনস্থ ক্রীড়া পরিষদ ভবনে। সন্ধ্যেবেলা গিয়ে দেখি বিশাল ভিড়। কিন্তু সাক্ষাতে অসুবিধে হলো না। এপিএস জাতীয় একজন তরুণ বললেন, স্যার অপেক্ষায় আছেন। চলেন দ্বিতীয় তলায়।
কাছের মানুষকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় দেখতে ভালোই লাগে। সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে স্মৃতিকেও ভাঙ্গাই। আশির দশকে গণমাধ্যমে একই ছাদের নিচে কতো স্মৃতিগদ্য। আমাদের সন্দ্বীপ ভবনের ‘স্বদেশ খবর’ ম্যাগাজিনে কলাম লিখতেন। তখন ই-মেইল সংস্কৃতি মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। হাতে লেখা সরল গদ্য নিয়ে নিজেই হাজির হতেন। সাপ্তাহিক সন্দ্বীপের বিশেষ সংখ্যাগুলোতেও লিখতেন হাত খুলে। বিশ্বরাজনীতি ছিলো প্রথম পছন্দ।
১৯৮৮ সালে ‘সন্দ্বীপ বার্যিকী’তে ওনার লেখা ছাপতে পারলাম না। কষ্ট পেয়েছিলাম এজন্যে। উনি চমৎকার একটি গদ্য তুলে দিলেন হাতে। আমাদেরই তিন তলার অফিসে। বললেন, এই নাও, বিশেষ সংখ্যার বিশেষ নিবন্ধ। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম- স্যরি কাদের ভাই। চা খান। এই আয়োজনে নয়, পরের সপ্তাহে লেখাটি ছাপবো। কারণ সন্দ্বীপ বার্যিকীতে শুধু দলীয় প্রধানদের লেখা ছাপা হচ্ছে। শীর্ষ রাজনীতিকদের অধিকাংশ লেখাই পেয়ে গেছি। এই বলে ড্রয়ার থেকে বের করলাম জননেত্রী শেখ হাসিনা’র টাটকা লেখা। তিনি তখন নতুন লেখালেখি শুরু করেছেন। আমাদের অনুপ্রেরণা ছিলো প্রবল। সে সব অন্য কাহিনী। ‘মিডিয়া মুখর দিনগুলো’ পান্ডুলিপিতে রয়েছে সেইসব অজানা অধ্যায়।
চোখ যেন কপালে তুললেন কাদের ভাই। আকস্মিক আর্তচিৎকারে, আহ্লাদে আটখানা যেন। বললেন, একি করছো তুমি! একবারে নেত্রীর লেখা লইয়া আইছো। তুমিতো মিয়া মারাত্মক খেলা দেখাইলা। যাক, ওনার লেখা গেলেইতো ষোলকলা পূর্ণ। আমারটা না হয় পরের বারে যাক। ওনারটা আগে ভালোভাবে ছাপো।
সন্দ্বীপ ম্যাগাজিনটি অতিদ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো অনেক কারণে। এসবের একটি ছিলো- বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য দুর্লভ বিষয় প্রকাশ। প্রতিকুল পরিস্থিতিতে সর্বাধিক দুর্লভ আলোকচিত্র ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেলের পারিবারিক চিত্রমালা জাতিকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। ‘বঙ্গবন্ধুর জানাজার ওরা ১১ জন’ শীর্ষক সচিত্র প্রতিবেদন আলোড়ন তোলে দেশে-বিদেশে। এক্ষেত্রে আলোকচিত্রী ও রাজনীতিকদের যথেষ্ট সহযোগিতা ছিলো।
কাদের ভাই বরাবর উদার, নিরহংকারী। একবার বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তখন ভারতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। দেশে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ১৫ বছর কেটে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো, সন্দ্বীপ ম্যাগাজিনে ওনার ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। ১৯৮৯-এর এপ্রিলে গেলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। বিশাল সাক্ষাৎকারও পেলাম। আমাদের খন্ডকালীন সাংবাদিক, ব্যাংকার, কবি ফেরদৌস সালাম সাহায্য করলেন। সামনে কুরবানি ঈদ।
বিশেষ সংখ্যার বিশেষ উপহার। বিপ্লবী বাঘা সিদ্দিকীর বিস্ময়কর বিদেশ-বার্তা। ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে মুখে কোন মাংস তুলে নিতে পারিনি। মাংস দেখলেই বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত দেহের কথা মনে পড়ে। নিহত সবার রক্তাপ্লুত চেহারা ভেসে ওঠে। কচি রাসেলের কচি দেহটিও কুরবানি হয়েছে। -আমি কী আর কোন মাংস মুখে নিতে পারি?
সন্দ্বীপের লাল প্রচ্ছদে কাদের সিদ্দিকীর লোমহর্ষক বক্তব্য। কিন্তু সাক্ষাৎকার ছাপতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। যথাযথ আলোকচিত্র নেই। আমি নিজেই কাঁচা হাতে বর্ধমানে ছবি তুলেছি। কিন্তু পানি ঢোকায় ক্যামেরা ভালো ফলাফল দিলো না। ছবি তোলার সময়ে কাদের সিদ্দিকী একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছেন, সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার ভালো মুখচ্ছবি আছে। গতবার ওরা সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে। ছেপেছেও। ওদের থেকেও ছবি নিতে পারো। নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।
গেলাম, কিন্তু সাহায্য পেলাম না। অগ্রজ লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির আমারও ঘনিষ্ঠ। দেখলাম, বিচিত্রা অফিসে ওনার টেবিলের গ্লাসের নিচেই যা চাচ্ছি, তা। কাদের সিদ্দিকীর হাস্যোজ্জল মুখচ্ছবি। বললাম, বের করে দিন। আমাদের লাগবে। কাদের ভাই স্বয়ং বলেছেন এটির কথা।
শাহরিয়ার কবির উল্টোকথা শোনালেন। বললেন, এটি যিনি তুলেছেন, তার অনুমতি লাগবে। বললাম, পুনর্মুদ্রনে অনুমোদন না হলেও চলে। সৌজন্যে ‘বিচিত্রা’ লিখবো। তাছাড়া, অনুমোদন লাগলে, ওনাকে ফোন দিন। আমরা একটু বিপদেই আছি।
সেসময়ে মোবাইল বা সেল ফোন বাজারে আসেনি। ল্যান্ডফোনই ভরসা। কিন্তু অগ্রজ সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ফোন তুললেন না। বললেন, পরে বিষয়টি দেখবেন। বুঝলাম, ডাল গলবে না। বিফল মনোরথে ফিরলাম- ১৩৩ টয়েনবী রোডের মতিঝিলস্থ অফিসে।
নিচে থেকে রিসিপশনিস্ট জানালো, আমার রুমে মেহমান। লিফটবিহীন তিন তলায় উঠে দেখি- কাদের ভাই। প্রফুল্লচিত্ত ওবায়দুল কাদের। দেখা হতেই যেন অনুযোগের সুর। কি মিয়া, কাদের সিদ্দিকীর ইন্টারভিউ নিয়া আইলা নাকি? কি বললো বাঘা সিদ্দিকী? তুমিতো জানো, উনি আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার। প্রবাসে থাকে। মুক্ত মানুষ। মুক্ত কথা বলে। একটু দেখে-শুনে ছাইপো।
বললাম, ছাপবো কি ভাবে! ভালো ছবি পাচ্ছি না। আমার ক্যামেরায় পানি ঢুকেছিলো কলকাতায়। এয়ারপোর্টে হঠাৎ বৃষ্টি। কাঁধের ক্যামেরা অলক্ষ্যে ভিজে গেছে। পরে টের পেয়েছি। ছবির জন্য গেলাম বিচিত্রা অফিসে। পেলাম শাহরিয়ার কবির ভাই-এর টেবিলে। গ্লাসের নিচেই। কিন্তু ফটোগ্রাফারের অনুমতির দোহাই দিলেন। ছবি দিলেন না। এখন কি করি বলেন তো?
স্মিত হাসলেন কাদের ভাই। কৌতুকও করলেন। বললেন, কাদের সিদ্দিকীর কল্যাণে ওবায়দুল কাদেরকে চাও? বললাম, আপনি মুক্তিযোদ্ধা, উনিও মুক্তিযোদ্ধা। একই দল করেন। দুজনের মূল নামও ‘কাদের’। অতএব আপনার একটা দায়িত্বও তো রয়েছে।
কাদের ভাই এবার একটু গম্ভীর হলেন। কণ্ঠে খানিকটা ভারত্ব এনে বললেন- তাতো অবশ্যই। তো চেতনার মুক্তিযোদ্ধারা তোমার জন্য কিছু করলো না! শোন, মিডিয়াতেও অনেক রাজনীতি আছে। কৌশলে কাজ সারবে। তোমরা একটা হাউজ গড়ার চেষ্টা করছো। অন্য মিডিয়া কি সহমর্মী হবে! প্রতিযোগিতা আছে না?
সময় লাগলেও কাদের ভাই-এর বিশ্লেষণ হৃদয়ঙ্গম করলাম। তিনি সেবার বিলম্ব করলেন না। বললেন, এক্ষুণি চলো, তোমাকে সমাধান দিচ্ছি। এরপর দু’জন হেঁটে চলে গেলাম আরামবাগের বাসায়। হাঁটাপথই। কাদের সিদ্দিকীর ‘রণাঙ্গন’৭১’ বইটি দিলেন। বিশাল বপুর দুর্লভ বইটিতে অসংখ্য ছবি। আমাদের দারুণ কাজে লাগলো। পাঠকও পরিতৃপ্ত হলেন। কাদেরীয়া বাহিনীর বেশ ক’জন মুক্তিযোদ্ধাও এগিয়ে এলেন। পাওয়া গেলো আরও কিছু অমূল্য আলোকচিত্র। নানা মাত্রিকতায় সন্দ্বীপ ম্যাগাজিন ওপরে উঠে গেলো। মাত্র পাঁচ মাসের প্রচেষ্টায় প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে। নতুন প্রজন্মের এক ঝাঁক সাংবাদিকও বিকশিত হলেন। নঈম নিজাম, মুন্নি সাহা, ইয়াসির ইয়ামিন, শহিদুল আজম, পীর হাবিব, সুমন মাহমুদ, রাশেদ আহমেদ, ফরিদ বাশার, ফজলুল বারী, ফেরদৌস সালাম, আফরোজা পারভিন, সাকিব সুলেরী, দীপক সাহাসহ অসংখ্য নাম। লেখক-কলামিস্ট-রাজনীতিক ওবায়দুল কাদেরও ছিলেন সবার অভিভাবক-বন্ধু।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ একটি আগাম সংবাদ ছেপেছিলো। সংবাদটি সত্যে পরিণত হওয়ায় প্রত্রিকাটির মর্যাদা বেড়েছে। শিরোনাম : আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন ওবায়দুল কাদের । হওয়ার আগেই খবর। এ বিষয়ে ফেসবুকে গর্ব করে পোস্ট দিয়েছে সম্পাদক নঈম নিজাম। তার সাথে ওবায়দুল কাদেরের গভীর সম্পর্ক সেই সন্দ্বীপ ভবন থেকেই। সাংবাদিকতার সূচনাও সেই স্মৃতির প্রাঙ্গন থেকে।
ক্রীড়া পরিষদ অফিসে প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে পেলাম। সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে স্মৃতি ভাঙ্গার কথা বলেছিলাম। দেখা হলে বললাম, দুটো মন্ত্রণালয়তো ভালোই চালাচ্ছেন। -আরে দুটো কথায়? তিনটি মন্ত্রণালয় চালাচ্ছি মিয়া।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উচ্চারণ করলেন কাদের ভাই। টাই লাগানো স্মার্ট পোশাক, অভিব্যক্তি। আমি বিস্ময় প্রকাশ করলাম। প্রশ্ন- তিন মন্ত্রণালয় মানে?
জবাব যেন ঠোঁটেই প্রস্তুত। বললেন, যুব ও ক্রীড়া। সংস্কৃতি। আর ছাত্রলীগ। এই যে প্রাণের ছাত্র-সংগঠন এটাও তো আমাকে দেখতে হয়। আমি যোগ করলাম, ছাত্রলীগকে মন্ত্রণালয়ের সমান বলছেন?
নিজের যুক্তিকে আরও জোরালো করলেন তিনি। বললেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি মন্ত্রণালয়ের চেয়েও অধিক ভারবাহী। বুঝলা সালেম সুলেরী, মন্ত্রণালয় সামলানো যায়। ছাত্রলীগ অতো সহজে সামলানো যায় না। সাবেক সভাপতি বলে আমি এর গতি-প্রকৃতি বুঝি। লাগাম ধরতে পারি।
‘কাদের ভাই প্রসঙ্গ’ নিয়েও স্মৃতির লাগাম টানা কষ্টকর। বহুমাত্রিক মানুষ তিনি। লেখক সত্বাকেও জাগিয়ে রেখেছেন। মন্ত্রী হলেও বাইমেলায় প্রতিদিনের আড্ডাবাজ। নিজের প্রকাশনাও অনেক। বাংলাদেশের হৃদয় হতে, পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু, এই বিজয়ের মুকুট কোথায়, তিন সমুদ্রের দেশ, মেঘে মেঘে অনেক বেলা- ইত্যাদি। আবেগ জাগানিয়া বিষয়ে পরিপূর্ণ। অজানা তথ্যে ভরা বইও রয়েছে। কারাগারের অনুস্মৃতি : যে কথা বলা হয়নি, এমনই একটি।
এবারে সে কথাতেই আসছি। যা শুরুতেই বলতে চেয়েছি। সেই ২০১২-এর সাক্ষাৎপর্ব। তিনি রেল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে। টেলিফোনেই বললাম, আপনার এই মন্ত্রণালয়ে আমাদের কাজ আছে। বললাম, জানেনতো আমাদের বাড়ি বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারীতে। ডোমার উপজেলায়। নীলফামারী-ডোমার অসুস্থ সড়কের বিষয়টি অধিকতর জরুরী। নীলফামারীতে একটি ইপিজেড রয়েছে। এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন। এখানে উৎপাদিত মালামাল বিদেশে নেওয়া কষ্টকর। রেলওয়ের মূল লাইনের সঙ্গে লিংক লাইন নেই। থাকলে রেলের পরিবহন খাত অনেক মুনাফা পেতে পারে। উদ্যোক্তারাও রপ্তানি খাতে রাখতে পারে বিশেষ অবদান। শুধু সড়ক নির্ভর পরিবহন ইপিজেড-কে সফল হতে দিচ্ছে না। রেল সংযোগ থাকলে ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীও সুবিধা নিতে পারবে। কাঁচা মাল সরবরাহে উৎসাহী হবে স্থানীয় কৃষি সেবীরা। গোলা-গোয়াল-গৃহ- প্রকৃত হবে।
কাদের ভাই প্রশ্ন করলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি বলে? কোন আপডেট? বললাম, আছে। একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হওয়ার কথা। সে মতে সৈয়দপুর-নীলফামারীর মাঝখান থেকে সংযোগ ঘটবে। ডিজাইন, বাজেট- সব চূড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তিনমাস আগে নীলফামারীতে ঘোষণা দিয়েছেন। জনসভায় বলেছেন, ইপিজেড-এ রেল সংযোগ ঘটানো হবে। এখন এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনার।
হাসলেন কাদের ভাই। বললেন, আমিতো ওখানে অতিথি মন্ত্রী। দেখা যাক কী করা যায়? তা, তুমিতো শুনেছি বিদেশ থাকো। বাংলাদেশের আতিথ্য কতো দিনের? তোমার ফোন নাম্বার দাও। আমার এপিএস-এর কাছেও নাম্বারটি দিয়ে রেখো।
চার দিন বাদেই আবার ফোন-সংযোগ। আকাশ মাহমুদ ফোন ধরিয়ে দিলেন। দেখলাম, অপর প্রান্তে কাদের ভাই। বললেন, কাল নীলফামারী যাবো। সকালে এয়াপোর্ট স্টেশনে চলে আসো। দেখি তোমার ইপিজেড-রেল নিয়ে কী করা যায়।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এক ঘন্টা পর রওনা দেওয়ার কথা কক্সবাজার অভিমুখে। কবিতা বাংলা’র আয়োজনে আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব। নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতিসত্বার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। ফোন পেয়ে ভীষণ মনোক্ষুন্ন হলেন তিনি। কক্সবাজার নয়, নীলসাগরখ্যাত নীলফামারী যাচ্ছি জেনে। কী করবো, সে বিষয়টি যে অধিকতর জরুরী।
সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছলাম এয়াপোর্ট স্টেশনে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ট্রেন ছেড়ে গেলো। প্লাটফরমে দাঁড়ালো ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’। মন্ত্রী মহোদয় এই ট্রেনে দিনমান ভ্রমণ করবেন। অতএব সাজ সাজ রব ভেতরে-বাইরে। রেল বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শশব্যস্ত। ভেবেছিলাম, বিশেষ সেলুন থাকবে। কিন্তু তা নয়, প্রথম ও বিশেষ এসি ক্লাসকেই সাজানো হয়েছে। এ বিষয়ে ঘটনার বিবরণ দিলেন মন্ত্রী কাদের ভাই স্বয়ং। ব্যক্তিগত আলোচনায় বললেন, হঠাৎ করেই যাচ্ছি। সময় বের করতে পারলাম বলে রওনা দিলাম। বিশেষ সেলুন বসে আছে চট্টগ্রামে। আমিই তিন দিন আগে গিয়েছিলাম। ফিরেছি প্লেনে। সেই সেলুনটা সংস্কার শেষে ফিরবে ৪ দিন পর। সেই আরামবাহনকে অনিবার্য মনে করছি না। এখন যা পাচ্ছি, তাতেই পরিভ্রমণ করছি।
রেল কর্তৃপক্ষ যেন সর্ব্বোচ্চ সেবা দিতে তটস্থ। কাদের ভাই-এর মোবাইলে তাড়া দিচ্ছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। কিংবদন্তী গীতিকার, কলামিস্ট। লন্ডন থেকে ঢাকা এসেছেন। আবার চলেও যাবেন। কাদের ভাইকে ঢাকায় না পেয়ে হতাশ হলেন। বললেন, নীলফামারী যাওয়া হচ্ছে কেনো? কোন সম্মেলন বা প্রশাসনিক কর্মসূচি রয়েছে? কাদের ভাই বললেন, না। আকস্মিক সফর। সরেজমিনে সবকিছু দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে চাই।
ভ্রমণের আরও কারণ রয়েছে। সেটি আর কাউকে জানালেন না। ব্যক্তিগত আলোচনায় বললেন, মানুষের কাছাকাছি যেতে চাই। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাই। তোমার মতামত কি?
বললাম এটাইতো আসল কাজ। দলনেত্রীও তো তৃণমূলের নেতাদের ফোন দেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। পরামর্শ নেন। আপনিও কি সে পথে হাঁটছেন?
হাঁটতে তো চাই। কিন্তু অসুবিধাও তো আছে। কাদের ভাই আর বিস্তারিত কিছু বলতে চান না। কিন্তু ওনার মনোবেদনার বিষয়টি বুঝি। ২০০৯-এর ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে তিনি জিতেও হেরে গেছেন। সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। বানানো হয়েছিলো প্রেসিডিয়াম সদস্য। অনেকের মতে, ওনাকে আকাশে ওঠানো হয়েছে। এবার আর নামবেন কিভাবে! কিন্তু তিনি নামতে চান। আজন্ম লালিত স্বপ্ন- প্রিয় দলটির সাধারণ সম্পাদক হবেন। কিন্তু কোন পথে?
পথ যেন তিনি পেয়েই গেছেন। জনপথ, সেতুপথ, রেলপথ। সেদিনের যাত্রাপথে প্রকাশ করলেন অকপট সত্য। বললেন, আজ শুক্রবার। যাত্রা শুরুর দিন। আ’লীগের প্রেসিডিয়ামে সম্মানিত সদস্য। ভালো কথা। কিন্তু তৃণমূলের মানুষগুলোকে পেতে হবে। তাই চাই আরেক রাজনীতি। ব্যাপক জনসংযোগ। ডিজিটাল যুগের সব মাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে।
বললাম, নেমে পড়েন। প্রত্যেকটি সফরকে কাজে লাগান। ৬৪ জেলাতেই পদধূলি দিন। কেন্দ্রীয় নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সুবক্তা। রাজনীতিতে এমপি, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, আবার মন্ত্রী! আর কি লাগে! ব্যাপক সাড়া পাবেন এলাকায় এলাকায়। তারাইতো দল, নিকটজন, জাতীয় কাউন্সিলের কাউন্সিলর, ভোটার। তাদের হাতেই দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক। অতএব তাদের কাছেই নিবেদন করুন বেশিটা সময়। তারা যেন বলতে পারেন, পা বাড়ালেই মন্ত্রী কাদের। হাত বাড়ালেই নেতা কাদের। বুক বাড়ালেই ওবায়দুল কাদের।
রাজনীতি দিয়েই রাজনীতিকে জয়ের নতুন প্রত্যাশা। ট্রেনের আসনে বসে নামাজ আদায় করলেন। ভালোই লাগলো নও-নামাজী ওবায়দুল কাদেরকে। ১১ টি স্টেশনে নীলসাগর এক্সপ্রেস থামলো। মন্ত্রী যাচ্ছেন, এমন সংবাদ পৌঁছে গেছে এলাকায় এলাকায়। স্টেশনে স্টেশনে তাই নেতা-কর্মীদের প্রবল ভিড়। ১১টি স্টেশনেই ফুলের মালা, জনমিলন, শ্লোগান। শুভেচ্ছা, স্বাগতম এবং দুই মিনিটের বক্তৃতা।
নীলফামারী পৌঁছেও অন্যরকম পরিস্থিতি। নেতা-অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর তখনও শুধুই এমপি। মন্ত্রী হননি। আরও তিন এমপি, অফিসার ও নেতা-কর্মীদের নিয়ে ছুটলেন। গেলেন নীলফামারী-ডোমার অসুস্থ সড়কের মধ্যিখানে। সমাধানও দেওয়া গেলো। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও কথায় কম যান না। সড়ক-সভায় ঢাললেন রাজনৈতিক আবেগ। বললেন, এ সড়ক শুধু আপনাদের একার নয়। আমাদেরও। একদা আমার নেত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হয়েছিলাম এই পথেই। সেদিন ভেবেছিলাম, এই পথের ধারের মানুষগুলোকে কখনো দেখতে পাবো তো। আজ সে প্রত্যাশা পূরণ হলো। আমার রাজনীতি আর মন্ত্রিত্বও ধন্য হলো।
সন্ধ্যায় নীলফামারী সার্কিট হাউজে বসলো নেতা-কর্মী বৈঠক। সভাপতিবিহীন সভা। পরিচালনা করলেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এডভোকেট মোমতাজ। বক্তব্য রাখলেন এমপি আসাদুজ্জামান নূর, এমপি কর্ণেল (অব) সাকলায়েন, এমপি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী। শুভেচ্ছা-সম্ভাষণ জানালেন জেলা আ’লীগ সভাপতি, মেয়র দেওয়ান কামাল। উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বসুনিয়া, সাবেক চেয়ারম্যান আফতাবউদ্দিন সরকার দিলেন বক্তব্য। আরো প্রায় ১০ জন স্থানীয় নেতা বক্তব্য রাখলেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের নির্বাচনী কৌশল নিয়ে কথা বললেন। নীরবে তৃণমূলে সারলেন এক কার্যকরী সৌহার্দ্য সভা। নিভৃতে রচনা করলেন এক অবিচ্ছেদ্য মিলনবন্ধন।
পরদিন একই কারিশমার বৈঠক করলেন দিনাজপুরে। সেটিও সফল। এভাবে টার্গেট করলেন দেশের ৬৪ জেলাকেই। নীলফামারী বৈঠকের পর নেতা-কর্মীরা পেলেন ফলাফলও। এমপি আসাদুজ্জামান নূর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাবউদ্দিন প্রথমবারের মতো পেলেন এমপিত্ব। অন্যান্য নেতারাও পেলেন পদ-পদবী সুযোগ সুবিধে। আওয়ামী লীগের ২০ তম কাউন্সিলে এই নেতা-কর্মীরাই ছিলেন প্রকৃত প্রতিনিধি। তাদের নীরব সমর্থন ছিলো ওবায়দুল কাদেরের অণুকূলে। ভোট হলে তারা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। মাঠের দাবি পৌঁছে গিয়েছিলো নীতি-নির্ধারকদের কানে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যেও কাদের-প্রিয়তার চিত্র। অর্থাৎ তৃণমূলকে জয় করে নিয়েছেন তিনি। ফলে জননেত্রী শেখ হাসিনা আর না করতে পারেননি। উপহার দিলেন নতুন জাতীয় কমিটি। দলে রানিংমেট হিসেবে বেছে নিলেন জননন্দিত ওবায়দুল কাদের-কেই।
আবার পুরনো প্রসঙ্গ। একদা সন্দ্বীপ ভবনে আসা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কাদের ভাই। কারণটি বেশ মজার। জানতে পারি পরে। কাদের সিদ্দিকীর ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। নতুন কি বক্তব্য যাচ্ছে, পরখ করতেন। একদিন বললাম, এতো কিছু দেখার কী আছে? তিনিতো আপনাদের দলেরই একজন। কাদের ভাই মুখ নিচু করে বললেন, তবুও দেখাটা দরকার। কাউকে বলো না, নেত্রীর আদেশ…।
অনেক পরে বুঝেছি, দেওয়ালের ইটগুলো নতুন নয়। শেখ হাসিনা বনাম কাদের সিদ্দিকীর দ্বন্দ্বটা আগে কেউ বোঝেনি। ১৯৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন। ঐ দিন রাতেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নেত্রীর দেওয়া নৈশভোজ। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৯১-এর এমপি হওয়া। তারপর বিরোধ। জাতীয় কৃষক শ্রমিক দল গঠন। গঠনের অনুষ্ঠানে আ’লীগের একাংশের হামলা। তারপর বাঘা সিদ্দিকী শেখ হাসিনার উল্টো পথে চলা।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার যৌথ বই বেরিয়েছিলো। ১৯৮৯ সালে। শিরোনাম : ‘কাদের সিদ্দিকীর গ্রন্থ সমালোচনা ও সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার’। দারুণ বিক্রি হয়েছিলো। আমরা লেখক-স্বত্বের অর্থ কাদের সিদ্দিকী প্রত্যাবর্তন কমিটিকে দিয়েছিলাম। পরের বছর কাদের সিদ্দিকী ফিরলেন। কিন্তু পেয়েও হারালেন আ’লীগের নৈকট্য। দলপ্রধান শেখ হাসিনার আণুকূল্য ফিরে পেলেন না। এই বাস্তবতাটি হয়তো ওবায়দুল কাদের জানতেন। পরবর্তীতে দলে ফেরানোর নামে কাদের সিদ্দিকীর শরণাপন্নও হয়েছিলেন। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধুর মানসপুত্র’ কাদের সিদ্দিকী তিমিরেই রয়ে গেলেন। অন্যদিকে কৌশলী ওবায়দুল কাদের জয় করলেন সাফল্যের ঢেউ।
শুধু রাজনৈতিক অর্জন নয়। মন্ত্রী হিসেবেও তিনি আলোচনার শীর্ষে। উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে অতীব তৎপর। সুবিশাল পদ্মা সেতুর বিনির্মাণে সতত নিবেদিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন সড়ক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। যমুনা নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। সাম্প্রতিককালে সর্বাধিক বিনিয়োগ যুক্ত করছে মহাচীন। আ’লীগের কাউন্সিলের মুখে বাংলাদেশ সফর করলেন চীনের প্রেসিডেন্ট। ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের হাতখোলা বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছেন। দিয়ে গেছেন গরিব বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়ানোর অনন্য সুযোগ। এই দুর্লভ অর্জনের নেপথ্যে সরকারের একটি মহল অনেক খেটেছে। তাদেরও একজন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ কারণেও তিনি অভিনন্দিত হলেন। অভিমত অনেকেরই।
# নিউইয়র্ক, অক্টোবর, ২০১৬