নিউইয়র্ক ০৮:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

একদিনের দেখা যেনো শত বছরের চেনা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:৩৮:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৪
  • / ১৯৬৫ বার পঠিত

মওলানা ভাসানী। পুরো নাম আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ডাক নাম চেগা মিয়া। দেশব্যাপী খ্যাতি মওলানা ভাসানী নামে হলেও তিঁনি কারো কাছে হুজুর বা পীর, কারো কাজে মজলুম জননেতা, কারো কাছে ‘খামোশ’ নামের আতঙ্ক, কারো কাছে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’। ১৭ নভেম্বর তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রস্টা মওলানা ভাসানী দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন, সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
মওলানা ভাসানী দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অধিকাংশ সময়ই টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাটিয়েছেন। সন্তোষের জমিদার উচ্ছেদের পর এই জমিদারীর বিশাল এলাকা জুড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৯টি কারিগরি ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আজ সন্তোষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক মওলানা মোহাম্মদ আলী (এম এম আলী) কলেজ। সন্তোষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়েই রয়েছে মওলানার শত-সহস্র স্মৃতি। গ্রামবাংলার চিরচেনা ভাসানী হুজুরের কুঁড়ে ঘর, ঐতিহাসিক দরবার হল, সন্তোষ দীঘি প্রভৃতি আজো কালের স্বাক্ষী।
Mowlana vashani2হুজুর ভাসানীর জন্ম ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। জীবনের শুরুতে মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ এবং মক্তবেই কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। ১৯০৩ সালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। এ সময় ১০ মাস কারা ভোগ করেন। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন করেন। সেই থেকে তার নামের সাথে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ১৯৩১ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারী ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। তিনি এর অন্যতম সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মুসলিম আওয়ামী লীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের জননেতা শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৬ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ রোধকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট ৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকায় অনশন করেন। মওলানা ভাসানী ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচির প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ এ মামলার সকল আসামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হলে দূর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী উত্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তিনি সমর্থন দেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। এসময় তিনি ভারতে ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারী সাপ্তাহিক হককথা পত্রিকা প্রকাশ করেন। মুজিব সরকারের ব্যাংক বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণনীতি ও ১৯৭২ সালে সংবিধানের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন।
Mowlana vashani3বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন মওলানা ভাসানী। সেই সাথে বাঙালী জাতিসত্তা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নেতা। দেশের মুকুটহীন সম্রাট।
সবুজ, শ্যামল গাছ-গাছালীতে ঘেরা মনোরম পরিবেশে ঘেরা সন্তোষ। কবে, কখন হুজুর ভাসানীকে দেখেছিলাম তার দিন তারিখ মনে নেই। তবে এটুকু স্মৃতিতে চির ভাস্বর যে ঐ দিন সকালে সন্তোষের কুঁড়ে ঘরের সামনেই চেয়ারে বসেছিলেন মওলানা ভাসানী। পড়নে ছিলেন সাদা পাঞ্জাবী আর চেকের লুঙ্গী। মাথায় বেতের টুপি। তাঁর আশেপাশে কয়েকজন ভক্ত। আমার জন্মস্থান টাঙ্গাইলের পৌরসভাধীন ভাল্লুককান্দী গ্রাম থেকে সন্তোষের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। হাঁটা পথে ৪০/৫০ মিনিটের পথ। রিক্সায় দূরত্ব ২০/২৫ মিনিট। কার সাথে কেনো, কিসের টানে সেদিন সন্তোষ গিয়েছিলাম তার স্মরণ করতে পারছি না। তবে বলতে দ্বিধা নেই ঐ একদিনের এক মূহুর্তের দেখা যেনো শত বছরের চেনা একজন মানুষ। এরপর হুজুর ভাসানীকে দেখতে যাই ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর। সেদিন তাঁর মরদেহ ঢাকা থেকে সস্তোষ আসার পর। হুজুর ভাসানীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শত-সহস্র সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে সন্তোষে। হেলিকপ্টারে হুজুরের মরদেহ নিয়ে আসা হয় সন্তোষে। বিকেলে তার প্রিয় প্রঙ্গনেই দাফন করা হয় তাঁর মরদেহ। যা আজ ‘ভাসানীর মাজার’ নামে পরিচিত।
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বরের পর থেকে প্রবাসী জীবনের আগ পর্যন্ত অন্ত এই দিনটিতেই সন্তোষ যেতাম প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে মানুষের ঢল দেখেছি সন্তোষে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত মানুষ আসতেন প্রাইভেট কার আর বাস যোগে। কখনো কখনো ৫দিন বা ৭দিন ধরে আয়োজন হতো নানা অনুষ্ঠানের। বিশেষ করে ১৭ নভেম্বর ভক্তদের জন্য রান্না করা তবারক (খিজুরি) পরিবেশন করা হতো ঐতিহাসিক নৌকা থেকে। টাঙ্গাইল সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ভক্তদের দেয়া অনুদানের অর্থ, দানকৃত গরু, ছাগল, খাসী, চাল-ডাল, শাক-সবজী, মরিচ মসলা দিয়েই তৈরী হতো তবারক। সেই স্মৃতি ভুলার নয়।
আমরা টাঙ্গাইল জেলা প্রেসক্লাবের প্রায় সকল সদস্য মিলেই সন্তোষে যেতাম ১৭ নভেম্বরের অনুষ্ঠান কভার করতে। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার মধ্যে থাকতো হুজুরের মাজার জিয়ারত, যাদুঘর প্রদর্শন, আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কুটির শিল্প প্রদর্শনী, বাউল আর মারফতি গান। অনুষ্ঠানগুলো দেখে পুরো সন্তোষে উৎসবমুখর পরিবেশ পরিলক্ষিত হলেও সবার মধ্যে হুজুর ভাসানীর শূণ্যতা ছিলো লক্ষনীয়।
সুদূর প্রবাসের আজো দেখতে পাই শশ্রুমন্ডিত সেই ‘মুখ’। যাঁর আদর্শের কথা আজো কানে বাঁজে।   আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক প্রাতঃস্মনীয় নাম মওলানা ভাসানী। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রবাদ পুরুষ মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে উপ-মহাদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের তাঁর আদর্শকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারলেই আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবো। যেকোন আধিপত্যবাদী শক্তিকে রুখতে মাওলানা ভাসানী প্রদর্শিত পথই আমাদের পাথেয়। তাঁর আদর্শের পথেই অপশক্তির অশুভ ইচ্ছাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবো।
বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের চলমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানীর মতো রাজনৈতিক নেতার বড় প্রয়োজন। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়া সময়ের দাবী। তাঁর আদর্শ নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্ভূদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিষয় যে, কেনো যেনো দেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও দল মওলানাকে ইতিহাস থেকে দূরে সরে রাখছে। তাঁকে আড়াল করতে চাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে। তারপরও দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই মওলানা ভাসানী হুজুর বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ। বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্ম আর আদর্শের জন্য। লেখাটির সমাপ্তি টানতে হৃদয়ে বাজছে ১৭ নভেম্বর সন্তোষে উঠা সেই শ্লোগান ‘যুগ যুগ জিয়ো তুমি, মওলানা ভাসানী, মওলানা ভাসানী’।
লেখক: সম্পাদক, ইউএনএ/হককথা.কম, নিউইয়র্ক। সাধারণ সম্পাদক, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

একদিনের দেখা যেনো শত বছরের চেনা

প্রকাশের সময় : ১২:৩৮:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৪

মওলানা ভাসানী। পুরো নাম আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ডাক নাম চেগা মিয়া। দেশব্যাপী খ্যাতি মওলানা ভাসানী নামে হলেও তিঁনি কারো কাছে হুজুর বা পীর, কারো কাজে মজলুম জননেতা, কারো কাছে ‘খামোশ’ নামের আতঙ্ক, কারো কাছে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’। ১৭ নভেম্বর তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রস্টা মওলানা ভাসানী দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন, সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
মওলানা ভাসানী দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অধিকাংশ সময়ই টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাটিয়েছেন। সন্তোষের জমিদার উচ্ছেদের পর এই জমিদারীর বিশাল এলাকা জুড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৯টি কারিগরি ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আজ সন্তোষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক মওলানা মোহাম্মদ আলী (এম এম আলী) কলেজ। সন্তোষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়েই রয়েছে মওলানার শত-সহস্র স্মৃতি। গ্রামবাংলার চিরচেনা ভাসানী হুজুরের কুঁড়ে ঘর, ঐতিহাসিক দরবার হল, সন্তোষ দীঘি প্রভৃতি আজো কালের স্বাক্ষী।
Mowlana vashani2হুজুর ভাসানীর জন্ম ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। জীবনের শুরুতে মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ এবং মক্তবেই কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। ১৯০৩ সালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। এ সময় ১০ মাস কারা ভোগ করেন। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন করেন। সেই থেকে তার নামের সাথে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ১৯৩১ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারী ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। তিনি এর অন্যতম সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মুসলিম আওয়ামী লীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের জননেতা শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৬ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ রোধকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট ৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকায় অনশন করেন। মওলানা ভাসানী ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচির প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ এ মামলার সকল আসামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হলে দূর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী উত্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তিনি সমর্থন দেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। এসময় তিনি ভারতে ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারী সাপ্তাহিক হককথা পত্রিকা প্রকাশ করেন। মুজিব সরকারের ব্যাংক বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণনীতি ও ১৯৭২ সালে সংবিধানের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন।
Mowlana vashani3বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন মওলানা ভাসানী। সেই সাথে বাঙালী জাতিসত্তা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নেতা। দেশের মুকুটহীন সম্রাট।
সবুজ, শ্যামল গাছ-গাছালীতে ঘেরা মনোরম পরিবেশে ঘেরা সন্তোষ। কবে, কখন হুজুর ভাসানীকে দেখেছিলাম তার দিন তারিখ মনে নেই। তবে এটুকু স্মৃতিতে চির ভাস্বর যে ঐ দিন সকালে সন্তোষের কুঁড়ে ঘরের সামনেই চেয়ারে বসেছিলেন মওলানা ভাসানী। পড়নে ছিলেন সাদা পাঞ্জাবী আর চেকের লুঙ্গী। মাথায় বেতের টুপি। তাঁর আশেপাশে কয়েকজন ভক্ত। আমার জন্মস্থান টাঙ্গাইলের পৌরসভাধীন ভাল্লুককান্দী গ্রাম থেকে সন্তোষের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। হাঁটা পথে ৪০/৫০ মিনিটের পথ। রিক্সায় দূরত্ব ২০/২৫ মিনিট। কার সাথে কেনো, কিসের টানে সেদিন সন্তোষ গিয়েছিলাম তার স্মরণ করতে পারছি না। তবে বলতে দ্বিধা নেই ঐ একদিনের এক মূহুর্তের দেখা যেনো শত বছরের চেনা একজন মানুষ। এরপর হুজুর ভাসানীকে দেখতে যাই ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর। সেদিন তাঁর মরদেহ ঢাকা থেকে সস্তোষ আসার পর। হুজুর ভাসানীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শত-সহস্র সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে সন্তোষে। হেলিকপ্টারে হুজুরের মরদেহ নিয়ে আসা হয় সন্তোষে। বিকেলে তার প্রিয় প্রঙ্গনেই দাফন করা হয় তাঁর মরদেহ। যা আজ ‘ভাসানীর মাজার’ নামে পরিচিত।
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বরের পর থেকে প্রবাসী জীবনের আগ পর্যন্ত অন্ত এই দিনটিতেই সন্তোষ যেতাম প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে মানুষের ঢল দেখেছি সন্তোষে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত মানুষ আসতেন প্রাইভেট কার আর বাস যোগে। কখনো কখনো ৫দিন বা ৭দিন ধরে আয়োজন হতো নানা অনুষ্ঠানের। বিশেষ করে ১৭ নভেম্বর ভক্তদের জন্য রান্না করা তবারক (খিজুরি) পরিবেশন করা হতো ঐতিহাসিক নৌকা থেকে। টাঙ্গাইল সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ভক্তদের দেয়া অনুদানের অর্থ, দানকৃত গরু, ছাগল, খাসী, চাল-ডাল, শাক-সবজী, মরিচ মসলা দিয়েই তৈরী হতো তবারক। সেই স্মৃতি ভুলার নয়।
আমরা টাঙ্গাইল জেলা প্রেসক্লাবের প্রায় সকল সদস্য মিলেই সন্তোষে যেতাম ১৭ নভেম্বরের অনুষ্ঠান কভার করতে। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার মধ্যে থাকতো হুজুরের মাজার জিয়ারত, যাদুঘর প্রদর্শন, আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কুটির শিল্প প্রদর্শনী, বাউল আর মারফতি গান। অনুষ্ঠানগুলো দেখে পুরো সন্তোষে উৎসবমুখর পরিবেশ পরিলক্ষিত হলেও সবার মধ্যে হুজুর ভাসানীর শূণ্যতা ছিলো লক্ষনীয়।
সুদূর প্রবাসের আজো দেখতে পাই শশ্রুমন্ডিত সেই ‘মুখ’। যাঁর আদর্শের কথা আজো কানে বাঁজে।   আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক প্রাতঃস্মনীয় নাম মওলানা ভাসানী। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রবাদ পুরুষ মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে উপ-মহাদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের তাঁর আদর্শকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারলেই আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবো। যেকোন আধিপত্যবাদী শক্তিকে রুখতে মাওলানা ভাসানী প্রদর্শিত পথই আমাদের পাথেয়। তাঁর আদর্শের পথেই অপশক্তির অশুভ ইচ্ছাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবো।
বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের চলমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানীর মতো রাজনৈতিক নেতার বড় প্রয়োজন। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়া সময়ের দাবী। তাঁর আদর্শ নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্ভূদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিষয় যে, কেনো যেনো দেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও দল মওলানাকে ইতিহাস থেকে দূরে সরে রাখছে। তাঁকে আড়াল করতে চাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে। তারপরও দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই মওলানা ভাসানী হুজুর বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ। বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্ম আর আদর্শের জন্য। লেখাটির সমাপ্তি টানতে হৃদয়ে বাজছে ১৭ নভেম্বর সন্তোষে উঠা সেই শ্লোগান ‘যুগ যুগ জিয়ো তুমি, মওলানা ভাসানী, মওলানা ভাসানী’।
লেখক: সম্পাদক, ইউএনএ/হককথা.কম, নিউইয়র্ক। সাধারণ সম্পাদক, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব।