অসময়ের কলাম
- প্রকাশের সময় : ১২:৩৯:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৫
- / ১০৯৭ বার পঠিত
সালাহউদ্দিন আহমেদ: চলতি ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে সুদূর ঢাকা থেকে পিতৃতুল্য জ্যেষ্ঠ ভাই (যাকে দাদা ভাই বলে ডাকি), অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার এবিএম আশরাফ উদ্দিন আহমেদ-এর ফোন। তাও একবার নয়, পরপর দু’ সপ্তাহে একাধিকবার। প্রতিবারই একই প্রশ্ন ‘তুমি ক্যামন আছো, তোমার জন্য খারাপ লাগছে, সত্যিকারে বলো তুমি ভালো আছো? তোমাকে দেখতে হচ্ছে করছে’। প্রত্যুত্তরে সকল প্রবাসীর মতো আমার একই উত্তর। ‘আমি ভালো আছি (ভালো থাকি বা না থাকি), আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না, দোয়া করবেন’। তবে আমি সত্যিই ভালো থেকে বলেছিলাম ‘আমি ভালো আছি’।
দাদা ভাই’র সাথে কথা বলার পর আমার মনে প্রশ্ন জাগে কেন তিনি এতো আমার কথা চিন্তা করছেন, কোন বিপদ আপদ সামনে আসছে কি? আমার বয়োবৃদ্ধ মায়ের মুখে শুনেছি ‘মানুষের ক্ষুধা বেড়ে গেলে নাকি অসুখ বিসুখ-বাড়ে’। কিন্তু আমার তো সেরকম কিছু হয়নি। দাদা ভাই’র চিন্তায় আমিও চিন্তিত হলাম কিছুটা। তারপর পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার উপর সব ছেড়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম।
২.
১২ ফেব্রুয়ারী বৃহস্প্রতিবারের ঘটনা। আমার দাদা ভাইয়ের মতো আমিও বেশ চিন্তিত তবে অন্য কাউকে নিয়ে নয়। চিন্তিত ছিলাম শ্রদ্ধেয় অগ্রজ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক ঠিকানা’র প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান আর সাপ্তাহিক রানার-এর প্রধান সম্পাদক তাসের মাহমুদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে। গেলো মাসে প্রিয় ফজলু ভাই’র ওপেন হার্ট সার্জারীর পর দু’সপ্তাহ যেতে না যেতেই গলব্লাডারের অপারেশন হলো। যেনো ‘মড়ার উপর খঁড়ার ঘা’। আর গুরুতর হার্টের সমস্যায় ম্যানহাটানের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কথা ছিলো টাইম টিভি’র সিইও, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা’র সম্পাদক এবং নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রিয় আবু তাহের ভাই আর আমি ঐদিন সন্ধ্যায় (১৪ ফেব্রুয়ারী, বৃহস্প্রতিবার) একত্রে হাসপাতালে যাবো তাসের ভাইকে দেখতে।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে টাইম টিভি/ বাংলা পত্রিকা অফিসে পৌঁছলাম। কিন্তু ঐ সময়ে টাইম টিভি অফিসে আমেরিকান কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে তাহের ভাই’র জরুরী মিটিং থাকায় সময়ের অভাবে আর তাসের ভাইকে দেখতে যাওয়া হলো না। আর কি করা। অগত্যা রাত সাড়ে আটটার দিকে বাসার ফেরার জন্য জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে প্রধান ফটকের সামনে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেলাম। সাথে সাথে শরীরটাও খারাপ লাগলো। মনে হলো শরীরের উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা করছিলো। এমন সময় টাইম টিভির নাজিম আমার অবস্থা বেগতিক দেখে ধরে এন্থনী গনজালেসের সহযোগিতায় অফিসে নিয়ে গেলেন। ততক্ষণে আমার বা পায়ে ব্যথা অনুভব করলাম এবং পায়ের গোড়ালীসহ আশপাশ বেশ ফুঁলে গেলো। তখন বুঝার বাকী রইলো না যে বা পায়ে সমস্যা হয়েছে। ফোন করলাম সৈয়দ ইলিয়াস খসরু আর তাহের ভাইকে। জানালাম শারীরিক অবস্থা ভালো না, হাসপাতালে যেতে হবে। তারা এসেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমাকে নিয়ে গেলেন কুইন্স জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে এক্সরে আর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জানা গেলো বা পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। পায়ের হাড় ফেটে গেছে। বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক দেখানো পরমর্শ দিয়ে মধ্য রাত দেড়টার দিকে ছেড়ে দিলেন।
ভায়রা ভাই শহীদুল ইসলাম খানের সহযোগিতায় বাসায় ফিরলাম। পরদিন পিসিপি ডা. নাজমুল খানের সাথে পরামর্শ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর অথারাইজ পেপার নিয়ে ফোন অ্যাপয়েন্টমেন্টর জন্য কল দিলাম এক প্রাইভেট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে। তারা জানালো আজ শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারী) রোগী দেখার সময় শেষ, কাল-পরশু শনি ও রোববার সাপ্তহিক ছুটি আর সোমবার (১৬ ফেব্রুয়ারী) ‘প্রেসিডেন্ট ডে’ ফেডারেল হলিডে। তাই ১৬ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবারের আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সম্ভব নয়। অগত্যা কি করা। ঐদিন সকাল সাড়ে ৯টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। ৩/৪দিন পর অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা শুনে গিন্নি মাহমুদা খাতুন রেগে গেলেন এবং ইমাজেন্সী হাসপাতালে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন। শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে তার কথায় ভায়রা শহীদুল ইসলামের সহযোগিতায় সন্ধ্যায় গেলাম এলমহার্স্ট হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে পায়ে প্লাষ্টার করে প্রতিবেশী রহমান ভাইর সহযোগিতায় ভোররাত চারটার দিকে বাসায় ফিরলাম। তারপর থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শে পুরো বেডরেষ্টে। তবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসা ‘জরুরী’ বলে মনে হয়নি। আমার মতো এমন অভিযোগ অনেক রোগীরই।
৩.
অপ্রত্যাশিত এমন শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য তৈরী ছিলাম না। আপাতত: কোন অসুখ-বিসুখে পরবো এমনটিও কল্পনাও করিনি। কেননা, প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আগামী গ্রীষ্মে দেশে বেড়াতে যাবো। যাই যাই করে নানা কারণে ৭/৮ বছর ধরে দেশে যাওয়া হচ্ছে না। অথচ মনে হয় এই তো সেদিন যেনো দেশ থেকে আসলাম। দেশে বয়োবৃদ্ধ মা’র প্রতিদিনের প্রত্যাশা আমি যেনো শীঘ্রই দেশে চাই। মা এক নজর দেখতে চাচ্ছেন প্রিয় সন্তান আর প্রিয় নাতি ৫ বছরের শাফিন-কে। প্রিয় ভাই-বোন আর স্বজনরা অপেক্ষা করছেন আমাদের দেখতে, একটু সান্নিধ্য পেতে। স্মৃতিতে ভাসছে, টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব চত্তর, প্রিয় কর্মস্থল দৈনিক মফস্বল, দৈনিক আজকের টেলিগ্রাম, সাপ্তাহিক পূর্বাকাশ চত্তর, টাঙ্গাইল শহরের প্রাণকেন্দ্র নিরালা মোড়, প্রতিদিনের যাতায়াত মেইন রোড সহ ভিক্টোরিয়া রোড, জেলা সদর রোড, শান্তিকুঞ্জু মোড়। সবসময় ভাবি দেশে যাওয়া এ আর এমন কি চাওয়া। এটাই তো স্বাভাবিক। আমারও তো দেশে যেতে ইচ্ছে করে। মায়ের শরীরের গন্ধ, দেশের মাটির গন্ধ আর প্রিয়মুখগুলো আমাকে যে ডাকে। কিন্তু প্রবাসের এমনিই বাস্তবতা, চাইলেই দেশে যাওয়া যায় না। আবেগ-অভিযোগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। জীবনটা বোধ হয় এমনি বৈচিত্রময়!
বলতে দ্বিধা নেই দেশে যাওয়া কথা মাথায় রেখেই ভাবছি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। এই পরিস্থিতি বিরাজ করলে দেশে যাওয়া কতটুকু নিরাপদ? ভাবছি দেশে কবে ফিরবে স্বাভাবিক অবস্থা? সহসাই কি এই সহিংস পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। প্রতিদিনই মানুষ হত্যা, জনসম্পদ ধ্বংস, ভয়ংকর পেট্রোল বোমার নৃশংসতাসহ নানা অঘটনের খবর। লাগাতার হরতাল-অবরোধ। পক্ষে-বিপক্ষে আক্রমণাত্বক আর প্রতিহিংসাপরায়ন বক্তব্য। দেশের রাজনীতিতে নেই কোন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস, সহযোগিতা-সহমর্মিতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আর গৃহপালিত বিরোধীদল নিয়ে সরকার লম্ফ-ঝম্ফ করছে। সরকারের রাজনৈতিক কুট-কৌশলে অবরুদ্ধ দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দর বিএনপি’র রাজনীতি। দেশের সাংবাদিক-মিডিয়াগুলো বিভক্ত। সরকার প্রধানসহ মন্ত্রী আর সুবিধাবাদী আমলা-চাকুরীদের দেশ-বিদেশে একই সুর ‘বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী দল, জঙ্গী সংগঠন’। অথচ সেদিন বেশী দূরে নয়। এই আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত সহ দেশের সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত করেছিল সর্বজনগ্রহণযোগ্য ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। রাজনীতির কি খেলা, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, তৎকালীন জাতীয় পার্টির ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ আর জামায়াতে ইসলামীর মওলানা মতিউর রহমান নিজামী বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, লড়েছেন আজ সেই রাজনৈতিক নেতারা পৃথক পৃথক মেরুতে অবস্থান করছেন। তাদের কেউ সরকারে, কেউ রাজপথে আবার কেউ কারাগারে ফাঁসির দন্ডাদেশপ্রাপ্ত। বাস্তবতা হচ্ছে যে, ক্ষমতার লোভে বিএনপি সরকার একদিন যে খেলা খেলেছে, সেই খেলাই রাজনৈতিক কূট-কৌশলের অধুনিকায়ন করেই ক্ষতায় টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট। কথায় বলে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই’। কিন্তু সেই রাজনীতির শেষ টার্গেট কেনো দেশের নিরীহ জনগণ? কে দেবে এর জবাব।
৪.
ব্যক্তিগতভাবে চাইনি আমার অসুস্থ্যতার কথা সবাই জানুক। কিন্তু মিডিয়া কর্মী বলে কথা। টাইম টিভি’র সিইও এবং বাংলা পত্রিকা’র সম্পাদক আমার প্রিয় মানুষ আবু তাহের আর বাংলা পত্রিকা’র বার্তা সম্পাদক আমার বিশেষ শুভানুধ্যায়ী, প্রিয় অগ্রজ হাবিবুর রহমান হাবিব ভাই থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, সাংবাদিক শিহাব উদ্দীন কিসলু ও শেখ সিরাজুল ইসলাম, বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক নিয়াজ মাখদুম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম, সাংবাদিক দর্পণ কবীর, সাখাওয়াত হোসেন সেলিম, আবিদুর রহীম, হাসানুজ্জামান সাকী, পুলক মামুদ ও শিবলী চৌধুরী কায়েস, টিভি সংবাদ পাঠক শাহাদাৎ হোসেন সবুজ ও টিভি সংবাদ পাঠিকা সাজিয়া খন্দকার, বাংলা পত্রিকার তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস, নর্থ ক্যারোলিনা প্রবাসী আদরের ছোট বোন শাহানাজ বেগম মনা, আমার টাঙ্গাইলবাসী মোয়াজ্জেম হোসেন খান মুকুল ও মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান, খন্দকার আশেক শামীম, শামসুজ্জামান খান, রফিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান খান আপেল, ফরিদ খান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, প্রতিবেশী আব্দুল চৌধুরী মারুফ ও দেওয়ান ইলিয়াস, কবি তমিজউদ্দিন লোদী, লেখক আব্দুল্লাহ জাহিদ, কবি-লেখক রেজানুর রহমান রেজা, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট আব্দুস শহীদ, ফারুক আহমেদ, মহিউদ্দিন দেওয়ান, হাজী এনাম, বন্ধুবর কামারুজ্জামান প্রিন্স, টাইম টিভির সৈয়দ ইলিয়াস খসরু, নাজিম, এন্থনী গঞ্জালেস, প্রিয় ছোটভাই সাজ্জাদ হোসাইন ও রিজু মোহাম্মদ প্রমুখের ফোন কল আর সহমর্মিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে মধ্যরাতে বাসায় এসে তাহের ভাইর আমার খোঁজ-খবর নেয়া আর আমাকে দেখার জন্য হাবিব ভাইর জ্যামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে গমন আমাকে অভিভুত করেছে। তাদের সবার প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
পুনশ্চ: অসময়ে বেড রেষ্ট। ডাক্তারের ভাষায় এক-দেড় মাস। অঢেল বেকার সময় হাতে। শুয়ে-বসে, টিভি দেখে, ল্যাপটপ হাতে সময় কাটছে। ব্যক্তিগত জবিনে আমি মিডিয়া কর্মী। কবি, লেখক বা কলামিস্ট নই। তাই অসময়ের সময় কাটাতেই দু-চার কথা তুলে ধরে কলাম লেখার চেষ্টামাত্র বলেই কলামটির নামকরণ করা হলো ‘অসময়ের কলাম’। প্রিয় পাঠক, ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন আর দোয়া করবেন যেনো দ্রুত সুস্থ্য হয়ে সবার মাঝে ফিরতে পারি। ২২ ফেব্রুয়ারী’২০১৫
লেখক: সম্পাদক, বার্তা সংস্থা ইউএনএ। সাধারণ সম্পাদক, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব।