প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান আর নেই : নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের গভীর শোক
- প্রকাশের সময় : ০৩:৫২:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ জুন ২০১৫
- / ৯৬০ বার পঠিত
ঢাকা: প্রখ্যাত সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান আর নেই। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লন্ডনের রয়েল ফ্রি হাসপাতালে তিনি ১ জুন সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় (স্থানীয় সময়, বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৫টা) ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তার পুরো নাম আ ন ম সিরাজুর রহমান। প্রখ্যাত এ সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরেই লন্ডনে বসবাস করছিলেন। সাংবাদিকতায় অসামন্য অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পুরষ্কার ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।
বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতা জগতের এই উজ্বল নক্ষত্রের জন্ম ১৯৩৪ সালে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুরে। বিবিসি বাংলা বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ইন্তেকালের সময় তিনি স্ত্রী সোফিয়া রহমানকে রেখে গেছেন। তার এক পুত্র ও কন্যা আগেই ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের রোগে ভুগছিলেন।
বিবিসি খ্যাত সিরাজুর রহমানের কণ্ঠস্বর বাংলাভাষাভাষী রেডিও শ্রোতার অতি পরিচিত। ‘সিরাজুর রহমান বলছি- লন্ডন থেকে’ তার এ কণ্ঠস্বর বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
কৈশোরে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয় কলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। এরপর তিনি পয়গাম, ইত্তেফাক, মিল্লাত প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেন। সেই থেকে আর সাংবাদিকতার জগত ছেড়ে চলে যাননি। পরিবর্তন ঘটেছে মাধ্যমের। ইন্টারমিডিয়েট অধ্যয়নরত অবস্থায় দৈনিক ইনসাফ ও ইত্তেহাদ পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সত্যযুগ’-এ পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগদান করেন।
৩৪ বছর তিনি বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজ করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ তার মুখে খবর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক ঘটনার সাক্ষী। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো।
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি বিবিসি থেকে অবসর নেন। এরপর থেকে তিনি ঢাকার সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিষয়ে লিখতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তে নিয়মিত কলাম লিখেছেন।
সিরাজুর রহমানের পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পরিবারের সাথে ঢাকা ফেরেন। কলকাতাতে মেট্রিক পরীক্ষার আগেই সাংবাদিকতা শুরু করেন। দেশে ফেরার পর ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতের অফিসিয়াল যে মিউজিকটি বাজানো হয় তা তৈরির পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন সিরাজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সংবাদ তার কণ্ঠেই প্রচার করেছিলো বিবিসি।
সিরাজুর রহমান অনেকগুলো বই লিখেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৭টি। এর মধ্যে ‘প্রীতি নিন সকলে’, ’বিবিসির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ : স্বাধীনতার পনের বছর’, ‘রাজনৈতিক প্রবন্ধ’, ‘জেন অস্টিনের অনুবাদ গ্রন্থ প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’, ‘আন্তন চেখভের নাটক’, ‘চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেকটশন্স’, ‘শার্লেটে ব্রুন্টির জেন এয়ার’ উল্লেখযোগ্যে। এছাড়া সিরাজুর রহমান তার আত্মজীবনী ‘এক জীবন, এক ইতিহাস’ লিখে গেছেন।
লন্ডন থেকে তাইছির মাহমুদ জানান, সাংবাদিক সিরাজুর রহমান সোমবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টায় নর্থ লন্ডনের রয়েল ফ্রি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তার স্ত্রী সফিয়া রহমান জানান, সকালে তিনি হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টেলিফোনে তাকে সিরাজুর রহমানের অবস্থার অবনতির কথা জানান। এ সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। কিন্তু তিনি পৌঁছার আগেই সিরাজুর রহমান মারা যান। ময়না তদন্ত শেষে তাকে স্থানীয় হেন্ডন কবরস্থানে দাফন করা হবে। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের ও স্ত্রীর জন্য সেখানে কবরের জায়গা কিনে রেখেছিলেন। এখানেই তার ছেলে ও মেয়ের কবর রয়েছে।
সিরাজুর রহমান স্বপরিবারে নর্থ লন্ডনের হেনডন এলাকায় থাকতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিলেন। ২০১১ সালে ছেলে সাইফুর রহমান ও ২০০২ সালে মেয়ে নাজনিন রহমান মারা যান। এরপর তিনি দুই নাতি তানভির রহমান ও ছল রহমানকে নিয়ে একই বাসায় থাকতেন।
খালেদা জিয়ার শোক: লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১ জুন সোমবার এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, মরহুম সিরাজুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাসে একজন পথিকৃত ব্যক্তিত্ব ও প্রবাদপ্রতীম পুরুষ। সুদীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সব গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিবিসিতে তার কণ্ঠ ছিল প্রেরণাদায়ক। তার সাংবাদিকতা পেশায় ভাষ্যে ও লেখনীতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীরা রবাবরই উজ্জীবিত হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়া তার শোকবার্তায় বলেন, মরহুম সিরাজুর রহমান ছিলেন একজন মহান জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক। বাংলাদেশের মানুষেরা দেশের এমন একজন সুযোগ্য কীর্তিমান পুরুষকে হারিয়ে শোকে আজ মুহ্যমান। প্রবাসে অবস্থানরত সব বাংলাদেশীসহ দেশবাসী এবং আমার দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী তার মৃত্যুতে শোকবিহব্বল। তার শুন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন মরহুম সিরাজুর রহমানের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোকাহত পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন।
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের শোক: প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের ইন্তেকালে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয়েছে।
ক্লাবের পক্ষ থেকে সভাপতি আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের আরেক দিকপাল সিরাজুর রহমানের ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, তার মৃত্যুতে দেশ ও দেশের জনগণ সৎ, মেধাবী, দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক সাংবাদিককে হারালো। দেশ ও প্রবাসের বাংলাদেশী সাংবাদিক সমাজ হারালো একজন অভিভাবকসহ এক অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বকে। তার শূন্যতা পুরণ হবার নয়। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা তার বিহেদী আতœার শান্তি কামনা এবং শোকাহত পরিবার বিশেষ করে তার স্ত্রী পরম শ্রদ্বেয় সোফিয়া রহমান যাতে এই শোক সইতে পারেন তার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা জানাই।