জাতিসংঘের ৭১তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে বিশ্বনেতাদের একমঞ্চে উপনীত হওয়ার আহবান
- প্রকাশের সময় : ১১:০১:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
- / ৮৯৯ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার স্বার্থে বিশ্ব থেকে সংঘাত দূর করে শান্তির পথে এগিয়ে যেতে অভিন্ন অবস্থানে উপনীত হতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দর প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন, আসুন জাতিসংঘকে টেকসই ও প্রাসঙ্গিক একটি সংস্থা তৈরীতে আমরা নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। তিনি বলেন ‘এক মানবতার’ জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি। মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আসুন ন্যূনতম বিষয়ে সকলে একমত হয়ে অভিন্ন অবস্থানে উপনীত হই এবং মানবতার স্বার্থে বিশ্ব থেকে সংঘাত দূর করে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাই। শেখ হাসিনা বলেন, এটা করার জন্য জাতিসংঘ আমাদের একটি অনন্য প্লাটফর্ম উপহার দিয়েছে। জাতিসংঘকে টেকসই ও প্রাসঙ্গিক একটি সংস্থা তৈরিতে আসুন আমরা নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। ’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ সেপ্টেম্বও বুধবার বিকেলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে ভাষণকালে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই ভাষণ মাতৃভাষা বাংলা ভাষায় দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়ায় সন্ত্রাসীরা অগণিত নিরীহ মানুষকে অহরহ হত্যা করছে। আমরা মনে করি, সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। এদের সকল রূপে ও প্রকাশে সমূলে মূলোৎপাটন করার সংকল্পে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থার মূল কারণগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। একইসঙ্গে এদের পরামর্শদাতা, মূল পরিকল্পনাকারী, পৃষ্ঠপোষক, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী এবং প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ভাষণের শুরুতে ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের অংশ তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে এই মহান সাধারণ পরিষদে বলেছিলেন, ‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলদ্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ১৯ মিনিটের ভাষণে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিশ্বশান্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর সরকারের বাস্তবায়িত চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ব বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যখন এসকল অভিশাপ থেকে মুক্তি খুব একটা দূরে নয়। অনেক সৃজনশীল ও প্রায়োগিক সমাধান এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। প্রযুক্তি, নব্য চিন্তাধারা ও বৈশ্বিক নাগরিকদের বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের একটি ‘নতুন সাহসী বিশ্ব’ সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে।
শেখ হাসিনা বিশ্ব পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, তবে এখনও আমাদের এই বিশ্ব উত্তেজনা ও ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়। বেশ কিছু স্থানে সহিংস-সংঘাতের উন্মত্ততা অব্যাহত রয়েছে। অকারণে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। যারা সংঘাত থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন, প্রায়শঃই বিভিন্ন দেশ তাদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করছে। কখনও কখনও অত্যন্ত জরুরী মানবিক চাহিদা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে অথবা সেগুলো প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার ৩-বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আইলান কুন্দীর? কী দোষ করেছিল ৫-বছরের শিশু ওমরান, যে আলেপ্পো শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। একজন মা হিসেবে আমার পক্ষে এ সকল নিষ্ঠুরতা সহ্য করা কঠিন। বিশ্ব বিবেককে কি এসব ঘটনা নাড়া দেবে না?
অভিবাসী সম্পর্কে তিনি বলেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে জাতিসংঘে অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ক একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি আশা করি, এই সম্মেলনের ফলাফল বর্তমান সময়ে অভিবাসনের ধারণা এবং বাস্তবতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করবে। অভিবাসী ও শরণার্থীদের স্বদেশ এবং গন্তব্য উভয় স্থানের জন্যই সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত অভিবাসন সংক্রান্ত গ্লোবাল কমপেক্ট-এর রূপরেখা প্রণয়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। আগামী ডিসেম্বর মাসে আমরা গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (জিইএমডি) আয়োজন করতে যাচ্ছি। এই ফোরামে আমরা অভিবাসন-সম্পর্কিত সকল বিষয়ে গঠনমূলক সংলাপের প্রত্যাশা করছি।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অনেকগুলো উন্নয়ন অর্জনকে হুমকির মুখোমুখি করছে। ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি এবং জলবায়ু সম্পর্কিত ন্যায় বিচারের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এই জলবায়ু চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। আমি আশা করি বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলি অতি সত্বর চুক্তিটিতে অনুসমর্থন জানাবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ করতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ‘ব্লু ইকোনমি’র সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সামুদ্রিক সপদ সংরক্ষণ ও এর টেকসই ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু ও ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি বৈরিতা নিরসনের জন্য সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলোকে অবশ্যই সঠিক দিকে পরিচালিত করতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে আমদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে যদি আমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন করি, তাহলে এখানে সম্ভাবনা ও সুযোগও রয়েছে প্রচুর’ তিনি উল্লেখ করেন।
অধিবেশনের বিকেলে সেশনে অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার কিটারোভিক, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা শ্রীসেনা, রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডাসিয়ান জুলিয়েন সিওলো, জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রী জিওরজি ভিরকাসভিলি এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ট্রানবুল।
আন্তঃসীমান্ত জলাধারের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার আহ্বান
বাসস’র আরেক খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পানিকে নতুন উন্নয়ন কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে আন্তঃসীমান্ত জলাধারের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার জাতিসংঘ সদর দফতরে পানি (এইচএলপিডব্লিউ) বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় তিনি বলেন, ‘নদী অববাহিকায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এবং পানি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ কার্যকর মোকাবেলায় পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি সুবিধার উন্নয়নসহ আমাদের আন্তঃসীমান্ত জলাধারের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবার জন্য স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার জন্য সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ বেশি নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে এবং ৬৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে।’
ব্যবসায়িক রীতির অঙ্গীকার রক্ষা করার আহ্বান
অপর খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক আচরণ, ন্যায্যমূল্য ও উন্নয়ন অর্থায়নের সুযোগদানের ক্ষেত্রে দেয়া অঙ্গীকার রক্ষায় বিশ্বের স্টেকহোল্ডারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে জাতিসংঘ সদর দফতরে ‘ডিসেন্ট ওয়ার্ক এন্ড ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বিষয়ক স্যোসাল ডায়লগ সংক্রান্ত গ্লোবাল ডিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘দেশে ও দেশের বাইরে সকল ক্ষেত্রে অভিন্ন দায়িত্বশীলতা হিসাবে ব্যবসাকে যদি গণ্য করা হয় তাহলে আমরা আরো লাভবান হবো।’ উল্লেখ্য, সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন লো ফেভেন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
উন্নয়নকে ‘যৌথ উদ্যোগ’ হিসাবে বর্ণনা করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে পারস্পরিক সমৃদ্ধ সংলাপের সুযোগ দিতে একটি বলিষ্ঠ প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশী শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে সুইজারল্যান্ডের সহায়তা কামনা
আরেক খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে সুইজারল্যান্ডের সহায়তা কামনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার জাতিসংঘের সদর দফতরে জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট জোহান ইেডার আম্মানের সাথে দ্বিপাক্ষিক এক বৈঠকে এই আহবান জানান। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, দুই নেতা বৈঠকে পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করেছেন। (বাসস)