হোয়াইট হাউজ দখলের লড়াইয়ে কে হাসবেন শেষ হাসি কমলা নাকি ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ আজ
- প্রকাশের সময় : ১২:৪৬:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪
- / ৬৬ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত ৪০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্ব›িদ্বতায় মুখোমুখি কমলা-ট্রাম্প। ফরওয়ার্ড ইনডিপেনডেন্ট না আমেরিকান ড্রিম? তরুণ ভোটারদের নিয়ে ইতিবাচক অর্থনীতি না-কি শক্তিশালী আমেরিকান অর্থনীতি- লাল না নীল- কোন শিবির হাসবে বিজয়ীর হাসি? কে পাচ্ছেন আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসের চেয়ার- সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের ২৪ মিলিয়ন ভোটার। দেশটির পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন তা ঠিক করবেন আমেরিকান ভোটাররা। ভোটের উত্তেজনা এখন চূড়ায়। টানা এক বছর ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির তুমুল প্রচারের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ভোটগ্রহণ শেষ হবে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টায়। যুক্তরাষ্ট একাধিক ‘টাইম জোনে’ বিভক্ত হওয়ায় সময়ের এমন পার্থক্যে ভোট শুরু হবে। একইভাবে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোট শেষ হওয়ার সময়ও ভিন্ন হবে। তবে অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হবে ইস্টার্ন টাইম সন্ধ্যা ৬টা ও মিডনাইট ইস্টার্ন টাইমের মধ্যে। ভোটকেন্দ্র প্রথম বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভোট গণনার কাজ শুরু হবে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ফলাফল আসতে শুরু করবে।
কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের দুইশ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারী প্রেসিডেন্ট। ইতিহাস তৈরির হাতছানি কমলার সামনে। অপরদিকে গত নির্বাচনে পরাজয়ের গøানি মুছে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যয় ট্রাম্পের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে।
হোয়াইট হাউজ দখলের লড়াইয়ে কে জয়ী হবেন, কে হাসবেন শেষ হাসি- কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প? এ প্রশ্নের জবাব পেতে এখন শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা। অনেক ভোটার শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। নীরব ভোটার আছেন অনেক। তাই ফলাফল প্রকাশের আগে কে জয়ী হবেন, তা অনুমান করা যাচ্ছে না।
ক্যালিফোর্নিয়ার সংগ্রামী নারী নেত্রী কমলা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে মার্কিন মুল্লুকের অন্যতম সেরা ধনকুবের, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছেই নয়; যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত বিশ্ব আর বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায় এবারের আমেরিকান নির্বাচন বিশ্বের কাছেও তাৎপর্যপূর্ণ। এবারের নির্বাচনে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট পাবে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে এবার ভোটার সংখ্যা ২৪ কোটি ৪০ লাখ। আগাম ভোট দিয়েছেন ৭ কোটি ৭০ লাখ ভোটার।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পদ্ধতি বেশ জটিল। পপুলার ভোটে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। ৫০টি অঙ্গরাজ্য এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি মিলে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। নির্বাচনে জয়ী হতে হলে ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট প্রয়োজন। একেক রাজ্যে একেক সংখ্যায় ইলেকটোরাল কলেজ ভোট আছে। যে রাজ্যে যে দল জয়ী হয়, সেই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট সেই দল পেয়ে যায়। অর্থাৎ উইনার্স গেট অল। এভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে থাকা অঙ্গরাজ্যগুলোর সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ডেমোক্রেটিক পার্টি পেয়ে যায় এবং রিপাবলিকান পার্টির আধিপত্যে থাকা অঙ্গরাজ্যগুলোর ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পায় রিপাবলিকান দল। কিন্তু কিছু কিছু রাজ্য আছে ‘সুইং স্টেট’।
এর মানে হলো, দোদুল্যমান রাজ্যগুলোয় কখনো ডেমোক্র্যাট আবার কখনো রিপাবলিকানরা জয়ী হন। এগুলোকে বলা হয় মূল যুদ্ধক্ষেত্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মানে হলো সুইং স্টেটগুলো দখলের নির্বাচন। কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ে এমন সাতটি রাজ্যে প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন প্রায় পুরোটা সময়। ছোট রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট সিস্টেম বলে মনে করা হয়।
এবারের নির্বাচনে সাতটি সুইং স্টেটে মূল প্রতিদ্বনি›দ্বতা হচ্ছে। এসব সুইং স্টেটের মধ্যে উইসকনসিনে ১০টি, পেনসেলভিনিয়ায় ১৯টি, আরিজোনায় ১১টি, জর্জিয়ায় ১৬টি, মিশিগানে ১৫টি, নেভাদায় ৬টি এবং নর্থ ক্যারেলিনায় ১৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসির জন্য ইলেকটোরাল কলেজ ভোট তিনটি।
এবারের নির্বাচনে সাতটি সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য চ‚ড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গুরুত্বপ‚র্ণ এসব অঙ্গরাজ্যের ৯৩টি ইলেক্টোরাল কলেজগুলোর মধ্যে পেনসিলভানিয়া ১৯টি, নর্থ ক্যারোলিনার ১৬টি, জর্জিয়ার ১৬টি, মিশিগানের ১৫টি, অ্যারিজোনার ১১টি, উইসকনসিনের ১০টি ও নেভাদার ৬টি। নির্বাচনে জিততে হলে একজন প্রার্থীকে মোট ৫৩৮ ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি পেতে হবে।
নির্বাচনে কোনো প্রার্থীই যদি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পান, অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী যদি ২৬৯/২৬৯ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পান, সে ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ ‘প্রতিনিধি পরিষদ’ ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এ পদ্ধতি ‘কন্টিনজেন্ট ইলেকশন’ নামে পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। তবে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হলো বর্ণবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সাদা-কালোয় কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু বাস্তবে বছরের পর বছর এ বর্ণবাদী প্রথা ভোটের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট ভোটারের প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ। শ্বেতাঙ্গরা রিপাবলিকান তথা ট্রাম্পের সমর্থক। কারণ, তাদের বেশির ভাগ ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’তে বিশ্বাসী।
বলা হয়ে থাকে, শ্বেতাঙ্গরা সবাই ভোট দিতে গেলে রিপাবলিকান প্রার্থী কখনো হারবেন না। বাস্তবে সব শ্বেতাঙ্গ ভোট দিতে যান না। এদিক বিবেচনায় নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি। তবে কমলা হ্যারিসের মূল ভোট ব্যাংক নারী ভোটার। নারীরা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। কমলা হ্যারিস নারীদের গর্ভপাত বৈধ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এতে নারীরা উচ্ছ্বসিত। নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশি হলে নাটকীয়ভাবে কমলা হ্যারিস জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ট্রাম্প মনে করেন, নারীদের গর্ভপাতের কোনো অধিকার নেই। খ্রিষ্টান ধর্মে গর্ভপাতের সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা তাই সাধারণত ট্রাম্পকে ভোট দেন না। তারা শুধু গর্ভপাতকে অধিকার হিসাবেই দেখছেন না। বরং গর্ভপাত নারী স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী বলে তারা মনে করছেন। কমলা হ্যারিসের প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের কল্যাণের দিক বেশি ছিল। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে তিনি অনেক কিছু প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটের সংখ্যা ১৩ শতাংশ। তারা সাধারণত ডেমোক্রেটিক দলের ভোটার। আফ্রিকান আমেরিকান ভোটাররা বারাক ওবামার ভক্ত। এবার বারাক ওবামা ভোটের প্রচারে সারাক্ষণ কমলা হ্যারিসের পক্ষে সরব ছিলেন। ফলে কৃষ্ণাঙ্গ ভোট কমলা বেশি পাবেন। অবশিষ্ট ১০ শতাংশের বেশি ভোটার হলেন হিস্পানিক, এশীয় এবং অবশিষ্ট বিশ্বের অভিবাসী। মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের হিস্পানিক ভোটাররা সাধারণত ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে ভোট দিয়ে থাকেন। তবে অর্থনীতির দুরবস্থার কারণে হতাশাগ্রস্ত যুবকরা ট্রাম্পকে পছন্দ করছেন। কারণ তারা মনে করছেন, ট্রাম্প নিজে একজন ব্যবসায়ী হওয়ায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতি চাঙা করার জন্য কাজ করবেন। ফলে একটা শ্রেণি কর্মসংস্থানের আশায় ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারে।
এবারের নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান ভোটারের সংখ্যা ২৬ লাখ। তাদের বেশির ভাগ কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, কমলা হ্যারিস ভারতীয় মায়ের সন্তান। কমলার মা ক্যালিফোর্নিয়ায় তাকে বড় করেছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের ভোট পেতে অস্কার বিজয়ী এআর রাহমানকে দিয়ে প্রচারের গান বানিয়েছেন কমলা। শেষদিকে ট্রাম্প ভারতীয় ভোটারদের ভোটে ভাগ বসাতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ করেন।হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে উগগ্রপন্থিদের ভোট ট্রাম্প পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গাজায় ইসরাইলী হামলার বিরুদ্ধে ছিলেন। ওই আন্দোলন বল প্রয়োগ করে দমন করা হয়েছে। ছাত্ররা ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থক হলেও অনেকে ভোট দিতে যাবেন না। ভোট দিতে না গেলে ট্রাম্প এর সুবিধা পাবেন। গ্রামাঞ্চলে ট্রাম্প বেশি ভোট পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপরদিকে শহরাঞ্চলে বেশি ভোট কমলা পাবেন বলে ধরা হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় ভোটের ফলাফল আগেভাগে আঁচ করা যাচ্ছে না।
ডেমোক্রেটরা সাধারণত মানবাধিকার, নীতি-নৈতিকতা, কল্যাণমূলক কাজ বেশি করে থাকেন। এজন্য সুশীল সমাজ ও এলিট শ্রেণির সমর্থন কমলার পক্ষে। তবে ডেমোক্রেটিক আমলে বিশ্বে যুদ্ধবিগ্রহ বেশি হয়। বিশেষ করে গাজায় হামলার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসন মুখে মুখে বিরোধিতা করলেও বিপুল বরাদ্দ দিয়েছেন। অপরদিকে ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী হওয়ায় তার অগ্রাধিকার ব্যবসা-বাণিজ্য।
এ কারণে বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও করপোরেট হাউজ ট্রাম্পকে সমর্থন করছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে একাই ৭৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছেন। উভয় পক্ষ বিভিন্ন পর্যায়ের তারকাকে ভোটের প্রচারে নামিয়েছেন।