হককথা ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৩ নভেম্বর। এরইমধ্যে জমে উঠেছে নির্বাচনের মাঠ। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলে আদালত চত্বরেই কাটবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিন। বহু মামলায় নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য আদালতপাড়ার এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে জুতোর তলা ক্ষয়ে যাবে আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে একরোখা এই প্রেসিডেন্টের। কারণ, সব কিছুতেই গোঁয়ার্তুমি আর চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ২৬টি নারী কেলেংকারি মামলা, ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল না করা, আর্থিক প্রতারণাসহ অনেক দুর্নীতির মামলায় ভারি হয়ে উঠেছে আদালত। আছে নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে ব্যবহার করার মতো কয়েকটি অভিযোগও। এসব মামলা বর্তমানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বলে আটকে রেখেছেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনে হেরে গেলে যখন আর প্রেসিডেন্ট থাকবেন না, তখন নতুন করে ফণা তুলবে এসব মামলা। প্রেসিডেন্ট বলে ভয়ে আর হাত গুটিয়ে থাকবে না বাদীরাও। রোববার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আশু বিপদের এ অশনি সংকেত সামনে আনল সিএনএন। একেবারে অলৌকিক কিছু না ঘটলে এবারের এ নির্বাচনে কপাল পুড়তে পারে ট্রাম্পের। সে পূর্বাভাসই দিচ্ছে আামেরিকান নির্বাচনের ভোটধামাকা জরিপ।
জনমত জরিপগুলো বলছে, এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সব জরিপেই ট্রাম্পের চেয়ে গড়ে অন্তত নয় পয়েন্ট এগিয়ে আছেন বাইডেন। সুতরাং পরাজয় নিশ্চিত। আর এমন হলে ঝিমিয়ে পড়া মামলাগুলো সব দল বেঁধে ঝাপিয়ে পড়বে ট্রাম্পের ঘাড়ে। শান্তিতে ঘরেও থাকতে পারবেন না, আবার দেশও ছাড়তে পারবেন না।
আদালত চত্বরগুলোই হবে তার সারাদিনের সঙ্গী। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির অভিযোগে অন্তত ২৬টি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন সময় ওইসব নারীকে হয়রানি করেছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। এসব নারীর মধ্যে আছেন সাবেক ম্যাগাজিন কলামিস্ট ই জিন ক্যারোল। তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন।
ট্যাক্স রিটার্ন জমা না দেয়া ও কর ফাঁকির অভিযোগের মতো মামলাগুলো ‘প্রেসিডেন্টের দায়মুক্তি ও প্রেসিডেন্ট কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়’- সংবিধানের এসব ধারা কাজে লাগিয়ে থামিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প।
বিভিন্ন জরিপ বলছে, জনসমর্থনের দিক থেকে বাইডেন ১১ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন ট্রাম্পের চেয়ে। বাইডেনের প্রচার ব্যবস্থাপক অবশ্য বলছেন, ব্যবধানটা দুই অঙ্কের নয়, বরং অঙ্কটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। জনসমর্থনের প্রকৃত ব্যবধান যেমনই হোক, কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নন রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প। ভোটারদের মন জয় করার জন্য তিনি পুরনো কার্ড খেলতে শুরু করেছেন। দেশের শাসনব্যবস্থা আর অভিবাসী ইস্যু নিয়ে অতিকথন করছেন তিনি, যেটা তিনি ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারকালেও করেছেন।
অন্যদিকে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির মতো অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে বাদীরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে লড়াই করার মতো সাহস না রাখলেও ক্ষমতা হারিয়ে যখন সাধারণ নাগরিকের হবেন, তখন তারা বসে থাকবেন না বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। বেশির ভাগ সাধারণ অভিযোগকারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এমন দিনেরই অপেক্ষা করছেন।
ম্যানহ্যাটনের সাবেক ফেডারেল প্রসিকিউটর হ্যারি স্যান্ডিক বলেন, আদালত তাকে তলবের অধিকার রাখে না বলে বর্তমানে দাবি করে থাকেন ট্রাম্প। কিন্তু ক্ষমতার মেয়াদ শেষে সে পরিস্থিতি থাকছে না। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান এরিক সোয়ালওয়েল পরামর্শ দিয়েছেন, প্রেসিডেন্সিয়াল ক্রাইম কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে ট্রাম্পের অনিয়ম, অপরাধ ও তার মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য। এরিক বলেন, ‘আমি এটি হালকাভাবে বলছি না।
হয়তো এসব হিসাব-নিকেশ থেকেই হেরে গেলে দেশ ছাড়তে হবে বলে নিজের সম্পর্কে এখন থেকেই ব্যঙ্গ উক্তি শুরু করেছেন ট্রাম্প। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ম্যাকোনে নির্বাচনী প্রচারণায় উল্লসিত সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প জোকস করে বলেন, নির্বাচনে হেরে গেলে তাকে দেশ ছেড়ে যেতে হতে পারে।
নির্বাচনী সভায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্র রসাতলে যাবে, ভেসে যাবে অভিবাসীর বন্যায়, এমন ধুয়া তুলে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভোটারদের মন জয়ের লক্ষ্যে তিনি প্রতিদ্ব›দ্বী জো বাইডেনের গোটা পরিবারকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করতেও ছাড়ছেন না। সর্বশেষ জর্জিয়া ও ফ্লোরিডায় নির্বাচনী সমাবেশে গিয়ে ট্রাম্প যাচ্ছে-তাই ভাষায় বাইডেন ও তাঁর দলের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি নির্বাচনের আগের শেষ দুই সপ্তাহে ভোটার টানার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওকালায় গত ১৬ অক্টোবর শুক্রবার সমাবেশে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি প্রতিদ্ব›দ্বীকে আক্রমণ করে বলেন, ‘বাইডেন পরিবার হলো অপরাধের আঁতুড়ঘর।’ ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোটারদের উসকে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। তারা আমেরিকাকে কমিউনিস্ট দেশ বানাতে চায়।’
এ ছাড়া জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ম্যাকোনে গিয়ে ডেমোক্র্যাটবিরোধিতা চাঙ্গা করার জন্য ট্রাম্প বলেন, ‘এই পয়সাওয়ালা উদারপন্থী ভক্তদের উদ্দেশে আমাদের বার্তা দেওয়ার এখনই সময়।’ অভিবাসীবিরোধিতা উসকে দিতে তিনি আরো বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে আপনাদের স¤প্রদায়গুলো অবৈধ এলিয়েন, মাদক আর অপরাধের বন্যায় ভেসে যাবে।’
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে যদি তিনি হেরে যান তাহলে সেখানকার গভর্নর রন ডিস্যান্টিসকে বরখাস্ত করা হবে বলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প সতর্ক করেছেন। শুক্রবার এক নির্বাচনী সমাবেশের সময় ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফ্লোরিডার গভর্নরকে বলেন, রন, আমরা এই অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী হতে যাচ্ছি তো? ট্রাম্প বলেন, আপনারা জানেন আমরা যদি বিজয়ী না হই তাহলে এর দায় কিন্তু গভর্নরের। যেভাবেই হোক আমি তাকে বরখাস্ত করব।
বাইডেনের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ট্রাম্প বলেন, ‘প্রেসিডেনশিয়াল রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার বিষয়টি আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আমি যদি হেরে যাই, কী হবে ভাবতে পারেন?’ চেহারায় হতাশা ফুটিয়ে তুলে তিনি বলেন, ‘তখন কী করব আমি? আমার তো মোটেই ভালো লাগবে না। আমাকে বোধ হয় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি জানি না।’
ট্রাম্পের এসব অতিকথনের বিপরীতে বাইডেন হাতিয়ার করেন মহামারি পরিস্থিতিকে। মিশিগান অঙ্গরাজ্যের সাউথফিল্ডে গিয়ে গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘উনি আমাদের বলেই যাচ্ছেন, ভাইরাস অলৌকিকভাবে গায়েব হয়ে যাবে। এটা কিন্তু যাবে না। বাস্তবতা হলো ওটা আবার বাড়ছে, পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।’ কট্টর ডানপন্থী ও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সমালোচনা করার অনীহা পুঁজি করে বাইডেন বলেন, মাঝেমধ্যে ট্রাম্প যেসব মন্তব্য করেন, সেগুলো কট্টরপন্থীদের কান পর্যন্ত পৌঁছেই না।
অপরদিকে ডেট্রয়েটের সমাবেশে যোগ দিয়ে বাইডেন বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প কী, তা সবাই জানে। এবার দেখিয়ে দিন, আমরা কী?’
বাইডেনের তহবিলে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ: নির্বাচনী তহবিলে মাসিক জমার ক্ষেত্রে নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন বাইডেন। গত সেপ্টেম্বরে তাঁর তহবিলে জমা পড়ে ৩৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর সঙ্গে রয়েছে অনলাইন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে পাওয়া আরো ২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে অঙ্কটি ৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত আগস্টে বাইডেনের তহবিলে জমা হয়েছিল ৩৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
এদিকে ট্রাম্প শিবির জানিয়েছে, তাদের তহবিলে জমা পড়েছে ২৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর আগে নির্বাচনী তহবিলে সর্বোচ্চ জমার রেকর্ড ছিল আরেক ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামার ঘরে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রায় ২০ কোটি ডলার পেয়েছিলেন তিনি।