নিউইয়র্ক ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : করোনায় অন্য রকম ভোট

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৫২:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর ২০২০
  • / ১০৭ বার পঠিত

তামান্না মিনহাজ: খামখেয়ালির ডোনাল্ড ট্রাম্প, নাকি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ জো বাইডেন- এই দ্বৈরথের মীমাংসায় আজ মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহন। করোনাভাইরাসের কারণে প্রত্যাশা ছাপিয়ে পড়া আগাম ভোটের বন্যায় ৫৯তম নির্বাচনে কে জয়ী হতে চলেছেন, তা হয়তো আজই জানা যাবে না। তবে পরাজিত হলে ফল মেনে নেবেন না বলে ট্রাম্পের হুমকি, তাঁর ভোট জালিয়াতি শঙ্কা, সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার আহবানে ফলের অপেক্ষা কতটা দীর্ঘায়িত হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ধরনটাই পাল্টে গেছে। ঐতিহ্য-রীতি আর কেতায় মোড়ানো এই নির্বাচনের চেহারা মূলত উৎসবের। কিন্তু এবার সে জায়গা দখল করেছে আতঙ্ক। করোনাভাইরাসের তীব্র আক্রমণ এবার যুক্তরাষ্ট্রে আলাদা করেই অনুভূত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক মানুষ মারা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই। মানুষের মধ্যে এর প্রভাব কতটা তীব্র তা সবচেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় আগাম ভোটের সংখ্যায়। প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মানুষ এরই মধ্যে ডাকযোগে বা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে ফেলেছেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতি, অস্ত্রনীতি, সমরনীতি বা পররাষ্ট্রনীতিকে পেছনে ফেলে এবার নির্বাচনী প্রচারের একেবারে কেন্দ্রে চলে এসেছে কভিড-১৯। নানা জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেন (৭৭) যে এগিয়ে আছেন, তা মূলত করোনার সৌজন্যেই। জাতীয়ভাবে দুই অঙ্কের সংখ্যায় শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন বাইডেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জাতীয়ভাবে হয় না, এই নির্বাচন অঙ্গরাজ্যভিত্তিক। রাজ্য জয় মানেই রাষ্ট্র জয়। সংবিধানে ইলেকটোরাল ভোটের বিধান এমনভাবে রাখা হয়েছে যে জয়ী প্রার্থী বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যে জয় না পেলে জাতীয়ভাবে জিততে পারবেন না। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতবার ৩০ লাখ ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকেও এই ইলেক্টোরাল ভোটের মারপ্যাঁচেই (মোট ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেতে হয়) হোয়াইট হাউসে ঢোকার সুযোগ পান।
ট্রাম্প এবারও একই হিসাব কষে এগোচ্ছেন। বস্তুত ধনকুবের আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনীতিতে পা দেওয়ার পর থেকে কখনোই লাইনচ্যুত হননি। খুব ভালো করে চিনে নিয়েছেন নিজ সমর্থকগোষ্ঠীকে। কাজ করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। তাঁর দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির এত বাড়বাড়ন্ত আগে কখনোই ছিল না। নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াননি। উল্টো সেনা সরানোর পরিকল্পনা করছেন আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে। সরে এসেছেন সিরিয়া যুদ্ধ থেকেও। যদিও তিনি নিজে যা-ই দাবি করুন না কেন, গত চার বছরে বহির্বিশ্বে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পরমাণুচুক্তি থেকে এককভাবে প্রত্যাহার বা প্যারিস জলবায়ুচুক্তি ছেড়ে আসা মিত্র রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়িয়েছে।
তবে নির্বাচন ইস্যুতে একবগগা ট্রাম্প কখনোই পথ হারাননি। সুস্পষ্ট পরিকল্পনা সঙ্গী করেই তিনি গত বছরের শেষ দিক থেকে নির্বাচনে জালিয়াতি করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হবে বলে অভিযোগ তোলেন। তাঁর দাবি, বর্তমানে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে গলদ আছে। ওই গলদের সুযোগ নিয়েই তাঁকে পরাজিত করা হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই একই অবস্থায় বিরাজমান।
গত মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ডাকযোগে ভোট বাড়তে থাকলে ট্রাম্পের এই অভিযোগ আরো জোরালো হয়। তিনি দাবি করেন, ডাকযোগে ভোটের কারণে একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। গত রোববার (১ নভেম্বর) পাঁচটি দোদুল্যমান রাজ্যে প্রচার চালানোর সময় ট্রাম্প আবারও একই কথা বলেন, পরাজিত হলে তিনি ফল মেনে নেবেন না। সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার নির্দেশও দেন।
গত মাসে করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পর ঘূর্ণিগতিতে প্রচার চালাচ্ছেন ট্রাম্প। সোমবারও পাঁচটি রাজ্যে সমাবেশ করেন তিনি। করোনায় ঘরে বন্দি হয়ে পড়া বা জরিপে পিছিয়ে থাকা- ক্ষতি যেটুকু হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট। পুনর্র্নিবাচনের সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের রীতি অনুসারে, এক ব্যক্তি দুবারই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। মূলত আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই আইন করা হয়েছে। ওয়াশিংটন দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তৃতীয়বার নিজে থেকেই আর প্রার্থী হননি। সেই দিক থেকে দেখলে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার নির্বাচিত হলে তিনিও চলে যাবেন বুশ, ওবামাদের দলে।
নির্বাচনের আগে শেষ তিন দিনে ১৪টি জনসভা করে ট্রাম্প তাঁর ভোটারদের একটি বার্তাই দিয়েছেন, ২০১৬ সালের মতো এবারও বড় জয় পেতে যাচ্ছেন তিনি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত জনমত জরিপগুলো ধাপ্পাবাজি। তাঁর জনসভাগুলোই তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ। ট্রাম্পের দাবি, তাঁর দেশে কভিড পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। মহামারির কথা গালগল্প। অর্থলোভী চিকিৎসকদের ছড়ানো।
বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রধান অ্যান্থনি ফাউচির সঙ্গে তাঁর বিরোধ সুপরিচিত। নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে সেই বিরোধ চরমে ওঠে। ওয়াশিংটন পোস্টকে গত শনিবার (৩১ অক্টোবর) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাউচি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন না আনলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এ নিয়ে রবিবার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় হোয়াইট হাউস। ওই দিনই এক সমাবেশে আগামীবার নির্বাচিত হলে ফাউচিকে বরখাস্ত করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প।
নির্বাচন ঘিরে অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনার শেষ নেই। আজ মঙ্গলবার রাতেই হোয়াইট হাউসে ৪০০ অতিথির উপস্থিতিতে একটি পার্টির আয়োজন করেছেন তিনি। গণমাধ্যমের খবর, এই পার্টিতেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করবেন ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্প পার্টির কথা স্বীকার করলেও জয়ের কথা ঘোষণার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই পার্টি শুরুতে ট্রাম্প টাওয়ারে আয়োজনের কথা ছিল। পরে গভর্নর ৫০ জনের বেশি ব্যক্তি সমবেত হওয়া নিয়ে বাদ সাধলে পার্টি সরিয়ে হোয়াইট হাউসের ইস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আয়োজিত প্রায় একই ধরনের পার্টির পর হোয়াইট হাউসের অন্তত ৩০ কর্মকর্তা আক্রান্ত হন।
এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সহিংসতার আশঙ্কায় বহু রাজ্যের সব দোকানপাট বন্ধ। একই আশঙ্কায় গত মাস থেকেই নিত্যপণ্য কেনা বাড়িয়েছে মানুষ। খালি হচ্ছে দোকান। গত মাসের শেষ দিক থেকেই টয়লেট পেপারের ঘাটতি নিয়ে আবারও শোরগোল শোনা যাচ্ছে। বেড়েছে অস্ত্র কেনার হারও। জানা গেছে, গত কয়েক মাসে প্রায় তিন কোটি আগ্নেয়াস্ত্র বেচা হয়েছে, যা যেকোনো বছরের একই সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
পরিস্থিতির কারণে নিউইয়র্কসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বেশির ভাগ রাজ্যেই পুলিশ মোতায়েনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। স্পষ্টতই নির্বাচনের স্বাভাবিক স্বস্তির জায়গা দখল করে নিয়েছে আতঙ্ক।
প্রেসিডেন্টের প্রমাণ ছাড়াই বারবার হুমকি দেওয়ার বিষয়টিকে বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কিভাবে দেখছে? তাদের ভাবনাটা হলো, ‘তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই জালিয়াতি করবেন?’ দলে এমন আলোচনা থাকলেও বাইডেন নিজে অবশ্য এখুনি এমন কিছু বলতে চান না। এই ধীরস্থির প্রবীণ রাজনীতিকের এবারের ভোটের লড়াইয়ে প্রধান অস্ত্রই করোনাভাইরাস। পুরো প্রচার-প্রচারণায়ও তিনি এর থেকে বাইরে যাননি। ভাইরাস বাধ্যবাধকতায় প্রচারও সীমিত রেখেছেন। বড় জনসভা করেননি, মাস্ক খুলেছেন খুব কম, বিজ্ঞাপন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে চালিয়েছেন প্রচার। আর সাহায্য নিয়েছেন তাঁর সাবেক বস বারাক ওবামার। গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রচার চালিয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মানুষটি। তাঁর প্রচারের ধরন সম্পর্কে আমেরিকান গণমাধ্যমের বক্তব্য, ‘এত যুক্তিপূর্ণ ও সুন্দর করে আর কেউ ট্রাম্পের সমালোচনা করতে পারেননি।’
গতকাল সোমবার ও রোববার বাইডেন নিজেও অবশ্য একাধিক সমাবেশে অংশ নেন। দোদুল্যমান রাজ্য পেনসিলভানিয়ায় দেওয়া সমাপনী ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘আমাদের এই ভাইরাসকে পরাজিত করতে হবে। আর তার জন্যই সবার আগে হারাতে হবে ট্রাম্পকে। তিনিই এখন ভাইরাস হয়ে উঠেছেন।’ প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক বাইডেন দেশে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করার জন্য ভোটারদেও প্রতি আহবান জানান। গত ৪৭ বছর ধরে ওয়াশিংটনে রাজনীতি করছেন সাবেক এই ভাইস প্রেসিডেন্ট। ক্যারিসমেটিক না হলেও স্থিতধী বলে সুনাম রয়েছে তাঁর।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সব সময় নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পর মঙ্গলবার হয়। এ বছর সেই অগ্নিপরীক্ষার দিন আজ। বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী ১১ ঘণ্টা পিছিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হবে ভোটাভুটির পর্ব। সূত্র: দি ইনডিপেনডেন্ট, বিবিসি, এএফপি, সিএনএন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : করোনায় অন্য রকম ভোট

প্রকাশের সময় : ০১:৫২:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর ২০২০

তামান্না মিনহাজ: খামখেয়ালির ডোনাল্ড ট্রাম্প, নাকি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ জো বাইডেন- এই দ্বৈরথের মীমাংসায় আজ মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহন। করোনাভাইরাসের কারণে প্রত্যাশা ছাপিয়ে পড়া আগাম ভোটের বন্যায় ৫৯তম নির্বাচনে কে জয়ী হতে চলেছেন, তা হয়তো আজই জানা যাবে না। তবে পরাজিত হলে ফল মেনে নেবেন না বলে ট্রাম্পের হুমকি, তাঁর ভোট জালিয়াতি শঙ্কা, সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার আহবানে ফলের অপেক্ষা কতটা দীর্ঘায়িত হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ধরনটাই পাল্টে গেছে। ঐতিহ্য-রীতি আর কেতায় মোড়ানো এই নির্বাচনের চেহারা মূলত উৎসবের। কিন্তু এবার সে জায়গা দখল করেছে আতঙ্ক। করোনাভাইরাসের তীব্র আক্রমণ এবার যুক্তরাষ্ট্রে আলাদা করেই অনুভূত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক মানুষ মারা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই। মানুষের মধ্যে এর প্রভাব কতটা তীব্র তা সবচেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় আগাম ভোটের সংখ্যায়। প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মানুষ এরই মধ্যে ডাকযোগে বা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে ফেলেছেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতি, অস্ত্রনীতি, সমরনীতি বা পররাষ্ট্রনীতিকে পেছনে ফেলে এবার নির্বাচনী প্রচারের একেবারে কেন্দ্রে চলে এসেছে কভিড-১৯। নানা জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেন (৭৭) যে এগিয়ে আছেন, তা মূলত করোনার সৌজন্যেই। জাতীয়ভাবে দুই অঙ্কের সংখ্যায় শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন বাইডেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জাতীয়ভাবে হয় না, এই নির্বাচন অঙ্গরাজ্যভিত্তিক। রাজ্য জয় মানেই রাষ্ট্র জয়। সংবিধানে ইলেকটোরাল ভোটের বিধান এমনভাবে রাখা হয়েছে যে জয়ী প্রার্থী বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যে জয় না পেলে জাতীয়ভাবে জিততে পারবেন না। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতবার ৩০ লাখ ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকেও এই ইলেক্টোরাল ভোটের মারপ্যাঁচেই (মোট ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেতে হয়) হোয়াইট হাউসে ঢোকার সুযোগ পান।
ট্রাম্প এবারও একই হিসাব কষে এগোচ্ছেন। বস্তুত ধনকুবের আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনীতিতে পা দেওয়ার পর থেকে কখনোই লাইনচ্যুত হননি। খুব ভালো করে চিনে নিয়েছেন নিজ সমর্থকগোষ্ঠীকে। কাজ করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। তাঁর দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির এত বাড়বাড়ন্ত আগে কখনোই ছিল না। নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াননি। উল্টো সেনা সরানোর পরিকল্পনা করছেন আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে। সরে এসেছেন সিরিয়া যুদ্ধ থেকেও। যদিও তিনি নিজে যা-ই দাবি করুন না কেন, গত চার বছরে বহির্বিশ্বে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পরমাণুচুক্তি থেকে এককভাবে প্রত্যাহার বা প্যারিস জলবায়ুচুক্তি ছেড়ে আসা মিত্র রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়িয়েছে।
তবে নির্বাচন ইস্যুতে একবগগা ট্রাম্প কখনোই পথ হারাননি। সুস্পষ্ট পরিকল্পনা সঙ্গী করেই তিনি গত বছরের শেষ দিক থেকে নির্বাচনে জালিয়াতি করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হবে বলে অভিযোগ তোলেন। তাঁর দাবি, বর্তমানে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে গলদ আছে। ওই গলদের সুযোগ নিয়েই তাঁকে পরাজিত করা হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই একই অবস্থায় বিরাজমান।
গত মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ডাকযোগে ভোট বাড়তে থাকলে ট্রাম্পের এই অভিযোগ আরো জোরালো হয়। তিনি দাবি করেন, ডাকযোগে ভোটের কারণে একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। গত রোববার (১ নভেম্বর) পাঁচটি দোদুল্যমান রাজ্যে প্রচার চালানোর সময় ট্রাম্প আবারও একই কথা বলেন, পরাজিত হলে তিনি ফল মেনে নেবেন না। সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার নির্দেশও দেন।
গত মাসে করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পর ঘূর্ণিগতিতে প্রচার চালাচ্ছেন ট্রাম্প। সোমবারও পাঁচটি রাজ্যে সমাবেশ করেন তিনি। করোনায় ঘরে বন্দি হয়ে পড়া বা জরিপে পিছিয়ে থাকা- ক্ষতি যেটুকু হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট। পুনর্র্নিবাচনের সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের রীতি অনুসারে, এক ব্যক্তি দুবারই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। মূলত আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই আইন করা হয়েছে। ওয়াশিংটন দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তৃতীয়বার নিজে থেকেই আর প্রার্থী হননি। সেই দিক থেকে দেখলে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার নির্বাচিত হলে তিনিও চলে যাবেন বুশ, ওবামাদের দলে।
নির্বাচনের আগে শেষ তিন দিনে ১৪টি জনসভা করে ট্রাম্প তাঁর ভোটারদের একটি বার্তাই দিয়েছেন, ২০১৬ সালের মতো এবারও বড় জয় পেতে যাচ্ছেন তিনি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত জনমত জরিপগুলো ধাপ্পাবাজি। তাঁর জনসভাগুলোই তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ। ট্রাম্পের দাবি, তাঁর দেশে কভিড পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। মহামারির কথা গালগল্প। অর্থলোভী চিকিৎসকদের ছড়ানো।
বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রধান অ্যান্থনি ফাউচির সঙ্গে তাঁর বিরোধ সুপরিচিত। নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে সেই বিরোধ চরমে ওঠে। ওয়াশিংটন পোস্টকে গত শনিবার (৩১ অক্টোবর) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাউচি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন না আনলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এ নিয়ে রবিবার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় হোয়াইট হাউস। ওই দিনই এক সমাবেশে আগামীবার নির্বাচিত হলে ফাউচিকে বরখাস্ত করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প।
নির্বাচন ঘিরে অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনার শেষ নেই। আজ মঙ্গলবার রাতেই হোয়াইট হাউসে ৪০০ অতিথির উপস্থিতিতে একটি পার্টির আয়োজন করেছেন তিনি। গণমাধ্যমের খবর, এই পার্টিতেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করবেন ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্প পার্টির কথা স্বীকার করলেও জয়ের কথা ঘোষণার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই পার্টি শুরুতে ট্রাম্প টাওয়ারে আয়োজনের কথা ছিল। পরে গভর্নর ৫০ জনের বেশি ব্যক্তি সমবেত হওয়া নিয়ে বাদ সাধলে পার্টি সরিয়ে হোয়াইট হাউসের ইস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আয়োজিত প্রায় একই ধরনের পার্টির পর হোয়াইট হাউসের অন্তত ৩০ কর্মকর্তা আক্রান্ত হন।
এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সহিংসতার আশঙ্কায় বহু রাজ্যের সব দোকানপাট বন্ধ। একই আশঙ্কায় গত মাস থেকেই নিত্যপণ্য কেনা বাড়িয়েছে মানুষ। খালি হচ্ছে দোকান। গত মাসের শেষ দিক থেকেই টয়লেট পেপারের ঘাটতি নিয়ে আবারও শোরগোল শোনা যাচ্ছে। বেড়েছে অস্ত্র কেনার হারও। জানা গেছে, গত কয়েক মাসে প্রায় তিন কোটি আগ্নেয়াস্ত্র বেচা হয়েছে, যা যেকোনো বছরের একই সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
পরিস্থিতির কারণে নিউইয়র্কসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বেশির ভাগ রাজ্যেই পুলিশ মোতায়েনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। স্পষ্টতই নির্বাচনের স্বাভাবিক স্বস্তির জায়গা দখল করে নিয়েছে আতঙ্ক।
প্রেসিডেন্টের প্রমাণ ছাড়াই বারবার হুমকি দেওয়ার বিষয়টিকে বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কিভাবে দেখছে? তাদের ভাবনাটা হলো, ‘তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই জালিয়াতি করবেন?’ দলে এমন আলোচনা থাকলেও বাইডেন নিজে অবশ্য এখুনি এমন কিছু বলতে চান না। এই ধীরস্থির প্রবীণ রাজনীতিকের এবারের ভোটের লড়াইয়ে প্রধান অস্ত্রই করোনাভাইরাস। পুরো প্রচার-প্রচারণায়ও তিনি এর থেকে বাইরে যাননি। ভাইরাস বাধ্যবাধকতায় প্রচারও সীমিত রেখেছেন। বড় জনসভা করেননি, মাস্ক খুলেছেন খুব কম, বিজ্ঞাপন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে চালিয়েছেন প্রচার। আর সাহায্য নিয়েছেন তাঁর সাবেক বস বারাক ওবামার। গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রচার চালিয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মানুষটি। তাঁর প্রচারের ধরন সম্পর্কে আমেরিকান গণমাধ্যমের বক্তব্য, ‘এত যুক্তিপূর্ণ ও সুন্দর করে আর কেউ ট্রাম্পের সমালোচনা করতে পারেননি।’
গতকাল সোমবার ও রোববার বাইডেন নিজেও অবশ্য একাধিক সমাবেশে অংশ নেন। দোদুল্যমান রাজ্য পেনসিলভানিয়ায় দেওয়া সমাপনী ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘আমাদের এই ভাইরাসকে পরাজিত করতে হবে। আর তার জন্যই সবার আগে হারাতে হবে ট্রাম্পকে। তিনিই এখন ভাইরাস হয়ে উঠেছেন।’ প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক বাইডেন দেশে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করার জন্য ভোটারদেও প্রতি আহবান জানান। গত ৪৭ বছর ধরে ওয়াশিংটনে রাজনীতি করছেন সাবেক এই ভাইস প্রেসিডেন্ট। ক্যারিসমেটিক না হলেও স্থিতধী বলে সুনাম রয়েছে তাঁর।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সব সময় নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পর মঙ্গলবার হয়। এ বছর সেই অগ্নিপরীক্ষার দিন আজ। বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী ১১ ঘণ্টা পিছিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হবে ভোটাভুটির পর্ব। সূত্র: দি ইনডিপেনডেন্ট, বিবিসি, এএফপি, সিএনএন।