নিউইয়র্ক ০৭:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

হিলারির সম্ভাবনায় আওয়ামী লীগে অস্বস্তি!

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:৩১:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ নভেম্বর ২০১৬
  • / ৪৪১৭ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশ-প্রবাসে বাংলাদেশিরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। সবার মুখেই এবারের নির্বাচন। এর আগের কোনো নির্বাচনেই বাংলাদেশীদের মধ্যে এত উত্তেজনা, উদ্বেগ ও উৎসাহ দেখা যায়নি। রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন (অভিবাসন) নীতি ও মুসলিমবিরোধী অবস্থান বাংলাদেশিদের উদ্বিগ্ন করেছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা কোটি কোটি ইমিগ্র্যান্টকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে মুসলমান ও মেক্সিকানদের মাত্রাটা একটু বেশি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আওয়ামী লীগ-বিএনপির অতি উৎসাহ ও উত্তাপ কম ছড়ায়নি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ট্রাম্প ও হিলারি প্রশ্নে তিমিরের খেলায় নেমেছেন। ইমিগ্রেশন ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় তারা হিলারির শত ভাগ সমর্থক। কিন্তু হিলারি ক্লিন্টন পরিবার ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সম্পর্কের গভীরতায় আওয়ামী সমর্থকরা কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাথে ড. ইউনুসের শাপে নেইলে অবস্থান সর্বজন জ্ঞাত। স্বয়ং হিলারি ক্লিন্টন বিষয়টি অবহিত। ড. ইউনূসকে হয়রানি বন্ধ ও তার মর্যাদা রক্ষায় হিলারি ক্লিন্টনের দূতিয়ালি বাংলাদেশ আমলে নেয়নি। বিষয়টিতে ওবামা প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্টও নাখোশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৃত্তায়নে ড. ইউনুসের বড় শুভাকাঙক্ষী আজ বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি ও তার জোট। অবশ্য ড. ইউনূস বিএনপির রাজনীতির সাথে মোটেও সম্পৃক্ত নন। এ কথা অনস্বীকার্য, হিলারি ক্লিন্টন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অধিকতর ওয়াকিবহাল। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথেও তার সম্পর্ক খুবই গভীর। বাংলাদেশ সফরও করেছেন একাধিকবার। আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবার সাথেই তার সম্পর্ক। তবুও বিএনপির নেতাকর্মীরা অতিমাত্রায় উৎসাহী হিলারি প্রশ্নে। তাদের ধারণা, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসতে সহায়ক হবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অবশ্যই হিলারি প্রশাসন ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া ইউনুস ইস্যুও বিএনপির জন্য অনুকূলেই থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি দেশের প্রভাব সরাসরি বিস্তৃত। এক প্রতিবেশী ভারত। দুই যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের কাছে শেখ হাসিনা বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তারা বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকে মিত্র মনে করে এবং করবে। সেক্ষেত্রে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ভরসা যুক্তরাষ্ট্রই। যুুক্তরাষ্ট্রই পারে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে। তাদের বিশ্বাস, ভারত-আমেরিকার মধ্যস্থতায় একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হতে পারে। গুহার মুখে আলোর শিখায় উদ্ভাসিত হতে পারে বিএনপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, হিলারির বিজয় সম্ভাবনায় অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ জন সমর্থনের পাল্লায় সরকারি দল পিছিয়ে। এটা সর্বজন স্বীকৃত। তা বিশ্বাসও করেন আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে কথা বললেই সরকারি দলের মধ্যে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়। যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে তারা শংকিত। আওয়ামী লীগ অবশ্য এ সব স্বীকার করতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য সারাদেশে উন্নয়নের যে বন্যা বইছে, নির্বাচন হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই সরকার গঠন করবে। জনগণ তারই সাথে। আমেরিকায় নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ লেখককে আলাপচারিতায় বলেন, প্রধানত : ইমিগ্রেশন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষায় আমরা হিলারিকে সমর্থন দিয়েছি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পলিসি হচ্ছে আমেরিকানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবেই হিলারির প্রতি সমর্থন দিয়েছে এবং তার জন্য কাজ করছে। ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনার সরকারের তিক্ত সম্পর্কের কথা সবাই জানেন। অন্যদিকে ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হিলারি ক্লিন্টনের ঘনিষ্ঠ ও পারিবারিক বন্ধু।
হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে শেখ হাসিনার সরকার কোন চাপে পড়বে কি না জানাতে চাইলে আকতার হোসেন বলেন, দু- দেশের সম্পর্ক অনেক দৃঢ়। ব্যক্তি সম্পর্ক সেখানে মুখ্য হতে পারে না। মনে রাখবেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সরকার পরিচালিত হয় তাদের নীতির ওপর ভিত্তি করে। কে প্রেসিডেন্ট হলেন বড় কথা নয়। বাংলাদেশে জঙ্গি ও উগ্রবাদ দমনে শেখ হাসিনার সরকার এক নম্বর। জঙ্গিবাদ ও উগ্র মৌলবাদ আমেরিকার প্রধান শত্রু। আমি মনে করি, হিলারি ও শেখ হাসিনার সরকার অভিন্ন শত্রু মোকাবেলায় হাতে হাত রেখে কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রহিম বাদশা বলেন, ভারতের নির্বাচনের সময় বিএনপি বিজেপিকে নিয়ে অতি উৎসাহে বাড়াবাড়ি করেছিল। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের নীতির পরিবর্তন করেনি। বরং ভারতের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। হিলারিকে নিয়ে এখানেও বিএনপি অতিরঞ্জিত করছে। ইমিগ্রেশন প্রশ্নে আমরাও হিলারিকে সমর্থন দিয়েছি। হিলারি জিতলে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। তখন বিএনপির মুখ পুড়বে ভারতের মতোই।
হিলারি প্রশ্নে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস আহমেদ বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে বিভক্ত করে ফেলছে। ধর্মীয় ফ্যানাটিজমকে উসকে দিচ্ছে। এন্টি মুসলিম ককাস গঠন করছে। আমি দু-দুবার রিপাবলিকান দলের হয়ে স্টেটে নির্বাচন করেছি। কিন্তু এবার ইমিগ্রেশন ইস্যু ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্নে হিলারির সমর্থনে মাঠে নেমেছি। দলগতভাবে বিএনপি কি হিলারি প্রশ্নে অতিমাত্রায় উৎসাহী? এ প্রশ্নে গিয়াস বলেন, বাংলাদেশে একদলীয় ও অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। আমি মনে করি, হিলারি কিংবা ট্রাম যিনিই ক্ষমতায় আসুন তারা অগণতান্ত্রিক হাসিনার সরকারকে সমর্থন করবেন না। বরং অবাধ নির্বাচনে ও একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান লেখককে বলেন, হিলারির প্রশ্নে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি সবাই একমত। প্রবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই আমরা একমত। ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই আমরা হিলারিকে ভোট দিচ্ছি। তবে জিল্লুর প্রত্যাশা করেন, হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবেন। তিনি বলেন, হিলারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দেশের আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠা, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিশ্চয়ই হিলারির প্রশাসন একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেবেন।
বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী হিলারির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা দেশ ও প্রবাস উভয় স্থানেই সক্রিয়। তারা অর্থ সংগ্রহ করে ট্রাম্পের নির্বাচনী তহবিলেও জমা দিচ্ছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী ভূমিকাকে তারা স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন, ট্রাম্পের ‘ইমিগ্রেশন’ হাতিয়ার আঘাত হানলে তা সবার ওপর পড়বে। একজন বাংলাদেশী বিজন সরকার ‘অনলাইন’ পোর্টালে লিখেছেন, হিলারির রাজনৈতিক দর্শন কেবল আমেরিকার জনগণের নয়, বাংলাদেশের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়। অভিযোগ করছেন, জামায়াত-বিএনপি হিলারিকে অর্থ জোগান দিচ্ছে। যেমনটি দিয়েছিল ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জিকে।
আমেরিকায় এবারের নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছে। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি কিংবা জামায়াত সেটি মুখ্য নয়। সবাই একট্টা। কমিউনিটির ক্ষুদ্র একটি অংশের কথা আলাদা। তবে প্রবাসে হিন্দি ভাষায় টিভি চ্যানেলে ট্রাম্পের সমর্থনে বিজ্ঞাপন দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এটা মনে রাখা উচিত ‘ইমিগ্যান্ট’ বিরোধী বোমাটি ফাটলে কে মুসলিম কে হিন্দু ও কে খ্রিস্টান বাছাই করে পড়বে না। আঘাত এলে সবার ওপরেই পড়বে। ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন পলিসি’র প্রতিবাদেই সব অভিবাসীর উচিত হিলারির পক্ষে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া। আগামী ৮ নভেম্বর নির্বাচন। দলমত নির্বিশেষে, জাতি, সম্প্রদায় ও বর্ণ ভুলে সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যরে আমেরিকার প্রত্যাশায় ভোট কেন্দ্রে যেতেই হবে।
এদিকে সর্বশেষ জনমত জরিপে (৩১ অক্টোবর, ২০১৬) জাতীয় পর্যায়ে হিলারি শতকরা এক ভাগ (৪৫%-৪৪) ভোটে এগিয়ে আছেন। এটা হচ্ছে দেশব্যাপী পপুলার ভোটের জরিপ। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেকটরাল ভোটে, পপুলার ভোটে নন। যেমনটি ২০০০ সালের ভোটে আল গোর মিলিয়ন পরিমাণ পপুলার ভোটে এগিয়ে থেকেও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। জয়ের মালা পড়েছিলেন জর্জ বুশ। তা ইলেকটরাল ভোটের ভিত্তিতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে প্রয়োজন ২৭০ ইলেকটরাল ভোট। হিলারির ইলেকটরাল ভোট ২৬৩। আর ট্রাম্পের ভোট ১৬৪।
ব্যাটলগ্রাউন্ড : সুইং স্টেট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ১১টি। এ স্টেটগুলো হচ্ছে- ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, নিউহ্যাম্পশায়ার, ওয়াহিও, নেভাদা, ভারজিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, কলারাডো, আইওয়া, উইসকনসিন ও মিশিগান। এই ১১টি স্টেটের মধ্যে জনমত জরিপে ট্রাম্প শুধু আইওয়া এবং ওয়াহিও স্টেটে এগিয়ে আছেন। বাকি ৯টি স্টেটেই হিলারি এগিয়ে। এর মধ্যে ভারজেনিয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, প্যানসিলভানিয়ায় হিলারির বিজয় নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে বাকি থাকে পাঁচটি স্টেট। এই পাঁচটিতে হিলারি ১.৫% ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু একটিতে জিতলেই হিলারি প্রেসিডেন্ট। আর ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হতে হলে ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটের এই পাঁচটিতেই জিততে হবে।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

হিলারির সম্ভাবনায় আওয়ামী লীগে অস্বস্তি!

প্রকাশের সময় : ০৮:৩১:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ নভেম্বর ২০১৬

নিউইয়র্ক: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশ-প্রবাসে বাংলাদেশিরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। সবার মুখেই এবারের নির্বাচন। এর আগের কোনো নির্বাচনেই বাংলাদেশীদের মধ্যে এত উত্তেজনা, উদ্বেগ ও উৎসাহ দেখা যায়নি। রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন (অভিবাসন) নীতি ও মুসলিমবিরোধী অবস্থান বাংলাদেশিদের উদ্বিগ্ন করেছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা কোটি কোটি ইমিগ্র্যান্টকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে মুসলমান ও মেক্সিকানদের মাত্রাটা একটু বেশি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আওয়ামী লীগ-বিএনপির অতি উৎসাহ ও উত্তাপ কম ছড়ায়নি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ট্রাম্প ও হিলারি প্রশ্নে তিমিরের খেলায় নেমেছেন। ইমিগ্রেশন ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় তারা হিলারির শত ভাগ সমর্থক। কিন্তু হিলারি ক্লিন্টন পরিবার ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সম্পর্কের গভীরতায় আওয়ামী সমর্থকরা কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাথে ড. ইউনুসের শাপে নেইলে অবস্থান সর্বজন জ্ঞাত। স্বয়ং হিলারি ক্লিন্টন বিষয়টি অবহিত। ড. ইউনূসকে হয়রানি বন্ধ ও তার মর্যাদা রক্ষায় হিলারি ক্লিন্টনের দূতিয়ালি বাংলাদেশ আমলে নেয়নি। বিষয়টিতে ওবামা প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্টও নাখোশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৃত্তায়নে ড. ইউনুসের বড় শুভাকাঙক্ষী আজ বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি ও তার জোট। অবশ্য ড. ইউনূস বিএনপির রাজনীতির সাথে মোটেও সম্পৃক্ত নন। এ কথা অনস্বীকার্য, হিলারি ক্লিন্টন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অধিকতর ওয়াকিবহাল। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথেও তার সম্পর্ক খুবই গভীর। বাংলাদেশ সফরও করেছেন একাধিকবার। আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবার সাথেই তার সম্পর্ক। তবুও বিএনপির নেতাকর্মীরা অতিমাত্রায় উৎসাহী হিলারি প্রশ্নে। তাদের ধারণা, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসতে সহায়ক হবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অবশ্যই হিলারি প্রশাসন ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া ইউনুস ইস্যুও বিএনপির জন্য অনুকূলেই থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি দেশের প্রভাব সরাসরি বিস্তৃত। এক প্রতিবেশী ভারত। দুই যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের কাছে শেখ হাসিনা বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তারা বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকে মিত্র মনে করে এবং করবে। সেক্ষেত্রে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ভরসা যুক্তরাষ্ট্রই। যুুক্তরাষ্ট্রই পারে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে। তাদের বিশ্বাস, ভারত-আমেরিকার মধ্যস্থতায় একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হতে পারে। গুহার মুখে আলোর শিখায় উদ্ভাসিত হতে পারে বিএনপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, হিলারির বিজয় সম্ভাবনায় অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ জন সমর্থনের পাল্লায় সরকারি দল পিছিয়ে। এটা সর্বজন স্বীকৃত। তা বিশ্বাসও করেন আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে কথা বললেই সরকারি দলের মধ্যে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়। যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে তারা শংকিত। আওয়ামী লীগ অবশ্য এ সব স্বীকার করতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য সারাদেশে উন্নয়নের যে বন্যা বইছে, নির্বাচন হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই সরকার গঠন করবে। জনগণ তারই সাথে। আমেরিকায় নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ লেখককে আলাপচারিতায় বলেন, প্রধানত : ইমিগ্রেশন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষায় আমরা হিলারিকে সমর্থন দিয়েছি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পলিসি হচ্ছে আমেরিকানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবেই হিলারির প্রতি সমর্থন দিয়েছে এবং তার জন্য কাজ করছে। ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনার সরকারের তিক্ত সম্পর্কের কথা সবাই জানেন। অন্যদিকে ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হিলারি ক্লিন্টনের ঘনিষ্ঠ ও পারিবারিক বন্ধু।
হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে শেখ হাসিনার সরকার কোন চাপে পড়বে কি না জানাতে চাইলে আকতার হোসেন বলেন, দু- দেশের সম্পর্ক অনেক দৃঢ়। ব্যক্তি সম্পর্ক সেখানে মুখ্য হতে পারে না। মনে রাখবেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সরকার পরিচালিত হয় তাদের নীতির ওপর ভিত্তি করে। কে প্রেসিডেন্ট হলেন বড় কথা নয়। বাংলাদেশে জঙ্গি ও উগ্রবাদ দমনে শেখ হাসিনার সরকার এক নম্বর। জঙ্গিবাদ ও উগ্র মৌলবাদ আমেরিকার প্রধান শত্রু। আমি মনে করি, হিলারি ও শেখ হাসিনার সরকার অভিন্ন শত্রু মোকাবেলায় হাতে হাত রেখে কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রহিম বাদশা বলেন, ভারতের নির্বাচনের সময় বিএনপি বিজেপিকে নিয়ে অতি উৎসাহে বাড়াবাড়ি করেছিল। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের নীতির পরিবর্তন করেনি। বরং ভারতের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। হিলারিকে নিয়ে এখানেও বিএনপি অতিরঞ্জিত করছে। ইমিগ্রেশন প্রশ্নে আমরাও হিলারিকে সমর্থন দিয়েছি। হিলারি জিতলে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। তখন বিএনপির মুখ পুড়বে ভারতের মতোই।
হিলারি প্রশ্নে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস আহমেদ বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে বিভক্ত করে ফেলছে। ধর্মীয় ফ্যানাটিজমকে উসকে দিচ্ছে। এন্টি মুসলিম ককাস গঠন করছে। আমি দু-দুবার রিপাবলিকান দলের হয়ে স্টেটে নির্বাচন করেছি। কিন্তু এবার ইমিগ্রেশন ইস্যু ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্নে হিলারির সমর্থনে মাঠে নেমেছি। দলগতভাবে বিএনপি কি হিলারি প্রশ্নে অতিমাত্রায় উৎসাহী? এ প্রশ্নে গিয়াস বলেন, বাংলাদেশে একদলীয় ও অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। আমি মনে করি, হিলারি কিংবা ট্রাম যিনিই ক্ষমতায় আসুন তারা অগণতান্ত্রিক হাসিনার সরকারকে সমর্থন করবেন না। বরং অবাধ নির্বাচনে ও একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান লেখককে বলেন, হিলারির প্রশ্নে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি সবাই একমত। প্রবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই আমরা একমত। ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই আমরা হিলারিকে ভোট দিচ্ছি। তবে জিল্লুর প্রত্যাশা করেন, হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবেন। তিনি বলেন, হিলারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দেশের আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠা, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিশ্চয়ই হিলারির প্রশাসন একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেবেন।
বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী হিলারির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা দেশ ও প্রবাস উভয় স্থানেই সক্রিয়। তারা অর্থ সংগ্রহ করে ট্রাম্পের নির্বাচনী তহবিলেও জমা দিচ্ছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী ভূমিকাকে তারা স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন, ট্রাম্পের ‘ইমিগ্রেশন’ হাতিয়ার আঘাত হানলে তা সবার ওপর পড়বে। একজন বাংলাদেশী বিজন সরকার ‘অনলাইন’ পোর্টালে লিখেছেন, হিলারির রাজনৈতিক দর্শন কেবল আমেরিকার জনগণের নয়, বাংলাদেশের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়। অভিযোগ করছেন, জামায়াত-বিএনপি হিলারিকে অর্থ জোগান দিচ্ছে। যেমনটি দিয়েছিল ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জিকে।
আমেরিকায় এবারের নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছে। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি কিংবা জামায়াত সেটি মুখ্য নয়। সবাই একট্টা। কমিউনিটির ক্ষুদ্র একটি অংশের কথা আলাদা। তবে প্রবাসে হিন্দি ভাষায় টিভি চ্যানেলে ট্রাম্পের সমর্থনে বিজ্ঞাপন দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এটা মনে রাখা উচিত ‘ইমিগ্যান্ট’ বিরোধী বোমাটি ফাটলে কে মুসলিম কে হিন্দু ও কে খ্রিস্টান বাছাই করে পড়বে না। আঘাত এলে সবার ওপরেই পড়বে। ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন পলিসি’র প্রতিবাদেই সব অভিবাসীর উচিত হিলারির পক্ষে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া। আগামী ৮ নভেম্বর নির্বাচন। দলমত নির্বিশেষে, জাতি, সম্প্রদায় ও বর্ণ ভুলে সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যরে আমেরিকার প্রত্যাশায় ভোট কেন্দ্রে যেতেই হবে।
এদিকে সর্বশেষ জনমত জরিপে (৩১ অক্টোবর, ২০১৬) জাতীয় পর্যায়ে হিলারি শতকরা এক ভাগ (৪৫%-৪৪) ভোটে এগিয়ে আছেন। এটা হচ্ছে দেশব্যাপী পপুলার ভোটের জরিপ। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেকটরাল ভোটে, পপুলার ভোটে নন। যেমনটি ২০০০ সালের ভোটে আল গোর মিলিয়ন পরিমাণ পপুলার ভোটে এগিয়ে থেকেও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। জয়ের মালা পড়েছিলেন জর্জ বুশ। তা ইলেকটরাল ভোটের ভিত্তিতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে প্রয়োজন ২৭০ ইলেকটরাল ভোট। হিলারির ইলেকটরাল ভোট ২৬৩। আর ট্রাম্পের ভোট ১৬৪।
ব্যাটলগ্রাউন্ড : সুইং স্টেট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ১১টি। এ স্টেটগুলো হচ্ছে- ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, নিউহ্যাম্পশায়ার, ওয়াহিও, নেভাদা, ভারজিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, কলারাডো, আইওয়া, উইসকনসিন ও মিশিগান। এই ১১টি স্টেটের মধ্যে জনমত জরিপে ট্রাম্প শুধু আইওয়া এবং ওয়াহিও স্টেটে এগিয়ে আছেন। বাকি ৯টি স্টেটেই হিলারি এগিয়ে। এর মধ্যে ভারজেনিয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, প্যানসিলভানিয়ায় হিলারির বিজয় নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে বাকি থাকে পাঁচটি স্টেট। এই পাঁচটিতে হিলারি ১.৫% ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু একটিতে জিতলেই হিলারি প্রেসিডেন্ট। আর ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হতে হলে ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটের এই পাঁচটিতেই জিততে হবে।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি।