‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে, রাশিয়ায়ও চেষ্টা করেছে’
- প্রকাশের সময় : ১১:৪৫:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪
- / ৩৭ বার পঠিত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং ২০২০ সালে জো বাইডেন যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে বিজয়ী হয়েছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান সিনথিয়া ম্যাককিনি।
রাশিয়ার মস্কোতে ‘এক টাকার খবর’-এর প্রধান সম্পাদক মুন্নী সাহার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন সিনথিয়া ম্যাককিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের কারচুপি ও জালিয়াতির সমালোচনা করে সিনথিয়া বলেন, সত্য যেমন শক্তিশালী, তেমনি আমার উপরে যে আঘাত আসবে, তা-ও খুব শক্তিশালী।
রাশিয়ার নির্বাচনকে ‘জেনুইন’ আখ্যায়িত করে সিনথিয়া বলেন, ‘রাশিয়ায় জেনুইন নির্বাচন হয়েছে। কারণ এই নির্বাচন খুব সহজ হয়েছে, যাতে ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল।’ বাংলাদেশের নির্বাচনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল, পুলিশের উপস্থিতি ছিল, পোলিং এজেন্টদের জন্য নিরাপত্তা ছিল। কিন্তু রাশিয়ায় ভোটারদের রক্ষা করার জন্য ছিলেন ভোটাররা। এখানে হস্তক্ষেপ করার কেউ ছিল না; এখানে খাবারের ব্যবস্থা ছিল, গানের আয়োজন ছিল; এমনকি গতকাল আমার জন্মদিনে তারা আমাকে শুভেচ্ছাও জানিয়েছে। মূলত এই নির্বাচনটা ছিল একটি উৎসবের মতো।
সিনথিয়াকে প্রশ্ন রেখে মুন্নী সাহা বলেন, আমি কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। আপনি কি পর্যবেক্ষক হিসেবে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছেন? আমি একটা আর্টিকেল পড়েছি, সেখানে লেখা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জনগণকে ভোট না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছিল। এর পেছনের কারণ কী?
জবাবে সিনথিয়া বলেন, আমি মনে করি নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশিরা খুব সচেতন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে এবং তারা রাশিয়ায়ও এমন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার মতে, এই ধরনের চেষ্টা একটা বিপরীত প্রভাব তৈরি করে। কিন্তু রাশিয়া ভোটারের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু যিনি বেশি ভোট পান, তিনি জয়ী হন। এটা মেজরিটির রুল। ৫০+১ হলেই সরকার গঠন করা যায়; এটা কোনও ম্যান্ডেট নয়। কিন্তু রাশিয়ায় প্রথম দিনে ভোট ছিল ৩০ শতাংশের মতো।
এ সময় মুন্নী সাহা প্রথম দিনে ৩৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলার পর সিনথিয়া বলেন, ‘আমি জানি না, আমি আসলে পরিসংখ্যান নিয়ে অবগত ছিলাম না। আমি ঘুরে ঘুরে যা দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলেছি। আমি জানি না ফাইনালি কত পার্সেন্ট পর্যন্ত ভোট হয়, তবে এটা ৮৮ শতাংশের মতো হবে।’ এ সময় মোট ৮৮ শতাংশ ভোটের মধ্যে পুতিন ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন বলে জানিয়ে দেন মুন্নী সাহা।
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে সিনথিয়া বলেন, ‘আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্রের এখান থেকে শেখার আছে। রাশিয়া জাদুর মতো কাজ করেছে। তাদের জনগণের ভোট দিতে কোনও ভোগান্তি বা সময় লাগেনি। জনগণ তাদের ব্যবহৃত ডিভাইসের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। আমি মনে করি এটাই হওয়া উচিত।’
ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বিষয়ে মুন্নী সাহা জানতে চান, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা যখন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ভোট দিই, তখন কারচুপি, জাল ভোটসহ অনেক কিছু ঘটে ডিভাইসের মধ্যে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো। তাহলে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন যে রাশিয়ার নির্বাচনে কোনও কারচুপি বা জাল-জালিয়াতি হয়নি?’
সিনথিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ফ্লোরিডায় আটকে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার ফলাফলের ওপর সিদ্ধান্ত হচ্ছিল বুশ অথবা আল গোর হোয়াইট হাউজে যাচ্ছেন। নানা নাটকীয়তার পর বুশ হোয়াইট হাউজে যান। গোর পরাজয় মেনে নেন।
তিনি আরও বলেন, ফ্লোরিডায় আমার এক বন্ধু আছে, সেখানে সে ভোটিং মেশিনগুলো সরবরাহ করেছিল। তখন যা ঘটেছিল তা হলো, ভোটিং মেশিনগুলোর মধ্যে একটি, যেটি পরে সর্বজনীন করা হয়েছিল, মেশিনটি মাইনাস ১৬ হাজার ৯০০ থেকে শুরু হয়েছিল। যার অর্থ হলো, মেশিনটি শূন্যে যাওয়ার আগেই ১৭ হাজার লোককে ভোট দিতে হয়েছিল। সুতরাং জর্জ বুশ জয়ী হননি। অথচ তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে আট বছর পার করেছেন।
পর্যবেক্ষক দলের প্রধান বলেন, ‘তারপর যখন ট্রাম্প এসেছে এবং এই জালিয়াতি সম্পর্কে বলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এই সম্পর্কে জেনেছে। এটা শুধু আমি নই, অনেকেই বলেছেন যে এই সিস্টেমে কারচুপি হয়। তারপর ট্রাম্প ২০২০ সালে নির্বাচনে জিতেছেন, তিনি তরুণদের আকৃষ্ট করেছেন, তরুণরাও তাকে ভোট দিয়েছেন, কিন্তু সেখানেও কিছু জালিয়াতি ছিল। আমি কংগ্রেসে জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারণার সময়ও কাজ করেছি। তিনিও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট হননি, জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন।’
এ সময় মুন্নি সাহা ‘এটা খুব শক্ত বিবৃতি এবং সত্য সব সময় শক্তিশালী’ বলে মন্তব্য করলে সিনথিয়া ‘আমার মাথার ওপরে যে হেমার পড়বে, তা-ও খুব শক্তিশালী’ বলে হেসে দেন। জনগণের নেতা সম্পর্কে সিনথিয়ার মতামত কী, জানতে চাইলে সিনথিয়া বলেন, ‘ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শাবেজ জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। যিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছেন। পশ্চিমাদের নিরন্তর চাপ আর বিরোধীদের টালবাহানাও সামান্য টলাতে পারেনি তাকে। কারণ তার কাছে জনগণের ভালোবাসা ছিল, জনপ্রিয়তা ছিল এবং তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। আমি তার শেষকৃত্যে ছিলাম। আমি দেখেছি, লাখ লাখ মানুষ কান্না করেছিল তার জন্য। আমি বিশ্বাস করি যদি একজন নেতা তার জনগণকে ভালোবাসেন, তাহলে জনগণও তাকে ভালোবাসবেন। আমি তার ওপর নিবন্ধে লিখেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি জনগণের কাছে প্রিয়? এর মূল কারণ ছিল তিনি নিজেকে জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, যদি আপনি নিজেকে জনগণের কাছে নিয়ে যান, আপনি অবশ্যই জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। এ জন্য আপনাকে আর কারচুপি বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে না। আপনি তাদের কাছ থেকে পুরস্কৃত হবেন, যারা আপনাকে ভালোবাসে।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৮ শতাংশ কমবেশি লোক ভোট দিয়েছেন। রাশিয়ায় ৮৮ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। তো এই দুই দেশের জনগণকে, ভোটারকে এবং দুই দেশের নেতৃত্বকে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন? মুন্নী সাহার এমন প্রশ্নের জবাবে সিনথিয়া বলেন, ‘আমি দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ খুবই কঠোর পরিশ্রমী। আমার মতে তারা অর্থনৈতিকভাবেও সফল। আমি বাংলাদেশে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলাম, কারণ আমি সেখানে শিক্ষকতা করেছি।’ তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এ আইনটির কারণে মানুষ অনেক বেশি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। আইনটি সংশোধন করার প্রয়োজন আছে।’
বাংলাদেশের মানুষদের উদ্দেশে সিনথিয়া বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে শিক্ষকতা করেছি। আমি জানি বাংলাদেশের মানুষের ইউরো-কেন্দ্রিক মনোভাব আছে। আমার মনে হয়, যদি তারা এটা (ইউরো-কেন্দ্রিক) সেরা মনে করেন, তাহলে তা ভুল। বাংলাদেশের হাজার বছরের একটা সভ্যতা আছে এবং এটা নিয়ে তাদের গর্বিত হওয়া উচিত।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন।