নিউইয়র্ক ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও

রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:২০:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৩০ বার পঠিত

‘আমেরিকান ড্রিম’ বিশ্বের কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার নাম। উন্নত জীবনের আশায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নতুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই অভিবাসন নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সই করেছেন একাধিক নির্বাহী আদেশে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপরেও। প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব এবং পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আরও যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্পের অভিবাসন ও সীমান্ত সুরক্ষাবিষয়ক উল্লেখযোগ্য নির্বাহী আদেশের মধ্যে রয়েছে– জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সমাপ্তি, আশ্রয় ও শরণার্থী প্রোগ্রাম স্থগিতকরণ, সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং মাদক চোরাকারবারি চক্রকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পথে বড় ধরনের কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে বিপদগ্রস্ত ও নিপীড়নের শিকার শরণার্থীদের সমর্থন-সহায়ক কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদের কিছু বিতর্কিত কর্মসূচিও আবার চালু করছেন। যেমন ‘মেক্সিকোয় থাকুন’ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় মেক্সিকো ছাড়া অন্য দেশগুলোর আশ্রয়প্রার্থীদের মামলা মার্কিন আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মেক্সিকোয় থাকতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করা হচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে একটি শিশু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়ে থাকে– এমন প্রথা বাতিল আদেশে স্বাক্ষর করেছেন ট্রাম্প। ৩০ দিন পর এ আদেশ কার্যকর হবে। কোনো বিদেশি নাগরিক যদি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে শিশু জন্ম দেন, সেই শিশুর সঙ্গে তার বাবা-মাও নাগরিকত্ব পেয়ে যেতেন। এ আদেশের ফলে সেটিও আর থাকছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেশটির সংবিধানে ১৪তম সংশোধনী দিয়ে সুরক্ষিত। সংবিধানের এ ধারা বাতিল করতে হলে অবশ্যই আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে।

অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর হবে জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসন নিয়ে মোট ছয়-সাতটি নির্বাহী আদেশ জারি হতে পারে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল-বিষয়ক আদেশে ট্রাম্প সই করেছেন। বাকিগুলো করেন কিনা, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আগের বারও অভিবাসন নিয়ে কঠোর হয়েছিলেন ট্রাম্প। দেশটিতে থাকা অনিবন্ধিত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বের করে দেবেন। সেই সঙ্গে পরিবারের একজন নাগরিকত্ব নিয়ে বাকিদের এক এক করে নিয়ে যাওয়ার নিয়মও বাতিল হবে।

বাংলাদেশের ক্ষতির ব্যাখ্যায় হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্যতম। ফলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা আরও যাচাই-বাছাই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারে।

নির্বাহী আদেশ কার্যকর করতে সংবিধান পরির্বতন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে নাগরিকদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন রয়েছে। ফলে এটিকে বাতিল করতে আদালতে যেতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে বর্তমানে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে ৬ জন বিচারক রিপাবলিকানদের। ফলে সেখান থেকে এ আদেশের পক্ষে ব্যাখ্যা বের করে আনতে ট্রাম্প প্রশাসনের খুব বেশি কষ্ট হবে বলে মনে হয় না।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বিষয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমরা পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা জন্মগত নাগরিকত্বের এই ব্যবস্থা রাখি। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমরা মনে করি, আমাদের ভালো ভিত্তি আছে ।এই নীতি ঘোষণার মুহূর্তেই আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) এটি নিয়ে একটি মামলা করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ থমাস উলফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, জন্মগত নাগরিকত্ব বাতিল আলোচনা মাত্র। প্রেসিডেন্ট এটি বাতিল করতে পারবেন না। কারণ, সংবিধান স্পষ্টভাবে এটির নিশ্চয়তা দিয়েছে। এখানে জন্মগ্রহণ মানেই নাগরিকত্ব। কোনো নির্বাহী আদেশ আদালতের লড়াইয়ে টিকবে না।

আশ্রয় ও শরণার্থী প্রোগ্রাম স্থগিতকরণ
আশ্রয় প্রার্থনা ও শরণার্থী গ্রহণ প্রক্রিয়া নির্বাহী আদেশে স্থগিত করা হয়েছে, যা অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও কঠোর করবে। যার উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী গ্রহণ প্রোগ্রামকে আমেরিকান নীতি ও স্বার্থের সঙ্গে আরও সংগতিপূর্ণ করা। আদেশ অনুযায়ী, ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও পররাষ্ট্র দপ্তর ৯০ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দেবে। সেখানে তারা বিশ্লেষণ করবে– শরণার্থী গ্রহণ পুনরায় শুরু করা জাতীয় স্বার্থে হবে কিনা। তাদের প্রতিবেদন আসার আগ পর্যন্ত শরণার্থী গ্রহণ স্থগিত থাকবে। শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করা সংস্থা গ্লোবাল রিফিউজির প্রেসিডেন্ট ও সিইও ক্রিস ও’মারা ভিগনারাজা বলেন, শরণার্থী প্রোগ্রাম শুধু একটি মানবিক সাহায্যের মাধ্যম নয়। এটি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বনেতৃত্ব দেখিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে যাচাই প্রক্রিয়া জোরদার
অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং এবং যাচাই প্রক্রিয়া জোরদার করা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এই আদেশে জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আমেরিকানদের সুরক্ষায় ভিসা ইস্যু করার প্রক্রিয়ায় সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যেন অনুমোদিত অভিবাসীরা জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে না পারে। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। ফলে ওই অঞ্চলে অতিরিক্ত সামরিক সম্পদ মোতায়েন হবে। এই ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন পেন্টাগনের বাহিনী এবং সম্পদ সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণ সম্পন্ন করতে ব্যবহার করতে পারবে।

মাদক চোরাকারবারি চক্রকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা
মাদক চোরাকারবারি চক্রগুলোকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করবে। এই পদক্ষেপ বিশেষত এমএস-১৩ ও ট্রেন ডি আরাগুয়ার মতো গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ কার্টেলের সদস্যদের সহজে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করতে পারবে। এমনকি যারা চক্রগুলোকে সাহায্য করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

এদিকে, ট্রাম্পের শপথের পরপরই ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন (সিবিপি) অ্যাপের মাধ্যমে নির্ধারিত সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা হয়েছে। অ্যাপটি অভিবাসীদের বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য ব্যবহৃত হতো। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী মেক্সিকোয় আটকা পড়েছেন। অ্যাপটিতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারিত থাকা হাজার হাজার নির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অ্যাপটি সহায়তা করেছে।

এই আকস্মিক পদক্ষেপে মেক্সিকো সীমান্তে অপেক্ষমাণ অভিবাসনপ্রত্যাশীরা হতাশায় ভেঙে পড়েছেন। হাইতি, ভেনেজুয়েলাসহ সারাবিশ্ব থেকে আসা এসব ব্যক্তি স্যুটকেস নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অ্যাপয়েন্টমেন্টও পেয়েছিলেন। ভেনেজুয়েলার মেলানি মেন্ডোজা যখন দেখতে পান, সিবিপি অ্যাপে তাঁর সোমবার দুপুর ১টার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়েছে, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি পরিবারসহ মেক্সিকোর টিজুয়ানার সীমান্ত ক্রসিংয়ে অপেক্ষা করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগোর সঙ্গে এই টিজুয়ানা ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ জনকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো।

মেলানি মেন্ডোজা বলেন, জানি না, আমরা এখন কী করব! আমি পৃথিবীর কাছ থেকে কিছু চাই না; শুধুই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি। আমি ঈশ্বরকে অনুরোধ করছি যেন আমাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তাঁর চারপাশের অভিবাসীরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিলেন বা চুপচাপ কাঁদছিলেন। অনেকে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন না, কী করবেন। তখনও সীমান্তের একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল– সিবিপি ওয়ান অ্যাপ ডাউনলোড করুন। এটি আপনার অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করবে। সিবিপি ওয়ান কার্যত একটি লটারির মতো। অ্যাপটি দিনে আটটি সীমান্ত ক্রসিংয়ে ১ হাজার ৪৫০ জনকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সুযোগ দেয়। সিবিপির তথ্য অনুসারে, দিনে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ স্লটের জন্য চেষ্টা করেন। সূত্র : সমকাল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও

রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা

প্রকাশের সময় : ১২:২০:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫

‘আমেরিকান ড্রিম’ বিশ্বের কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার নাম। উন্নত জীবনের আশায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নতুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই অভিবাসন নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সই করেছেন একাধিক নির্বাহী আদেশে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপরেও। প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব এবং পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আরও যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্পের অভিবাসন ও সীমান্ত সুরক্ষাবিষয়ক উল্লেখযোগ্য নির্বাহী আদেশের মধ্যে রয়েছে– জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সমাপ্তি, আশ্রয় ও শরণার্থী প্রোগ্রাম স্থগিতকরণ, সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং মাদক চোরাকারবারি চক্রকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পথে বড় ধরনের কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে বিপদগ্রস্ত ও নিপীড়নের শিকার শরণার্থীদের সমর্থন-সহায়ক কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদের কিছু বিতর্কিত কর্মসূচিও আবার চালু করছেন। যেমন ‘মেক্সিকোয় থাকুন’ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় মেক্সিকো ছাড়া অন্য দেশগুলোর আশ্রয়প্রার্থীদের মামলা মার্কিন আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মেক্সিকোয় থাকতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করা হচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে একটি শিশু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়ে থাকে– এমন প্রথা বাতিল আদেশে স্বাক্ষর করেছেন ট্রাম্প। ৩০ দিন পর এ আদেশ কার্যকর হবে। কোনো বিদেশি নাগরিক যদি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে শিশু জন্ম দেন, সেই শিশুর সঙ্গে তার বাবা-মাও নাগরিকত্ব পেয়ে যেতেন। এ আদেশের ফলে সেটিও আর থাকছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেশটির সংবিধানে ১৪তম সংশোধনী দিয়ে সুরক্ষিত। সংবিধানের এ ধারা বাতিল করতে হলে অবশ্যই আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে।

অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর হবে জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসন নিয়ে মোট ছয়-সাতটি নির্বাহী আদেশ জারি হতে পারে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল-বিষয়ক আদেশে ট্রাম্প সই করেছেন। বাকিগুলো করেন কিনা, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আগের বারও অভিবাসন নিয়ে কঠোর হয়েছিলেন ট্রাম্প। দেশটিতে থাকা অনিবন্ধিত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বের করে দেবেন। সেই সঙ্গে পরিবারের একজন নাগরিকত্ব নিয়ে বাকিদের এক এক করে নিয়ে যাওয়ার নিয়মও বাতিল হবে।

বাংলাদেশের ক্ষতির ব্যাখ্যায় হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্যতম। ফলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা আরও যাচাই-বাছাই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারে।

নির্বাহী আদেশ কার্যকর করতে সংবিধান পরির্বতন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে নাগরিকদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন রয়েছে। ফলে এটিকে বাতিল করতে আদালতে যেতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে বর্তমানে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে ৬ জন বিচারক রিপাবলিকানদের। ফলে সেখান থেকে এ আদেশের পক্ষে ব্যাখ্যা বের করে আনতে ট্রাম্প প্রশাসনের খুব বেশি কষ্ট হবে বলে মনে হয় না।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বিষয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমরা পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা জন্মগত নাগরিকত্বের এই ব্যবস্থা রাখি। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমরা মনে করি, আমাদের ভালো ভিত্তি আছে ।এই নীতি ঘোষণার মুহূর্তেই আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) এটি নিয়ে একটি মামলা করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ থমাস উলফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, জন্মগত নাগরিকত্ব বাতিল আলোচনা মাত্র। প্রেসিডেন্ট এটি বাতিল করতে পারবেন না। কারণ, সংবিধান স্পষ্টভাবে এটির নিশ্চয়তা দিয়েছে। এখানে জন্মগ্রহণ মানেই নাগরিকত্ব। কোনো নির্বাহী আদেশ আদালতের লড়াইয়ে টিকবে না।

আশ্রয় ও শরণার্থী প্রোগ্রাম স্থগিতকরণ
আশ্রয় প্রার্থনা ও শরণার্থী গ্রহণ প্রক্রিয়া নির্বাহী আদেশে স্থগিত করা হয়েছে, যা অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও কঠোর করবে। যার উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী গ্রহণ প্রোগ্রামকে আমেরিকান নীতি ও স্বার্থের সঙ্গে আরও সংগতিপূর্ণ করা। আদেশ অনুযায়ী, ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও পররাষ্ট্র দপ্তর ৯০ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দেবে। সেখানে তারা বিশ্লেষণ করবে– শরণার্থী গ্রহণ পুনরায় শুরু করা জাতীয় স্বার্থে হবে কিনা। তাদের প্রতিবেদন আসার আগ পর্যন্ত শরণার্থী গ্রহণ স্থগিত থাকবে। শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করা সংস্থা গ্লোবাল রিফিউজির প্রেসিডেন্ট ও সিইও ক্রিস ও’মারা ভিগনারাজা বলেন, শরণার্থী প্রোগ্রাম শুধু একটি মানবিক সাহায্যের মাধ্যম নয়। এটি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বনেতৃত্ব দেখিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে যাচাই প্রক্রিয়া জোরদার
অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং এবং যাচাই প্রক্রিয়া জোরদার করা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এই আদেশে জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আমেরিকানদের সুরক্ষায় ভিসা ইস্যু করার প্রক্রিয়ায় সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যেন অনুমোদিত অভিবাসীরা জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে না পারে। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। ফলে ওই অঞ্চলে অতিরিক্ত সামরিক সম্পদ মোতায়েন হবে। এই ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন পেন্টাগনের বাহিনী এবং সম্পদ সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণ সম্পন্ন করতে ব্যবহার করতে পারবে।

মাদক চোরাকারবারি চক্রকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা
মাদক চোরাকারবারি চক্রগুলোকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করবে। এই পদক্ষেপ বিশেষত এমএস-১৩ ও ট্রেন ডি আরাগুয়ার মতো গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ কার্টেলের সদস্যদের সহজে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করতে পারবে। এমনকি যারা চক্রগুলোকে সাহায্য করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

এদিকে, ট্রাম্পের শপথের পরপরই ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন (সিবিপি) অ্যাপের মাধ্যমে নির্ধারিত সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা হয়েছে। অ্যাপটি অভিবাসীদের বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য ব্যবহৃত হতো। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী মেক্সিকোয় আটকা পড়েছেন। অ্যাপটিতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারিত থাকা হাজার হাজার নির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অ্যাপটি সহায়তা করেছে।

এই আকস্মিক পদক্ষেপে মেক্সিকো সীমান্তে অপেক্ষমাণ অভিবাসনপ্রত্যাশীরা হতাশায় ভেঙে পড়েছেন। হাইতি, ভেনেজুয়েলাসহ সারাবিশ্ব থেকে আসা এসব ব্যক্তি স্যুটকেস নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অ্যাপয়েন্টমেন্টও পেয়েছিলেন। ভেনেজুয়েলার মেলানি মেন্ডোজা যখন দেখতে পান, সিবিপি অ্যাপে তাঁর সোমবার দুপুর ১টার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়েছে, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি পরিবারসহ মেক্সিকোর টিজুয়ানার সীমান্ত ক্রসিংয়ে অপেক্ষা করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগোর সঙ্গে এই টিজুয়ানা ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ জনকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো।

মেলানি মেন্ডোজা বলেন, জানি না, আমরা এখন কী করব! আমি পৃথিবীর কাছ থেকে কিছু চাই না; শুধুই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি। আমি ঈশ্বরকে অনুরোধ করছি যেন আমাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তাঁর চারপাশের অভিবাসীরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিলেন বা চুপচাপ কাঁদছিলেন। অনেকে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন না, কী করবেন। তখনও সীমান্তের একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল– সিবিপি ওয়ান অ্যাপ ডাউনলোড করুন। এটি আপনার অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করবে। সিবিপি ওয়ান কার্যত একটি লটারির মতো। অ্যাপটি দিনে আটটি সীমান্ত ক্রসিংয়ে ১ হাজার ৪৫০ জনকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সুযোগ দেয়। সিবিপির তথ্য অনুসারে, দিনে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ স্লটের জন্য চেষ্টা করেন। সূত্র : সমকাল।