যুক্তরাষ্ট্রের ঋণসীমা না বাড়লে কী হবে?
- প্রকাশের সময় : ১১:১৭:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ মে ২০২৩
- / ৬২ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : ঋণের সর্বোচ্চ সীমা (ডেবট সিলিং) বাড়ানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এখন এমন চরম অচলাবস্থার মধ্যে আটকে আছে, যা কেবল তাদের জন্য নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্যই এক মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। যে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া আছে, সেটি আরো বাড়ানো হবে কি না, তা নিয়ে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান, দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে অনড়। এই অচলাবস্থার সমাধান না হলে বিশ্ব অর্থনীতিকে হয়তো এ যাবত্কালের সবচেয়ে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানরা যদি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আরো অর্থ ধার করতে দিতে রাজি না হয়, বা তাদের ভাষায়— ঋণের সর্বোচ্চ সীমা না বাড়ায়, তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশ তাদের ৩১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন=১ লাখ কোটি) ডলারের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঋণখেলাপি হবে। এরকম সমঝোতায় পৌঁছানোর সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আগামী ১ জুনের মধ্যে যেভাবেই হোক এই অচলাবস্থার নিরসন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে নির্দিষ্ট করা আছে, সরকার সর্বোচ্চ কী পরিমাণ অর্থ ধার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যয়ের বড় খাতগুলো হচ্ছে ফেডারেল সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সামরিক ব্যয়, সোশ্যাল সিকিউরিটি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। এর সঙ্গে আছে সরকারের জাতীয় ঋণের কিস্তি এবং এর সুদ পরিশোধ এবং ট্যাক্স রিফান্ড ইত্যাদি। গত বেশ কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে, কারণ সরকার আসলে যা আয় করছে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করছে। ঋণ করার সর্বোচ্চ সীমা এখন বেঁধে দেওয়া আছে ৩১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে। কিন্তু গত জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ঋণ এই সীমায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় অন্য কিছু উপায়ে সরকারকে বাড়তি অর্থ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়ালেন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, যদি সরকার আরো অর্থ ধার করতে না পারে, তাহলে ১ জুনের মধ্যেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যে, সরকার হয়তো আর তার ধার-দেনা-দায় পরিশোধ করতে পারবে না।
বিবিসি বলছে, যত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তারা এ নিয়ে কথা বলেছে, তাদের কেউই মনে করেন না যে, যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হবে। কিন্তু যদি ঋণখেলাপি হয়, তখন কী হবে? এর কী প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে? একটি ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ‘প্যানমিউর গর্ডনের’ প্রধান অর্থনীতিবিদ সাইমন ফ্রেঞ্চের ভাষায়, যদি এরকম কিছু আসলেই ঘটে, তখন এই বিপর্যয়ের তুলনায় ২০০৮ সালের বিশ্ব ব্যাংকিং এবং আর্থিক সংকটকে এক সামান্য বিষয় বলে মনে হবে। ১৫ বছর আগের ঐ সংকটের সময় বিশ্বের বড় বড় বহু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক মন্দা দেখা দিয়েছিল।
এ জে বেল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ইনভেস্টমেন্ট ডিরেক্টর রাস মোল্ডের মতে, যদি যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বাড়ানো না হয়, তাহলে দ্রুত সরকারের হাতে থাকা অর্থ ফুরিয়ে যাবে, তারা আর দায়-দেনা পরিশোধ করতে পারবে না, জনগণকে যেসব সুযোগ-সুবিধা-সেবা দিতে হয়, সেগুলোও অব্যাহত রাখতে পারবে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। আর পরিণামে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিতে এর ধাক্কা লাগবে। হোয়াইট হাউজের ‘কাউন্সিল অব ইকোনমিক এডভাইজার্স’ হিসেব করে দেখেছে, সরকার যদি একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত ঋণের সীমার ব্যাপারে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি ৬ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজের প্রেসিডেন্ট এবং নামকরা অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আল-এরিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ঋণ-খেলাপি হয়, তখন পুরো যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বিশ্ব জুড়ে সব দেশের সঙ্গেই ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশীদার। তারা মন্দায় পড়লে বাকি বিশ্ব থেকে জিনিসপত্রও কিনবে অনেক কম। এর প্রভাব অনেক দেশেই পড়বে। অর্থনীতিবিদ সাইমন ফ্রেঞ্চের মতে, যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিতে মন্দা মানে হচ্ছে—ব্রিটিশ অর্থনীতিও নিশ্চিতভাবেই মন্দায় পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হওয়ার মানে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যেই মন্দা নয়, এর প্রভাব পড়বে বাড়ি কেনার ঋণ হতে শুরু করে আরো অনেক কিছুর ওপর। জিনিসপত্রেরও দাম বেড়ে যাবে। এটি হবে রীতিমতো এক প্রলয়কাণ্ড।
আরোও পড়ুন । কূটনীতিকদের বাড়তি প্রটোকল প্রত্যাহার নিয়ে যা জানালো যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র ডলার হচ্ছে গোটা বিশ্বের জন্য রিজার্ভ মুদ্রা। যদি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ঋণখেলাপি হয়, সঙ্গে সঙ্গে ডলারের দাম নাটকীয়ভাবে পড়ে যাবে। মনে হতে পারে, এটা তো বাকি বিশ্বের জন্য ভালো খবর। কিন্তু ফ্রেঞ্চ বলছেন, এর মানে হচ্ছে, যারা বিশ্বে পণ্যের বাজারে বিনিয়োগ করে, তারা তখন জানবে না, কীভাবে তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তখন আমাদেরকে হঠাত্ সবকিছুর দাম নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। অর্থনীতির পরিভাষায়, এর নাম ‘রিস্ক প্রিমিয়াম’, অর্থাৎ বাড়তি ঝুঁকি। তখন সব কিছুর দামের মধ্যে এই বাড়তি ঝুঁকির খরচ যুক্ত হবে। কাজেই রুটির দাম পর্যন্ত বেড়ে যাবে।
রাস মোল্ড বলেন, বিশ্বের শেয়ার বাজারের ৬০ শতাংশ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হলে শেয়ার বাজারে তার বাজে প্রতিক্রিয়া হবেই। পেনশন তহবিলের যে অর্থ যুক্তরাষ্ট্র শেয়ারে বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। লোকে হয়তো জানেই না যে তাদের পেনশনের অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করা। তবে সবকিছুই দুঃসংবাদ বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। ২০১১ সালেও ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানরা ঋণের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে এরকম অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন, সেই অচলাবস্থার নিরসন হয়েছিল ঋণখেলাপি হওয়ার সময়সীমা ঘনিয়ে আসার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। তখন যুক্তরাষ্ট্র শেয়ার বাজারে ধস নেমেছিল। তবে এই আতংক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, নাটকীয়ভাবে পড়ে যাওয়া শেয়ার বাজার আবার পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। মোল্ড মনে করেন, এবারেও হয়তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। —সূত্র : বিবিসি
বেলী/হককথা