হককথা ডেস্ক : গত ৭ ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার ওপর এমন সব অর্থনৈতিক অবরোধ আসবে, যা কি-না ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পরও রাশিয়ার ওপর আরোপ করা হয়নি। দুই ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকের পর হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বৈঠকের আলোচ্য বিষয়াবলির উল্লেখ করা হয়।
বাইডেন একইসঙ্গে বলেন, রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস রফতানির জন্য যে ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ পাইপলাইন তৈরি করেছে, সেটা চালু করার আশাও পুতিন ছেড়ে দিতে পারেন, যদি তিনি ইউক্রেন আক্রমণে এগিয়ে যান। অন্যদিকে ক্রেমলিন থেকে বলা হচ্ছে, পুতিন বাইডেনকে বলেন, পূর্ব ইউরোপ এবং বিশেষ করে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সামরিক অবস্থান রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মাঝে ফেলেছে; যেটাকে তারা ‘লাল দাগ’ হিসেবে বলছেন।
তবে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’- এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এটা এখনই বলা যাচ্ছে না যে, এই বৈঠক ইউক্রেনের উত্তেজনা প্রশমনে কতটা ভূমিকা রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, পুতিন তার উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করেননি। যে কারণে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না, যে রাশিয়া কি আসলেই আগামী বছরের শুরুতে ইউক্রেন আক্রমণ করবে, না-কি পশ্চিমাদের কাছ থেকে নিজেদের দাবিগুলি আদায়ের লক্ষ্যেই রাশিয়া একটা সমস্যা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমানায় প্রায় ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছে; যা সামনের দিনগুলোতে ১ লাখ ৭৫ হাজারে উঠতে পারে।
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে, ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার চাপে রাশিয়া ক্রিমিয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অবরোধের কথা চিন্তা করছে, তার মাঝে রয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে রুশ কোম্পানিগুলোর জন্য পুঁজি জোগাড় করা কঠিন করে ফেলা; এবং রুশ রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। আরও কঠিন শাস্তি হিসেবে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে বের করে দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। তবে ইউরোপীয়রা এই শাস্তির ব্যাপারে একমত নন; তারা বলছেন, এটা করা হলে রাশিয়ার প্রত্যুত্তরও যথেষ্ট কঠিন হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্ররা বলছেন, রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এর মাঝে রয়েছে আকাশ নিরাপত্তার রাডার, কাউন্টার আর্টিলারি রাডার, ড্রোন, যোগাযোগ ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি, নৌবাহিনীর জন্য প্যাট্রোল বোট, এবং ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। তবে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে কোনো আলোচনা নেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনকে রক্ষা করতে না পারলে তা রাশিয়ার সামনে পশ্চিমা দুর্বলতাকেই তুলে ধরবে বলে অনেকেই মনে করবে; বিশেষ করে চীন এই ধারণা পোষণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সিনেটের সামনে বলেন, রাশিয়া ক্ষেপে যেতে পারে মনে করে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া অনেক অস্ত্রই স্টোর করে রেখেছে। তবে চাপের মুখে পড়লে ইউক্রেন হয়তো তাদের ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কাজে লাগাতে পারে।
৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’- এর এক ফোরামে বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে সমস্যাটা আসলে ইউক্রেনের চাইতেও বড়। আন্তর্জাতিক সীমানাকে যে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যাবে না, এ ব্যাপারে দুনিয়ার নিয়ম-কানুনকে রক্ষা করাটাই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’- এর ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস একই ফোরামে বলেন, আগামী কয়েক মাসের মাঝে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমানায় জলাগুলো জমে বরফ হলে গেলেই পুতিন হয়তো তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
পুতিন মনে করছেন, জার্মানি চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের রিটায়ারমেন্টের পর কিছুটা বিক্ষিপ্ত রয়েছে। আর ফ্রান্সও আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। আর গত দুই বছরের তুলনায় রাশিয়ার বর্তমান অর্থনীতি বেশ ভালো; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি রাশিয়াকে একটা সুযোগ দিচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বাইডেনের অবরোধের হুমকিকে উড়িয়ে দিয়েই বলেন যে, রাশিয়ার জন্য অবরোধ নতুন কিছু নয়। তিনি আরও বলেন, রুশ সেনারা রুশ ভূমিতেই রয়েছে; তারা কারোর জন্যই হুমকি নয়।
‘এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও অনেকেরই ধারণা পুতিন রাশিয়ার কূটনৈতিক ক্ষতি করে ইউক্রেন আক্রমণ করবেন না; তথাপি ওয়াশিংটনে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন, এবার পুতিন হয়তো ধোঁকা দিচ্ছেন না। ‘কার্নেগি মস্কো সেন্টার’- এর তাতিয়ানা স্তানোভায়া মনে করছেন যে, পুতিন পুরো হিসেবই পাল্টে দিয়েছেন। কাজেই এবার হয়তো রাশিয়া মরিয়া কোনো পদক্ষেপই নেবে।
অপরদিকে বাইডেন যখন বলেছেন যে, তিনি কারোর ‘লাল দাগ’ মানবেন না, তখন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ব্লিনকেনকে বলছেন, রাশিয়া ন্যাটোর কাছ থেকে নিশ্চয়তা চাইছে যে, ন্যাটো রাশিয়ার সীমানার আরও বেশি কাছে আসার চেষ্টা করবে না। স্তানোভায়া মনে করছেন, পুতিন হয়তো বলতে চাইছেন যে, ন্যাটো তাকে এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দিলে তিনি ইউক্রেনে হামলা করবেন। তবে ইউক্রেনকে যে ন্যাটোর ভেতর ঢোকানো হচ্ছে না, সে ব্যাপারে পশ্চিমারা একমত। আর ইউক্রেনকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটাও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা নাকচ করে দিয়েছেন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি শুধু অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়ে রাশিয়াকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে? না-কি ইউক্রেনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে দেশটার ওপর রাশিয়ার আক্রমণকে বৈধতা দেবে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স এখনো নিশ্চিত নয়, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করবেন কি-না; কিন্তু যে ব্যাপারে সকলেই একমত তা হলো, পুতিন বাইডেনকে আলোচনায় বসিয়ে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন রাশিয়াকে আরেকটা সমমানের শক্তি হিসেবে দেখতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। অন্তত একসঙ্গে দুটি শক্তির বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে চ্যালেঞ্জিং হবে, সে ব্যাপারে কারোরেই সন্দেহ নেই।