এশিয়া অঞ্চলে কেমন বাণিজ্যনীতি চায় যুক্তরাষ্ট্র

- প্রকাশের সময় : ০১:০৪:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২
- / ৫৪ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : এশিয়ার দেশগুলো সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিটা বেশ মজার। তারা মুখে বলে, নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনীতি প্রসঙ্গে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমেরিকা খুশি। তবে উচ্চকিত অভিযোগ হলো, এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে খুব একটা আগ্রহী নয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ সবচেয়ে বেশি করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। কারণ, তাদের মধ্যে এ ধরনের একটি আশঙ্কা আছে যে চীন তার অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করতে পারে। এই ভয় থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে চায় এবং বিকল্প উপায় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে চায়। কিন্তু ভাবনার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কী আসলেই অর্থনৈতিক সম্পর্কে গভীরভাবে জড়াতে চায়? জড়াতে চাইলে সেই সম্পর্কই বা কেমন হবে?
আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
এর আগে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। বলে রাখা প্রয়োজন, ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ ছিল একটি বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি, যেটি স্বাক্ষর করেছিলেন ট্রাম্পের আগের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এটি দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে আমেরিকা আর ওই ধরনের চুক্তির দিকে অগ্রসর হবে না। নতুন কোনো পথ বাতলাবে।
ইতিমধ্যে নতুন পথ সৃষ্টিও হয়েছে। গত ২৩ মে জাপানের টোকিওতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারটি’ (আইপিইএফ) উন্মোচন করেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের মতো বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশসহ এক ডজন দেশ স্বাক্ষর করেছে। জো বাইডেন বলেছেন, এই দেশগুলো একটি অর্থনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
তবে আইপিইএফ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ একে বাণিজ্য চুক্তি না বলে একটি ‘উদ্যোগ’ বা ‘ব্যবস্থা’ বলছে এবং যেসব দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে তাদের কাউকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যথেষ্ট প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না।
গত মাসের শুরুতে ওয়াশিংটনে জো বাইডেনের সঙ্গে এশিয়ার নেতাদের একটি শীর্ষ বৈঠকের পর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং বলেছেন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে এ চুক্তিতে অনেক কিছুই নেই। ওই চুক্তি (আইপিইএফ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আসিয়ানের (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস) দশটি দেশের মধ্যে সাতটি দেশ উপস্থিত ছিল। ভারতও ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যদিও ভারতের সঙ্গে এর আগের একটি বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে গেছে আমেরিকা। তবে এ চুক্তিকে একটি ‘নতুন শুরু’ বলেও উল্লেখ করেছেন লি সিয়েন লুং।
এটিই হচ্ছে লক্ষণীয় বিষয়। এশিয়ার নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ভাবিত নন। এমনকি আইপিইএফ যদি শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ না-ও হয়, তবু আলোচনার টেবিলে আঞ্চলিক বাণিজ্য কাঠামো জারি থাকার একটা মূল্য আছে। ছোট দেশের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর নেতার সঙ্গে সাধারণত কথা বলার সুযোগ পান না। সেদিক বিবেচনা করলে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ছোট দেশের নেতাগুলোর নিয়মিত কথা বলার একটা ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থাকাটাও জরুরি।
মার্কিন সাময়িকী টাইম এক প্রতিবেদনে লিখেছে, একবার আলোচনা শুরু হলে তা ১২ থেকে ১৮ মাস অবধি চলতে পারে। শুধু বাণিজ্যই নয়, প্রসঙ্গক্রমে আরও নানা বিষয় উঠে আসতে পারে আলোচনার টেবিলে। এশিয়ার দেশগুলো এ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকামি নিশ্চয় করবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম কেন তৈরি করতে গেল যুক্তরাষ্ট্র? বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বোঝাতে চায় যে তারা এশিয়ার দেশগুলোর উদ্বেগের ব্যাপারে খুবই মনোযোগী। তবে যে উদ্দেশ্যেই আমেরিকা এটি করে থাকুক না কেন, এর মাধ্যমে যদি চীনা প্রভাববলয় সীমিত করা যায়, তাহলে সেটি আখেরে ভালোই—এমনটা মনে করেন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশ্লেষক অ্যারন কনেলি।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, আইপিইএফের একটি আশাব্যাঞ্জক দিক আছে। এর মাধ্যমে এশীয় অঞ্চলে কার্বন নিঃসরণ, ডিজিটাল অর্থনীতি, ট্যাক্স সংগ্রহ, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলার একটি পরিবেশ তৈরি হবে।
তবে এসব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আইপিইএফের সঙ্গে যুক্ত হয়নি তাইওয়ান, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার ও চীন। যদিও জো বাইডেন বলেছেন, ‘তাদের সদস্য হওয়ার ভবিষ্যৎ রাস্তা খোলা আছে।’ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাট বলেছে, আসিয়ানের এই পাঁচটি দেশ শেষ পর্যন্ত আইপিইএফে যোগ দেয় কি না, তা জানার জন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
যদিও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতেই পারে। যেমন জার্মান ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজের (জিআইজিএ) একজন গবেষণা ফেলো মোহাম্মদবাগের ফোরুগ বলেছেন, ‘আইপিইএফ ফলপ্রসূ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে বিশ্বায়নবিরোধী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে এবং অন্য বাণিজ্যিক উদ্যোগগুলোর সঙ্গে আইপিইএফকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র কী এসব উদ্যোগ নেবে? কিংবা এশিয়ার দেশগুলো কি ‘স্পিকটি নট’ অবস্থান থেকে সরে এসে কথা বলা শুরু করবে? এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আপাতত আইপিইএফকে শুধু একটা ‘কথা বলার দোকান’ হিসেবেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। আর এশিয়ার দেশগুলোর নেতাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, ‘কথা না বলাই ভালো’ নীতিকে মেনেই নিয়েছেন তাঁরা!
হককথা/এমউএ