ইসরায়েলের পক্ষে প্রচার চালাতে তহবিল গড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি ব্যবসায়ী
- প্রকাশের সময় : ০৯:০১:৩৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৩
- / ৬৭ বার পঠিত
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধের দাবিতে লন্ডনে বিক্ষোভ করেন কয়েক লাখ মানুষ। লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১১ নভেম্বরছবি: এএফপি
হককথা ডেস্ক : ইসরায়েলের পক্ষে প্রচারণা চালাতে কয়েক লাখ ডলারের তহবিল গড়ে তুলছেন যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ও আবাসন ব্যবসায়ী ব্যারি স্টার্নলিক্ট। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি মানুষের সহানুভূতি আদায়ের পাশাপাশি হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন তিনি। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে যখন লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করছেন, তখন ইসরায়েলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের।
এই প্রচারণার নাম দেওয়া হয়েছে, ফ্যাক্টস ফর পিস। তহবিলের জন্য গণমাধ্যম, আর্থিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে কয়েক লাখ ডলার অনুদান চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিমাফর এই তথ্য জানিয়েছে।
ফোর্বস সামিয়কীর ২০২২ সালের বিশ্বের শীর্ষ ইহুদি ব্যবসায়ীদের তালিকায় ৯১ নম্বরে নাম রয়েছে ব্যারি স্টার্নলিক্টের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্ম নেওয়া এই ব্যবসায়ীর সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৪৭০ কোটি যুক্তরাষ্ট্রের ডলার।
তহবিলের জন্য ৫০ জনের বেশি ব্যবসায়ীর কাছে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুগলের সাবেক সিইও এরিক স্মিথ, ডেলের সিইও মাইকেল ডেল ও ধুনকুবের মাইকেল মিলকেন। তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার।
তহবিল গঠনে সহায়তাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনপন্থীদের হুমকি দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিল অকম্যান ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের সংগঠনকে কালোতালিকাভুক্ত করার হুমকি দিয়েছেন। গত ১০ অক্টোবর বিল অকম্যান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লিগের (আটটি বিশ্ববিদ্যালয় এর আওতাভুক্ত) যেসব শিক্ষার্থী গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলের বিপক্ষে লেখা খোলা চিঠিতে সই করেছেন, তাঁদের বহিষ্কার চান তিনি ও অন্য ব্যবসায়ীরা।
বয়ান তৈরি করে এগিয়ে চল
ব্যারি স্টার্নলিস্টের এই প্রকল্প ইসরায়েলকে ‘বয়ান তৈরির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে’ সাহায্য করবে। কারণ, গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের পর বিশ্ববাসী তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর বিত্তশালীদের কাছে একটি ই-মেইল পাঠান ব্যারি স্টার্নলিক্ট। ওই ই-মেইলে তিনি ইসরায়েলকে সহায়তা করতে বিত্তশালীদের অনুরোধ করেন।
ব্যারি স্টার্নলিক্ট ই-মেইলে লিখেছেন, ‘বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার চিত্র বাস্তব কিংবা হামাসের বানোয়াট, যা-ই হোক না কেন। তা অবশ্যই জনমতে প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ইসরায়েলের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের বর্তমান সহানুভূতি হ্রাস করবে।’
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। এরপর গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার ১৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার শিশু। হামলায় বাস্ত্যুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলের হামলায় গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েলের পক্ষে স্টার্নলিক্টের প্রচারণার উদ্দেশ্য হলো, হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দেওয়া। তিনি ই-মেইলে লিখেছেন, ‘হামাস শুধু ইসরায়েলের নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও শত্রু।’
ব্যক্তিগত অনুদানের মাধ্যমে পাঁচ কোটি ডলারের তহবিল গড়ে তুলতে চাইছেন উদ্যোক্তারা। ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে। এই তহবিলে কে কে অনুদান দিয়েছেন, সেটি জানা যায়নি। তবে প্রচারণা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ ডলার তোলা হয়েছে।
প্রকল্পটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন যোগাযোগ–বিশেষজ্ঞ জশ ব্লাস্তো। তিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর চাক শুমার ও নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর সঙ্গে কাজ করেছেন।
ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী বৈশ্বিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর ইসরায়েলকে শত শত কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক সমর্থনও দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় তীব্র মানবিক সংকটের পরেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করছে তারা। ২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ইসরায়েলের জন্য ১৪ বিলিয়ন ডলার জরুরি সহায়তা অনুমোদন করে।
তবে ইসরায়েলের পক্ষে নিজেদের অবস্থান নিয়ে জনসমর্থন কমছে যুক্তরাষ্ট্রে। সম্প্রতি এপির এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেভাবে হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে ভূমিকা রাখছেন, তাতে প্রায় অর্ধেক ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন নেই।
ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক ও এক্সের (সাবেক টুইটার) মতো প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফিলিস্তিনের পক্ষে লেখাগুলোর ব্যবহারকারীদের কাছে যাতে কম পৌঁছায়, সেই ব্যবস্থা নিচ্ছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিকটকে ইসরায়েলপন্থী পোস্টের চেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট চার গুণ বেশি ভিউ হয়। গাজা উপত্যকায় প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছেন অসংখ্য বেসামরিক মানুষ। ভয়াবহ এই দৃশ্য বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।
ফ্যাক্টস ফর পিস-এই প্রচারণার মাধ্যমে স্টার্নলিক্ট ইসরায়েলের পক্ষে জনসমর্থন ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। ফ্যাক্টস ফর পিসের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও পোস্ট করে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জন্য হামাসকে দায়ী করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইসরায়েল গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, সেটিও অস্বীকার করা হচ্ছে।
ফ্যাক্টস ফর পিসের ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্ট করা ভিডিওতে লেখা হয়েছে, ইসরায়েল কোনো জাতিবিদ্বেষি রাষ্ট্র নয়।
ফ্যাক্টস ফর পিসের এই বক্তব্য জাতিসংঘসহ ফিলিস্তিন, ইসরায়েল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনুসন্ধানে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল দখল করা অঞ্চলে গভীরভাবে বৈষম্যমূলক দ্বৈত আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতিবিদ্বেষ চর্চা করছে।
ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা দখল করে। তবে ২০০৫ সালে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে তারা। কিন্তু তখন থেকে তারা গাজা উপত্যকা অবরুদ্ধ করে রাখে। অন্যদিকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি বাড়াতে থাকে। যদিও এই ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে বেআইনি।
হককথা/নাছরিন