নিউইয়র্ক ০৬:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বিক্ষোভে ‘স্বাগত’ জানালেন লাখ লাখ নারী : দিনভর ওয়াশিংটন ডিসি ছিল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে পরিপূণ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৫৪:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জানুয়ারী ২০১৭
  • / ৭৯৬ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার (২০ জানুয়ারী) হোয়াইট হাউসে তাঁর প্রথম রাত কাটিয়েছেন। শনিবার সকালে উঠে তাঁকে নিজ গৃহের উঠানে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়। একাধিক নারী সংগঠনের আহ্বানে কয়েক লাখ নারী এদিন ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রায় দুই মাইল দীর্ঘ এক শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় মিলিত হন। একই দিন সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছোট-বড় আরও ৬০০ পদযাত্রায় লাখ লাখ নারী-পুরুষ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর নতুন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে মিলিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশ্বের অনেক দেশে নারীরা বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের সবার বক্তব্য, ট্রাম্প ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি ছড়াচ্ছেন। সমানাধিকার থেকে জলবায়ু পরিবর্তন সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন অধিকাংশ প্রশ্নে ট্রাম্পের অবস্থান তাঁদের স্বার্থবিরোধী। শুক্রবার অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় ও সারা দিন ওয়াশিংটন ডিসি ছিল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে পরিপূর্ণ। অনুষ্ঠান কেন্দ্রের বাইরে ও ট্রাম্পের চোখের আড়ালে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষে ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
শনিবারের ‘নারী পদযাত্রা’র উদ্যোক্তারা প্রথমে ভেবেছিলেন দুই লাখের মতো নারী-পুরুষ এই প্রতিবাদ সমাবেশ অংশ নেবেন। সকাল ১০টায় হোয়াইট হাউসের কাছে ন্যাশনাল মল-এ জমায়েত শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর অনেক আগেই হাজার হাজার মানুষে এলাকাটি ভরে ওঠে। ১০টার আগেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখে দাঁড়াতে পারে। এর আগের দিন এই উন্মুক্ত উদ্যানেই ট্রাম্পের অভিষেকে অংশগ্রহণকারী দর্শকেরা জমায়েত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে দল বেঁধে নারীরা এসেছেন। তাঁদের কেউ বাসে, কেউবা রেল ও বিমানে। আগের রাতে যাঁরা এসে পৌঁছেছেন, তাঁদের অনেকে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের বাসায় রাত যাপন করেন। সমাবেশে আগত মানুষের ভিড়ে ওয়াশিংটনের পাতালরেল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
Trump Otth_Protestএই সমাবেশকে ‘ট্রাম্পের প্রতি প্রতিবাদপত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী নারী, যাঁদের অধিকাংশ শ্বেতকায়, তাঁদের অনেকের মাথায় ছিল নিজেদের বোনা গোলাপি রঙের হ্যাট, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুসি হ্যাট’। এক ভিডিও টেপে ট্রাম্প কোনো বাধা ছাড়াই মেয়েদের যৌনাঙ্গে হাত দিতে পারেন বলে দম্ভোক্তি করেছিলেন, তার প্রতিবাদেই এই ‘পুসি হ্যাট’। সমাবেশ ও পদযাত্রায় বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘ঘৃণা নয় ভালোবাসা’, ‘তুমি আমার প্রেসিডেন্ট নও’, ‘দেয়াল নয়, সেতু’ ইত্যাদি। কোনো কোনোটিতে ট্রাম্পকে সরাসরি আক্রমণ করেও শ্লোগান ছিল।
এই পদযাত্রায় যাঁরা অংশ নেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, গায়িকা কেটি পেরি, নারী অধিকারকর্মী ও লেখিকা গ্লোরিয়া স্টাইনহ্যাম, অভিনেত্রী জুলিয়ান মোর ও স্কারলেট ইয়োহানসন। হিলারি ক্লিনটন সমাবেশে থাকতে পারেননি, তবে এক টুইটার বার্তায় পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এই বার্তায় তিনি লেখান, ‘আমাদের মূল্যবোধের জন্য উঠে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা ও মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ’। সমাবেশে সিনেটর এলিজাবেথ ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, তাঁর কর্মসূচি নারীবিরোধী, সাধারণ মানুষবিরোধী। তিনি বলেন, ‘শুধু ধনকুবেরদের জন্য নয়, আমরা সব মার্কিনের জন্য সমতা ও সম্মানের দাবি জানাতে এখানে এসেছি।’
দিনের অপর প্রধান প্রতিবাদ সমাবেশটি হয় নিউইয়র্কে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের কাছে ড্যাগ হ্যামারশোল্ড প্লাজায় কয়েক হাজার নারী সমবেত হন। তাঁদের হাতে ধরা সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল, ‘তুমি আমার প্রেসিডেন্ট নও’।
এদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুক্রবার দুটি ভিন্ন নির্বাহী আদেশে ওবামা আমলের নীতিমালা বদলানো শুরু হয়েছে। প্রথম নির্বাহী আদেশটি ছিল ওবামা আমলে ঘোষিত স্বাস্থ্যবিমা আইন বাতিলের প্রথম পদক্ষেপ। এই নির্দেশে ওবামা কেয়ার নামে পরিচিত বিমা আইনের মাধ্যমে যেসব নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা বাতিলের ব্যাপারে সরকারি দপ্তরগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়।
একই দিন স্বাক্ষরিত অপর নির্বাহী নির্দেশে ট্রাম্প ওবামা আমলে গৃহীত গৃহ ক্রয় ঋণের ওপর প্রিমিয়াম হ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করেন। এই প্রিমিয়াম হ্রাসের ফলে যাঁরা ব্যাংক থেকে দুই লাখ ডলারের ঋণে বাড়ি কিনছেন, তাঁরা প্রত্যেকে মাসে প্রিমিয়ামে ২৯ ডলার করে রেয়াত পাচ্ছিলেন। ফেডারেল হাউজিং অথরিটি জানিয়েছে, এই নির্বাহী আদেশের ফলে এসব ঋণ গ্রাহক বার্ষিক ৫০০ ডলারের বেশি প্রিমিয়াম দিতে বাধ্য হবেন। মাসের হিসাবে খুব বড় অঙ্কের না হলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নেও ওবামা আমলের গৃহীত নীতিমালা পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প জলবায়ু প্রশ্নে প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে হোয়াইট হাউসের নতুন ওয়েবসাইট থেকে বর্তমান প্রশাসন কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবে, তার তালিকা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন কেটে ফেলা হয়েছে। ওবামা আমলে আরও যেসব তালিকাভুক্ত অগ্রাধিকারের বিষয় এই ওয়েবসাইট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, সমকামীদের সমানাধিকার ও নাগরিক অধিকার। ‘পরিষ্কার পানি আইন’, যার অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের জলাশয়গুলো নিয়ন্ত্রিত হয়, ট্রাম্প প্রশাসন তা বাতিল করতে পারে বলে একাধিক সূত্র থেকে বলা হয়েছে।
ট্রাম্প অভিবাসন প্রশ্নে কী ব্যবস্থা নেন, অনেকেই সে ব্যাপারে নজর রাখছেন। শুক্রবার তাঁর অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প এই প্রশ্নে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে সেদিন দুপুরে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণের সময় তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ডেমোক্রেটিক সিনেটর ডিক ডারবান জানিয়েছেন, ভোজের সময় তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে ওবামার আমলে ঘোষিত ‘ডাকা কর্মসূচি’ নিয়ে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষিত এই কর্মসূচির অধীনে প্রায় ৮ লাখ কম বয়স্ক অবৈধ অভিবাসীকে অস্থায়ী বৈধতা দেওয়া হয়। ডারবান জানিয়েছেন, কর্মসূচিটি বাতিল না করার অনুরোধ জানালে ট্রাম্প মন্তব্য করেন, তিনি এসব তরুণকে (ট্রাম্পের কথায় ‘কিডস’) আহত করতে চান না।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেও ট্রাম্প এখনো পুরোপুরি প্রশাসনিক দায়িত্বে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। তার প্রধান কারণ, এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভা গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত মার্কিন সিনেট তাঁর মনোনীত মাত্র দুই মন্ত্রীর ব্যাপারে তাদের সম্মতি জানিয়েছে। তাঁরা হলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জেনারেল ম্যাটিস ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রী হিসেবে জেনারেল জন কেলি। কাল সোমবারের আগে অন্য কোনো মন্ত্রীর প্রশ্নে সিনেটে ভোট গ্রহণের সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যে ট্রাম্প-মনোনীত যেসব প্রার্থী সিনেটের সামনে শুনানির সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ বিভিন্ন নৈতিক প্রশ্নে ডেমোক্রেটিক সিনেটরদের কঠোর সমালোচনার মুখে। তাঁদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী, নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব কীভাবে বিযুক্ত করবেন, সিনেটররা সে প্রশ্নে উদ্বিগ্ন।
শুধু তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা নন, ট্রাম্প নিজেকে কীভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বিযুক্ত রাখেন, সেই ব্যাপারটি এখনো স্পষ্ট নয়। ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন থেকে তাঁর দুই ছেলে দেখাশোনা করবেন। তিনি তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। তবে নিজের ব্যবসায়ে তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ তিনি সরিয়ে নেবেন না। এর ফলে গুরুতর ‘স্বার্থ সংঘাত’ দেখা দিতে পারে এই যুক্তিতে গত শুক্রবার সিটিজেন্স ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিকস নামের একটি সংগঠন সরকারের জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে নালিশ জানিয়েছে। তিনি এখনো ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁর ট্রাম্প হোটেল নানাভাবে ব্যবহার করছেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও ট্রাম্প শুধু তাঁর নিজের নন, তাঁর স্ত্রীর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করবেন, সে কথারও প্রমাণ মিলেছে। হোয়াইট হাউসের নতুন ওয়েবসাইটে মেলানিয়া ট্রাম্পের যে পরিচিতি তুলে ধরা হয়, তাতে নতুন ফার্স্ট লেডির সমাজসেবামূলক কাজকর্মের ফিরিস্তি দেওয়া ছাড়াও তিনি নিজের নামে যেসব গয়না বাজারজাত করে থাকেন, তার পূর্ণ তালিকা ছিল। পরে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ায় ওয়েবসাইট থেকে সে অংশটুকু মুছে ফেলা হয়। (প্রথম আলো)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

বিক্ষোভে ‘স্বাগত’ জানালেন লাখ লাখ নারী : দিনভর ওয়াশিংটন ডিসি ছিল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে পরিপূণ

প্রকাশের সময় : ০৭:৫৪:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জানুয়ারী ২০১৭

নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার (২০ জানুয়ারী) হোয়াইট হাউসে তাঁর প্রথম রাত কাটিয়েছেন। শনিবার সকালে উঠে তাঁকে নিজ গৃহের উঠানে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়। একাধিক নারী সংগঠনের আহ্বানে কয়েক লাখ নারী এদিন ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রায় দুই মাইল দীর্ঘ এক শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় মিলিত হন। একই দিন সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছোট-বড় আরও ৬০০ পদযাত্রায় লাখ লাখ নারী-পুরুষ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর নতুন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে মিলিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশ্বের অনেক দেশে নারীরা বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের সবার বক্তব্য, ট্রাম্প ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি ছড়াচ্ছেন। সমানাধিকার থেকে জলবায়ু পরিবর্তন সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন অধিকাংশ প্রশ্নে ট্রাম্পের অবস্থান তাঁদের স্বার্থবিরোধী। শুক্রবার অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় ও সারা দিন ওয়াশিংটন ডিসি ছিল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে পরিপূর্ণ। অনুষ্ঠান কেন্দ্রের বাইরে ও ট্রাম্পের চোখের আড়ালে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষে ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
শনিবারের ‘নারী পদযাত্রা’র উদ্যোক্তারা প্রথমে ভেবেছিলেন দুই লাখের মতো নারী-পুরুষ এই প্রতিবাদ সমাবেশ অংশ নেবেন। সকাল ১০টায় হোয়াইট হাউসের কাছে ন্যাশনাল মল-এ জমায়েত শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর অনেক আগেই হাজার হাজার মানুষে এলাকাটি ভরে ওঠে। ১০টার আগেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখে দাঁড়াতে পারে। এর আগের দিন এই উন্মুক্ত উদ্যানেই ট্রাম্পের অভিষেকে অংশগ্রহণকারী দর্শকেরা জমায়েত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান থেকে দল বেঁধে নারীরা এসেছেন। তাঁদের কেউ বাসে, কেউবা রেল ও বিমানে। আগের রাতে যাঁরা এসে পৌঁছেছেন, তাঁদের অনেকে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের বাসায় রাত যাপন করেন। সমাবেশে আগত মানুষের ভিড়ে ওয়াশিংটনের পাতালরেল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
Trump Otth_Protestএই সমাবেশকে ‘ট্রাম্পের প্রতি প্রতিবাদপত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী নারী, যাঁদের অধিকাংশ শ্বেতকায়, তাঁদের অনেকের মাথায় ছিল নিজেদের বোনা গোলাপি রঙের হ্যাট, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুসি হ্যাট’। এক ভিডিও টেপে ট্রাম্প কোনো বাধা ছাড়াই মেয়েদের যৌনাঙ্গে হাত দিতে পারেন বলে দম্ভোক্তি করেছিলেন, তার প্রতিবাদেই এই ‘পুসি হ্যাট’। সমাবেশ ও পদযাত্রায় বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘ঘৃণা নয় ভালোবাসা’, ‘তুমি আমার প্রেসিডেন্ট নও’, ‘দেয়াল নয়, সেতু’ ইত্যাদি। কোনো কোনোটিতে ট্রাম্পকে সরাসরি আক্রমণ করেও শ্লোগান ছিল।
এই পদযাত্রায় যাঁরা অংশ নেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, গায়িকা কেটি পেরি, নারী অধিকারকর্মী ও লেখিকা গ্লোরিয়া স্টাইনহ্যাম, অভিনেত্রী জুলিয়ান মোর ও স্কারলেট ইয়োহানসন। হিলারি ক্লিনটন সমাবেশে থাকতে পারেননি, তবে এক টুইটার বার্তায় পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এই বার্তায় তিনি লেখান, ‘আমাদের মূল্যবোধের জন্য উঠে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা ও মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ’। সমাবেশে সিনেটর এলিজাবেথ ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, তাঁর কর্মসূচি নারীবিরোধী, সাধারণ মানুষবিরোধী। তিনি বলেন, ‘শুধু ধনকুবেরদের জন্য নয়, আমরা সব মার্কিনের জন্য সমতা ও সম্মানের দাবি জানাতে এখানে এসেছি।’
দিনের অপর প্রধান প্রতিবাদ সমাবেশটি হয় নিউইয়র্কে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের কাছে ড্যাগ হ্যামারশোল্ড প্লাজায় কয়েক হাজার নারী সমবেত হন। তাঁদের হাতে ধরা সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল, ‘তুমি আমার প্রেসিডেন্ট নও’।
এদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুক্রবার দুটি ভিন্ন নির্বাহী আদেশে ওবামা আমলের নীতিমালা বদলানো শুরু হয়েছে। প্রথম নির্বাহী আদেশটি ছিল ওবামা আমলে ঘোষিত স্বাস্থ্যবিমা আইন বাতিলের প্রথম পদক্ষেপ। এই নির্দেশে ওবামা কেয়ার নামে পরিচিত বিমা আইনের মাধ্যমে যেসব নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা বাতিলের ব্যাপারে সরকারি দপ্তরগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়।
একই দিন স্বাক্ষরিত অপর নির্বাহী নির্দেশে ট্রাম্প ওবামা আমলে গৃহীত গৃহ ক্রয় ঋণের ওপর প্রিমিয়াম হ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করেন। এই প্রিমিয়াম হ্রাসের ফলে যাঁরা ব্যাংক থেকে দুই লাখ ডলারের ঋণে বাড়ি কিনছেন, তাঁরা প্রত্যেকে মাসে প্রিমিয়ামে ২৯ ডলার করে রেয়াত পাচ্ছিলেন। ফেডারেল হাউজিং অথরিটি জানিয়েছে, এই নির্বাহী আদেশের ফলে এসব ঋণ গ্রাহক বার্ষিক ৫০০ ডলারের বেশি প্রিমিয়াম দিতে বাধ্য হবেন। মাসের হিসাবে খুব বড় অঙ্কের না হলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নেও ওবামা আমলের গৃহীত নীতিমালা পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প জলবায়ু প্রশ্নে প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে হোয়াইট হাউসের নতুন ওয়েবসাইট থেকে বর্তমান প্রশাসন কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবে, তার তালিকা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন কেটে ফেলা হয়েছে। ওবামা আমলে আরও যেসব তালিকাভুক্ত অগ্রাধিকারের বিষয় এই ওয়েবসাইট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, সমকামীদের সমানাধিকার ও নাগরিক অধিকার। ‘পরিষ্কার পানি আইন’, যার অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের জলাশয়গুলো নিয়ন্ত্রিত হয়, ট্রাম্প প্রশাসন তা বাতিল করতে পারে বলে একাধিক সূত্র থেকে বলা হয়েছে।
ট্রাম্প অভিবাসন প্রশ্নে কী ব্যবস্থা নেন, অনেকেই সে ব্যাপারে নজর রাখছেন। শুক্রবার তাঁর অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প এই প্রশ্নে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে সেদিন দুপুরে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণের সময় তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ডেমোক্রেটিক সিনেটর ডিক ডারবান জানিয়েছেন, ভোজের সময় তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে ওবামার আমলে ঘোষিত ‘ডাকা কর্মসূচি’ নিয়ে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষিত এই কর্মসূচির অধীনে প্রায় ৮ লাখ কম বয়স্ক অবৈধ অভিবাসীকে অস্থায়ী বৈধতা দেওয়া হয়। ডারবান জানিয়েছেন, কর্মসূচিটি বাতিল না করার অনুরোধ জানালে ট্রাম্প মন্তব্য করেন, তিনি এসব তরুণকে (ট্রাম্পের কথায় ‘কিডস’) আহত করতে চান না।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেও ট্রাম্প এখনো পুরোপুরি প্রশাসনিক দায়িত্বে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। তার প্রধান কারণ, এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভা গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত মার্কিন সিনেট তাঁর মনোনীত মাত্র দুই মন্ত্রীর ব্যাপারে তাদের সম্মতি জানিয়েছে। তাঁরা হলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জেনারেল ম্যাটিস ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রী হিসেবে জেনারেল জন কেলি। কাল সোমবারের আগে অন্য কোনো মন্ত্রীর প্রশ্নে সিনেটে ভোট গ্রহণের সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যে ট্রাম্প-মনোনীত যেসব প্রার্থী সিনেটের সামনে শুনানির সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ বিভিন্ন নৈতিক প্রশ্নে ডেমোক্রেটিক সিনেটরদের কঠোর সমালোচনার মুখে। তাঁদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী, নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব কীভাবে বিযুক্ত করবেন, সিনেটররা সে প্রশ্নে উদ্বিগ্ন।
শুধু তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা নন, ট্রাম্প নিজেকে কীভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বিযুক্ত রাখেন, সেই ব্যাপারটি এখনো স্পষ্ট নয়। ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন থেকে তাঁর দুই ছেলে দেখাশোনা করবেন। তিনি তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। তবে নিজের ব্যবসায়ে তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ তিনি সরিয়ে নেবেন না। এর ফলে গুরুতর ‘স্বার্থ সংঘাত’ দেখা দিতে পারে এই যুক্তিতে গত শুক্রবার সিটিজেন্স ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিকস নামের একটি সংগঠন সরকারের জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে নালিশ জানিয়েছে। তিনি এখনো ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁর ট্রাম্প হোটেল নানাভাবে ব্যবহার করছেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও ট্রাম্প শুধু তাঁর নিজের নন, তাঁর স্ত্রীর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করবেন, সে কথারও প্রমাণ মিলেছে। হোয়াইট হাউসের নতুন ওয়েবসাইটে মেলানিয়া ট্রাম্পের যে পরিচিতি তুলে ধরা হয়, তাতে নতুন ফার্স্ট লেডির সমাজসেবামূলক কাজকর্মের ফিরিস্তি দেওয়া ছাড়াও তিনি নিজের নামে যেসব গয়না বাজারজাত করে থাকেন, তার পূর্ণ তালিকা ছিল। পরে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ায় ওয়েবসাইট থেকে সে অংশটুকু মুছে ফেলা হয়। (প্রথম আলো)