ট্রাম্পের বিভাজিত আমেরিকা

- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৬:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই ২০১৭
- / ১২৩৪ বার পঠিত
ঢাকা: ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবসে আমেরিকানরা ঐক্যবদ্ধ হয়। হওয়ারই কথা। ১৩টি নবীন উপনিবেশ কিভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের পথে মহাযাত্রা শুরু করেছিল এই দিনটিতে আমেরিকানরা তারই উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এবারের ৪ জুলাই আমেরিকানরা মূলত বিভাজিত থেকে গেছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান এই দুই ভাগে তো বটেই, এমনকি কারখানা শ্রমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গ্রামবাসী এবং শহরবাসীÑ এভাবেও বিভক্ত হয়ে গেছে। তার ওপর আছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি আমেরিকার বিভাজনের লক্ষণ শুধু নন এর অন্যতম কারণও বটে।
ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন অংশত এই কারণে যে, তিনি সেই সব ভোটারের পক্ষে কথা বলেছেন, যারা মনে করে প্রচলিত ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ওয়াশিংটনকে এলিট ও লবিস্টদের প্রভাবমুক্ত করে তিনি গোটা জাতির পক্ষে কাজ করবেন। আমেরিকার রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করবেন।
কিন্তু ট্রাম্পের কৌশল কাজ করছে না। তিনি ক্ষমতায় আসার ৬ মাস হয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে তিনি এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন যা তার ক্ষমতা গ্রহণের সময়কার বিরাজমান সংস্কৃতির চেয়েও বিষাক্ত। তার মূল ভোটাররা তার প্রতি লক্ষণীয় রকমের অনুগত। ব্যবসায়ী মহলের অনেকেই বিশ্বাস করে যে ট্রাম্প কর হ্রাস করবেন, সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবেন। কিন্তু তাদের এই আশাবাদ অনেক দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। ট্রাম্পের শাসনকাল ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও সুযোগ হাতছাড়া করার অসংখ্য ঘটনায় জর্জরিত। ফেডারেল সরকারের ওপর চাপ বা ধকল সৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। শীঘ্র হোক, বিলম্বে হোক এই ক্ষতিটা বেষ্টনীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে অর্থনীতিকে গ্রাস করবে।
প্রচলিত রাজনীতির ওপর আমেরিকানদের বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে গেছে। সেটা যে ট্রাম্পকে দিয়ে শুরু হয়েছে তা নয়। কয়েক দশক ধরে ভোটাররা অভিযোগ করে এসেছে যে ওয়াশিংটনে এলিট ও লবিস্টদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এমন এক জট সৃষ্টি করেছে, সরকার সেই প্লট থেকে বেরিয়ে এসে সামনে এগোতে পারছে না। শুধু সাধারণ ভোটাররা নয়, অনেক বিত্তবানও এমন অভিযোগ করেছে। রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা এই অবক্ষয়ের জন্য ‘ভেটোক্রেসি’কে দায়ী করেছেন। ভেটোক্রেসি হলো পরস্পরবিরোধী স্বার্থ ও দায়িত্বের এমন এক জট যা প্রায় যে কোন ধরনের উচ্চাভিলাষী সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, বিশ্বে যখন পরিবর্তনের জোয়ার বইছে এবং ফেডারেল সরকার তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উপযুক্ততা অর্জন করতে পারছে না, তখন ভোটারদের মোহচ্যুতি বাড়তেই থাকে। তাদের অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা বেড়ে চলে।
এই অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতায় স্বয়ং ট্রাম্পও ইন্ধন যুগিয়েছেন। তিনি ঠিকভাবেই সেই সব গোত্র চিহ্নিত করেছেন যেখানে আমেরিকার সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সংস্কারের কাজে হাত দিতে গিয়ে নিজেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। এর জন্য অবশ্য তার অসংযত অহম্বোধও অংশত দায়ী। করের কথাই ধরা যাক, আমেরিকার করবিধি যে এক জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছে তাতে কারোর সন্দেহ নেই। শুধু জটিলতাই নয়, এর মধ্যে অসংখ্য ফাঁক-ফোকরও আছে। কিন্তু ট্রাম্পের কর সংস্কার পরিকল্পনাটি ধনীদের কর হ্রাসের ব্যবস্থায় পর্যবসিত হওয়ার সার্বিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ফলে করবিধি যেমনি জগাখিচুড়ি ও হেঁয়ালিপূর্ণ ছিল, তাই থেকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা। ওবামা কেয়ার সংস্কার করার পরিবর্তে রিপাবলিকানরা এখন এমন এক বিলের ব্যাপারে একজোট হয়েছে, যার পরিণতিতে ট্রাম্পের নিজেরই লাখ লাখ ভোটার আরও অসুস্থ ও দরিদ্র হয়ে পড়বে।
আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ছে বিপন্ন। হোয়াইট হাউস সঠিকভাবেই অভিযোগ করেছে যে, আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থা পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে ও আবার তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চলছে। এই অবস্থার কারণে ওবামার শাসনামলে লালফিতার যথেষ্ট দৌরাত্ম্য দেখা দেয়। কিন্তু ট্রাম্প তার এই ‘প্রশাসনিক রাজ্যের’ সংস্কারের চেষ্টা করতে গিয়ে সরকারী শাসনযন্ত্রটিকেই ভেঙ্গে ফেলছেন সেটা সচল ও সক্রিয় থাকা প্রয়োজন।
ট্রাম্পের বৈরী ভূমিকার কারণে ইতোমধ্যে আদালতগুলো, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, পররাষ্ট্র দফতর ও পরিবেশ দফতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে চান এবং প্রেসিডেন্টের যে সব পদে লোক নিয়োগ দেয়ার কথা তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা হিসাব করে দেখছে যে, ৫৬২টি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ৩৯০টি পদে এখনও পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
একই রকমের ক্ষতিকর ব্যাপার হলো ট্রাম্পের কাজ করার ধরন বা পদ্ধতি। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প অস্বীকার করেছিলেন যে তিনি বিশেষ স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়বেন। কিন্তু তার যে সমাধান পদ্ধতি সেটা কোন সমাধান নয়। কারণ, তিনি এমন সব ধনী ব্যবসায়ীকে নিয়োগ দিয়েছেন যাদের লবিস্টরা সহজেই কিনে নিতে পারে। ট্রাম্পের নিজের কথাই ধরা যাক, প্রেসিডেন্ট পদ ও তার পারিবারিক ব্যবসাকে তিনি আলাদা করার দায়সারা চেষ্টা করেছেন। কোথায় কোনটা শুরু হচ্ছে, কোনটা শেষ হচ্ছে কেউ জানে না। তার বিভিন্ন কেলেঙ্কারি এবং নির্বাচনী প্রচারে রাশিয়ার ভূমিকা সংক্রান্ত নানা তথ্য ফাঁস হওয়ার বিভিন্ন দলের মধ্যে সহযোগিতার সম্ভাবনা আরও সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ মহলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সংস্কারে কংগ্রেস বাজেট অফিসের সমালোচনা ওয়াশিংটনকে আরও বেশি পক্ষপাতদুষ্ট করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ট্রাম্পের সত্যের প্রতি অবমাননা বিভিন্ন দলের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দুর্বল করে ফেলছে।
আশাবাদীরা বলেন, আমেরিকা এত বৈচিত্র্য, এত সম্পদ, এত মেধা ও সৃজনশীল ক্ষমতার আধার যে সমাজের এগিয়ে চলার পথে এসব কিছুকে সইতে পারে। আমেরিকার ইতিহাসে ট্রাম্পই যে প্রথম মন্দ প্রেসিডেন্ট মোটেই তা নয়। হয়ত তিনি মাত্র ৪ বছরের জন্য ক্ষমতায় আছেন। ফেডারেল ব্যবস্থায় কেন্দ্রের অযোগ্যতা ও ত্রুটিপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে রাজ্য ও বড় বড় নগরী যোগ্যতার আধার হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমেরিকার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বলিষ্ঠ। শেয়ার বাজারগুলো প্রায় সর্বকালের চাঙ্গা অবস্থায় আছে। বিশ্বের প্রযুক্তি ও অর্থলগ্নিতে দেশটি প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এর তেল ও গ্যাস উৎপাদকরা ১৯৭০-এর দশক পরবর্তী যে কোন সময়ের তুলনায় অধিক স্বাচ্ছন্দ্যকর অবস্থায় আছে।
এ সবই হলো বিরাট শক্তি। কিন্তু ওয়াশিংটনে যে ক্ষতি সাধিত হয়ে চলেছে এগুলোর দ্বারা তা লাঘব করা যেতে পারে মাত্র, তার বেশি নয়। ক্ষতির প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। স্বাস্থ্য সেবার সংস্কারে অর্থনীতির এক ষষ্ঠাংশ প্রভাবিত হয়। সন্দেহ ও অবিশ্বাস যা কিছুকে স্পর্শ করে সেটাকেই সায় করে ফেলে। যোগ্যতম আমেরিকানরা যদি পাবলিক সার্ভিসের ক্যারিয়ার বর্জন করে, তাহলে আমলাতান্ত্রিক গায়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হবে। একজন মন্দ প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকলে অনেক অশুভ পরিণতি সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে তাই হতে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান একচেটিয়া ক্ষমতা ও দৌরাত্ম্য বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়া হচ্ছে। অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধি কাজের প্রকৃতির যেখানে রূপান্তর ঘটিয়ে দিতে যাচ্ছে, সেখানে স্কুলগুলোর লেখাপড়া ও ট্রেনিংয়ের মান নিচে নেমে যাচ্ছে। সমালোচকদের তীব্র আক্রমণ সত্ত্বেও এটা সম্ভব যে ট্রাম্প ৮ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। সেক্ষেত্রে অযোগ্যতা ও অকর্মণ্যতার মূল বিশাল আকার ধারণ করতে পারে।
বিপদটা ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পরিষ্কার হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি যেসব কা-কারখানা করছেন তাতে আমেরিকান নেতৃত্বের স্থায়ী ক্ষতি হতে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এশিয়ায় আমেরিকার মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাটি সুরক্ষিত করত এবং এর সামরিক জোটগুলো শক্তিশালী হতো। ট্রাম্প তা থেকে সরে এসেছেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে বিশ্বকে তিনি এমন একটা ফোরাম হিসেবে দেখেন না যেখানে বিভিন্ন দেশ সমস্যা সমাধানের জন্য একত্রে বসে কাজ করতে পারে, বরং এটাকে এমন এক ক্ষেত্র হিসেবে দেখেন যেখানে দেশগুলো নিজেদের সুবিধা হাসিলের জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। তার ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং স্বৈরাচারীদের সঙ্গে মাখামাখি থেকে মিত্রদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সঙ্কটের সময় তার ওপর নির্ভর করা যায় কি-না। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট। (দৈনিক জনকন্ঠ)