অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোয় উন্নতি
- প্রকাশের সময় : ১২:২৫:১৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৮৪ বার পঠিত
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে সাময়িক ধীরগতি দেখা গেলেও নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই পাল্টে গেছে অবস্থা। বর্তমানে অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি সূচকে উন্নতি দেখা গেছে। তৈরি পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাড়ছে, প্রবাসী আয়-রফতানি আয় বেড়েছে। টানা পাঁচ মাস ধরে কমছে মূল্যস্ফীতি। রাজস্ব আদায় বেড়েছে ও ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, অর্থনীতিতে কিছু সংকট থাকলেও বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উন্নয়নের পথে ফিরতে শুরু করেছে। সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সচিবালয়ে তিনি বলেন, আমরা সঠিক পথে ফিরেছি, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর রাতারাতি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। সে জন্য কিছুটা সময় লাগবে।
টানা ৫ মাস ধরে মুদ্রাস্ফীতি কমছে
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় কষ্ট পেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তবে আশার কথা, ধীরে ধীরে জিনিসপত্রের দাম কমে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, টানা পাঁচ মাস ধরে কমে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে। ডিসেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে, যা আগের সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছেছিল, যা ছিল ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এদিকে অর্থ বিভাগের চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাজারে মুদ্রা প্রবাহ কমিয়ে আনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে এসেছে। আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ হার বেশ কয়েক দফায় বাড়িয়েছে এবং ঋণের সুদ হারের বেঁধে দেওয়ার সীমাও তুলে দিয়েছে।
বাড়ছে রাজস্ব আদায়
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবার প্রায় ২০ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে।
মূলত ১০ লাখ টাকা বা এরচেয়েও বেশি মূসক পরিশোধে ই-পেমেন্ট বা চালান বাধ্যতামূলক করা, ই-টিডিএস সিস্টেমের মাধ্যমে উৎসে কর কর্তন, ক্রমান্বয়ে তিন লাখ মেশিন স্থাপনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি, থার্ড পার্টি ডাটা ব্যবহার করে নতুন করদাতা শনাক্তসহ নানা উদ্যোগের ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।
বাজেট ঘাটতি কমছে
প্রথম প্রান্তিকে বাজেট ঘাটতি না হয়ে বরং উদ্বৃত্ত হয়েছে। এ সময় ঘাটতি বাজেট পূরণে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ না নিয়ে পরিশোধ করা হয় ৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ শোধ করা হয় ৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ না নিয়ে আগের নেওয়া ঋণ থেকে ৩৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। অর্থবছরের ওই সময়ে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়েছিল ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আগের ঋণের স্থিতি থেকে ১৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে নিয়েছিল ১১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আগের ঋণের স্থিতি থেকে পরিশোধ করেছে ২৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। নন-ব্যাংক খাত থেকে অর্থবছরের ওই সময়ে নিয়েছিল ২৫ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে নিয়েছে ৬ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। বৈদেশিক খাত থেকে অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে ঋণ নিয়েছিল ১৭ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা
তৈরি পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাড়ছে
পোশাক খাতের উদ্যোক্তা বলেছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউর বাজার থেকে প্রচুর অর্ডার পাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রচলিত বাজারের ওপর অতি নির্ভরতাও কাটতে শুরু করেছে। রফতানিতে নতুন বাজারের হিস্যাও বাড়ছে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পে নতুন এক রূপান্তরের ঢেউ লেগেছে।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ক্রয়াদেশ বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। এ কারণে পোশাক রফতানির অর্ডার বাড়ছে। তারা বলছেন, আগামী মাসগুলোতে আরও বেশি অর্ডার পাবেন।
প্রবাসী আয় বাড়ছে
চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে প্রবাসীরা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২০১ কোটি ডলার বা ২ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। একক মাস হিসেবে জানুয়ারিতে আসা রেমিট্যান্স ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগের মাস ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি এবং জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির প্রবণতা এখনও চলমান। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ৯ দিনে প্রবাসীরা ৬৩ কোটি ১৭ লাখ যুক্তরাষ্ট্রের ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে আসছে ৭ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স।
রফতানি আয়ে রেকর্ড
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট রফতানি মূল্য সদ্য বিদায়ী জানুয়ারিতে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে।
ইপিবির হিসাবে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। অর্থবছরের ডিসেম্বরে রফতানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কম। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি- সাত মাসে রফতানি ছিল ৩২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৭ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের (৪.৯৭ বিলিয়ন) পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। পোশাক রফতানির ইতিহাসে একক মাস হিসেবে এটাই সর্বোচ্চ। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি পোশাক রফতানি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র মুখপাত্র ও পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, একটি খুশির খবর হলো—একক মাস হিসেবে পোশাক রফতানিতে এই প্রথম ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি মাইলফলক স্পর্শ করেছে এই খাত। বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দিকটি হলো—আমরা ধীরে ধীরে আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হচ্ছি এবং অত্যাধুনিক আইটেমগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যা আয় বৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।
ব্যাংকে আমানত বাড়ছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা—যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের সুদ বাড়ার কারণে আমানতের সুদ হার বেড়ে গেছে। আর আমানতের সুদ হার বাড়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন সুদ আয়-নির্ভর আমানতকারীরা।
কমেছে খেলাপি ঋণ
এদিকে ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমেছে। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় নেমেছে। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো আদায় জোরদার, পুনঃতফসিল, অবলোপনসহ বিভিন্ন উপায়ে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন।