পাঠদান ও মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ অভিভাবকদের
- প্রকাশের সময় : ০৮:২২:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
- / ১২৭ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক :তিন শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের ১০ মাস চলছে। বছরের শেষ পর্যায়ে এসেও সবকিছুতেই ধোঁয়াশা দেখছেন অভিভাবকরা। আর নতুন কারিকুলামে সন্তুষ্ট নন শিক্ষকরাও।
শিক্ষকরা বলছেন, এই কারিকুলামে অনেক সমস্যা-অসংগতি। ভয়ে কারিকুলাম নিয়ে কিছু বলতে পারছি না। আমাদের নির্ভয়ে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই কারিকুলামের অসংগতি নিয়ে কথা বলতে চাই। আর অভিভাবকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে ভালো করছে, কোন বিষয়ে খারাপ করছে তা জানার সুযোগ নেই। স্মৃতিশক্তি বিকাশের কোনোই সুযোগ নেই এই কারিকুলামে।
কারিকুলামের নানা অসংগতি তুলে ধরে নানা সমালোচনা চলছেই। এর মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে শিক্ষা প্রশাসন। এই মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
চলতি বছর থেকে দেশে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হচ্ছে। শুরুতেই প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয়েছে এই নতুন শিক্ষাক্রম। আগামী শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম এবং নবম শ্রেণিতে যুক্ত হবে। ২০২৫ সালে যুক্ত হবে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণি। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণি। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের জন্য সরকার ৭৫টি নির্দেশনা জারি করে। এই নির্দেশনা পালন হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
‘ষষ্ঠ শ্রেণির প্রজেক্টের অংশ হিসাবে এক শিক্ষার্থী ছোট ও অসাধারণ একটি কাঠের ঘর তৈরি করে নিয়ে আসে। ঘরটি দেখে আমরা অবাক হই। কীভাবে সুন্দর করে ঐ শিক্ষার্থী এটি করল। কিন্তু শিক্ষার্থী জানাল, এই ঘরটি তার এক চাচা কাঠের কাজ করেন, তিনিই তৈরি করে দিয়েছেন। এমন তথ্য দিয়ে এক শিক্ষক জানালেন তাহলে শিক্ষার্থী কী শিখল। তিনি জানান, এভাবে বিভিন্ন শ্রেণিতে প্রজেক্টের অংশ হিসাবে খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বাইরের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনে। অথবা বাসায় মা বা কোনো আত্মীয় তৈরি করেন। এতে শিক্ষার্থীর কী লাভ হলো। অভিভাবকদের অর্থের অপচয়ই হলো।
আরিফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীদের দলগতভাবে প্রজেক্ট দেওয়া হয়। কিন্তু একটি শ্রেণিতে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলে তা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ৩০ জন শিক্ষার্থী থাকলে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্ভব। বাংলাদেশে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে প্রতি শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ৬০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত।
কারিকুলামের পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে বেশি অভিযোগ অভিভাবকদের। বিশেষ করে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির দুর্বোধ্যতার কারণে অভিভাবকরা নতুন এই কারিকুলামের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে। ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি সূচকের মাধ্যমে করা ট্রান্সক্রিপ্ট যখন অভিভাবকরা হাতে পাচ্ছেন তার সন্তান মেধাবিকাশের
কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ধারণ করতে পারছেন না। স্কুলে কী পড়ছে বা বাসায় কী পড়াতে হবে তা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে অভিভাবকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন। তারা মনে করছেন, আগের কারিকুলামই ভালো ছিল। অভিভাবকদের কাছে এই কারিকুলামের বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে মত দিয়েছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষকরা বলছেন, নতুন কারিকুলামে প্রাকটিক্যালের পাশাপাশি থিওরিতেও গুরুত্ব খুবই কম। শিক্ষার্থীরা প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে। আবার কিছুদিন পর সেটা ভুলে যাচ্ছে। এই প্রেজেন্টেশন মনে রাখার জন্য এই কারিকুলামে কোনো দিকনির্দেশনা পায়নি। এছাড়া লিখতে গিয়ে তারা প্রচুর বানান ভুল করছে। শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে যা জানছে তা পরবর্তীকালে মনে রাখতে পারছে না। শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নতুন কারিকুলামে সৃজনশীলতায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কিন্তু স্মৃতিশক্তি বিকাশে যাতে সমান দক্ষ হতে পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা নেই। একজন শিক্ষার্থী একটি শ্রেণিতে যা জানছে বা শিখছে তা যেন পরবর্তী শ্রেণিতে ওঠার পরও মনে রাখতে পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা নেই।
অভিভাবক আমিরুল ইসলাম বলেন, নতুন কারিকুলামে প্রায়ই প্রজেক্ট বানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। শিক্ষা উপকরণ হাতের কাছে না পাওয়া, সেই সঙ্গে চড়া দামের কারণে এগুলো কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। বিশেষ করে মফস্বল এলাকার অভিভাবকরা এগুলোর জোগান দিতে পারছেন না। ফলে দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা ঝরে পড়ছে আগের তুলনায় অনেক বেশি।
শিক্ষকরা বলছেন, নতুন এই কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষকরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি। শিক্ষক নয়ন ইসলাম বলেন, যারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারও শিক্ষকদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। কারণ, তারাও বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি।
অভিভাবক নজরুল আমিন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কারিকুলাম কীভাবে বাস্তবায়ন ভালো হবে তা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা দরকার। হাতেগোনা কয়েক জনের হাতে নিয়ন্ত্রণ রেখে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন কঠিন হবে। গ্রামের চিত্র আরও ভয়াবহ। কারিকুলাম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকদেরও।
সম্প্রতি সম্মিলিত বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এই কারিকুলামের বেশ কিছু দুর্বল দিক তুলে ধরে বলেছে, গ্রামের স্কুলগুলোতে এই শিক্ষাক্রম পুরোটাই অগ্রহণযোগ্য। তারা নতুন কারিকুলাম সংস্কার বা বাতিল করা, ৫০-৬০ নম্বরের অন্তত দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখা, ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি ইনডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখা, শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের সব ব্যয় স্কুলের বহন করা এবং স্কুল পিরিয়ডেই সব প্রজেক্ট সম্পন্ন করা, শিক্ষার্থীদের দলগত কাজে ডিভাইসমুখী হতে অনুৎসাহিত করা, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদে উত্থাপন করার দাবি জানিয়েছে।
যদিও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, কারিকুলামের নানান দিক বুঝে উঠতে আমাদের সময় লাগবে। শিক্ষকদেরও অভ্যস্ত হয়ে ওঠার জন্য কিছুটা সময় লাগবে। অভিভাবকদেরও সময় লাগবে।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক