নিউইয়র্ক ০৪:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

পঁয়ত্রিশেই মেসির সেরা বিশ্বকাপ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৫৭ বার পঠিত

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক! কাতারে তাঁর শুরুটা হয়েছিল চোটের গুঞ্জনে। সঙ্গে বয়সের ভার যোগ হয়ে যেন তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অগস্ত্যযাত্রার প্রতীক। এরপর মাঠের খেলা শুরু হতেই সব শঙ্কা উড়িয়ে তিনি হয়ে গেছেন আর্জেন্টিনার শুভযাত্রার প্রতীক। ইতিহাস গড়ার কারিগর।

আগের চারটি বিশ্বকাপে হবে-হচ্ছে করেও হয়নি। এবার অন্য চিত্র। পঁয়ত্রিশের মেসিকেই মনে হচ্ছে বিশ্বকাপের সেরা। কাতার যেন তাঁর জন্য সেজেগুজে বসেও আছে!
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে তরুণ লিওনেল মেসির খ্যাতি তখনো আর্জেন্টিনা ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী উপচে পড়েনি। বয়স সবে ১৮ পেরিয়েছে। হোসে পেকারম্যানের দলে ১৯ নম্বর জার্সি গায়ে বেঞ্চ গরম করার ফাঁকে ফাঁকে মাঠে নামেন বদলি হয়ে। সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনেগ্রোর বিপক্ষে গ্রুপের ম্যাচে ৭৫ মিনিটে বিশ্বকাপ অভিষেক হওয়া এই তরুণ ৮৮ মিনিটে কার্লোস তেভেজের পাসটি জালে পাঠিয়ে প্রথম নাম তোলেন স্কোরশিটে। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার আগে আর কিছু নেই।

দারুণ কিছু হওয়ার কথা ছিল চার বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকায় মেসি-ম্যারাডোনার জুটিতে। বার্সেলোনা মাতানো ‘খুদে জাদুকরের’ সঙ্গে আর্জেন্টাইন ‘ফুটবল ঈশ্বরের’ স্বপ্নের জুটি হওয়ার কথা। হতে পারত, কারণ দলের ভেতর সব রসদই ছিল। কিন্তু কোচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা কোচিংয়ের চেয়ে বরং নিজের খেপাটে চরিত্রটাকেই নিয়ে আসেন সামনে। অনায়াসে গ্রুপ পর্ব পেরোনোর পর লিওনেল গোলের দেখা পান শেষ ষোলোতে, ৩-১ গোলে মেক্সিকো জয়ের ম্যাচে। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ আবার জার্মানি এবং ৪-০ গোলে হারের ভরাডুবি।

চার বছর বাদে বার্সেলোনা তখন লিওনেল মেসির জাদুতে মোহগ্রস্ত। সপ্তাহান্তে গোলের সুরভি ছড়িয়ে তিনি ফুটবলের অপূর্ব মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছেন ফুটবলবিশ্বকে। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাঁর সেই ফুটবল মাধুরী দিয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলকে সুরভিত করেছিলেন আলেহান্দ্রো সাবেয়া। এই কোচ মেসিকে কেন্দ্রে রেখে দল সাজিয়ে তৈরি করেছিলেন সাফল্যের রসায়ন। সেটা কার্যকরও হয়েছিল। গ্রুপ ম্যাচে চার গোলের পর তিনি আর গোল পাননি। তবে কারিগরি সহযোগিতা ছিল ঠিকই। ফাইনালে কড়া মার্কিংয়ে থেকেও তৈরি করে দিয়েছিলেন কয়েকটি সুযোগ। কিন্তু সতীর্থরা শিরোপার তীরে ভেড়াতে পারেননি তরি। সেই জার্মানিতে আটকে গিয়ে মেসির কান্নায় শেষ হয় আর্জেন্টিনার শিরোপাস্বপ্ন।

এরপর হোর্হে সাম্পাওলির অধীনে শুরু হয় দুঃস্বপ্নের রাশিয়া মিশন। তার আগে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ খেলা হবে কি না, সে নিয়ে তুমুল সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বাছাই পর্বে। কিটোয় ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির হ্যাটট্রিকে সব সংশয় উড়িয়ে রাশিয়ার টিকিট কাটে আকাশি-হলুদের দল। এরপর ব্রোনিতসি শহরে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে আর্জেন্টিনা এবং রাতারাতি সেটি হয়ে ওঠে এক গুজবের শহর। কোচ সাম্পাওলির নানা পাগলামিতে নানা গুজবের বাতাবরণ। ৩১ বছরের মেসির সঙ্গে তারাভরা আর্জেন্টিনার আকাশ। কে, কোন পজিশনে, কিভাবে খেলে সবই জানা ব্যাপার। এর পরও সবার পজিশন বদলে সাম্পাওলি ওই শহরে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর অদ্ভুতুড়ে ফুটবলের পরীক্ষাগার। শেষে মেসি-আগুয়েরোর চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি পরীক্ষায় ক্ষ্যামা দিলেও বিশ্বকাপযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেননি। এমবাপ্পের ফ্রান্সেই শেষ মেসির বিশ্বকাপ।

বয়সের হিসাব করলে ওটাই লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ হওয়ার কথা। ৩৫ বছরের ফুটবলারের কী আর দেওয়ার থাকে! আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমও তাঁকে সাজিয়েছিলেন মাঠের মনোবল হিসেবে, উপস্থাপন করেছিল অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে। যেন দলের তারুণ্য উজ্জীবিত হবে তাঁর উপস্থিতিতে। কিন্তু সেমিফাইনালের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে দেখি—রোজারিওর ছোট ছেলেটি এখন অন্য মানুষ। রীতিমতো ‘সুপারম্যান’! বয়স যেন একটুও কেড়ে নিতে পারেনি। নিজে গোল করছেন, গোল করাচ্ছেন, আবার প্রতিপক্ষের সঙ্গে গিয়ে ঝগড়াও করছেন! অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ শেষে বলেছিলেন এই পঁয়ত্রিশেও দারুণ বিশ্বকাপ উপভোগের কথা, ‘আমি দারুণ উপভোগ করছি। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছি। আমার অভিজ্ঞতা ও বয়সের কারণে সব কিছুই অন্যভাবে দেখছি। আমরা মাঠে খেলছি আর সমর্থকরা পাগল হয়ে উপভোগ করছে, উৎসাহ দিচ্ছে—এটা ভীষণ আনন্দের। আশা করি, এই কোলাহল শেষ পর্যন্ত থাকবে। ’

কিন্তু গোল বাধিয়েছেন লুই ফন হাল। হঠাৎ কোয়ার্টার ফাইনালের আগে এই ডাচ কোচ আবিষ্কার করেন, ‘মেসি দাঁড়িয়ে থাকে। ’ এখন ক্রোয়েশিয়ান কোচও একই গীত গাইছেন। আলবিসেলেস্তে সমর্থকরাও তাঁদের সঙ্গে একমত। তাদের বিশ্বাস জোরালো হয়ে গেছে, ‘মেসি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলেও হবে। ’ কেউ দাঁড়িয়ে খেলে যদি সেরা হতে পারে, দলকে শিরোপা জেতাতে পারে, তখন আর দৌড়ানোরই বা দরকার কী! বিশ্বকাপে ১০ গোল করা লিওনেলের খেলার ধরনই তো এমন, সেই ব্রাজিল বিশ্বকাপে যেমন দাঁড়িয়ে খেলতে দেখেছিলাম, এখনো তা-ই খেলছেন। শুধু বয়সটা একটু বেড়েছে। বোধ হয় পঁয়ত্রিশেই সেরা বিশ্বকাপ খেলার মনস্থির করেছেন লিওনেল মেসি।

 

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

পঁয়ত্রিশেই মেসির সেরা বিশ্বকাপ

প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক! কাতারে তাঁর শুরুটা হয়েছিল চোটের গুঞ্জনে। সঙ্গে বয়সের ভার যোগ হয়ে যেন তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অগস্ত্যযাত্রার প্রতীক। এরপর মাঠের খেলা শুরু হতেই সব শঙ্কা উড়িয়ে তিনি হয়ে গেছেন আর্জেন্টিনার শুভযাত্রার প্রতীক। ইতিহাস গড়ার কারিগর।

আগের চারটি বিশ্বকাপে হবে-হচ্ছে করেও হয়নি। এবার অন্য চিত্র। পঁয়ত্রিশের মেসিকেই মনে হচ্ছে বিশ্বকাপের সেরা। কাতার যেন তাঁর জন্য সেজেগুজে বসেও আছে!
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে তরুণ লিওনেল মেসির খ্যাতি তখনো আর্জেন্টিনা ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী উপচে পড়েনি। বয়স সবে ১৮ পেরিয়েছে। হোসে পেকারম্যানের দলে ১৯ নম্বর জার্সি গায়ে বেঞ্চ গরম করার ফাঁকে ফাঁকে মাঠে নামেন বদলি হয়ে। সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনেগ্রোর বিপক্ষে গ্রুপের ম্যাচে ৭৫ মিনিটে বিশ্বকাপ অভিষেক হওয়া এই তরুণ ৮৮ মিনিটে কার্লোস তেভেজের পাসটি জালে পাঠিয়ে প্রথম নাম তোলেন স্কোরশিটে। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার আগে আর কিছু নেই।

দারুণ কিছু হওয়ার কথা ছিল চার বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকায় মেসি-ম্যারাডোনার জুটিতে। বার্সেলোনা মাতানো ‘খুদে জাদুকরের’ সঙ্গে আর্জেন্টাইন ‘ফুটবল ঈশ্বরের’ স্বপ্নের জুটি হওয়ার কথা। হতে পারত, কারণ দলের ভেতর সব রসদই ছিল। কিন্তু কোচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা কোচিংয়ের চেয়ে বরং নিজের খেপাটে চরিত্রটাকেই নিয়ে আসেন সামনে। অনায়াসে গ্রুপ পর্ব পেরোনোর পর লিওনেল গোলের দেখা পান শেষ ষোলোতে, ৩-১ গোলে মেক্সিকো জয়ের ম্যাচে। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ আবার জার্মানি এবং ৪-০ গোলে হারের ভরাডুবি।

চার বছর বাদে বার্সেলোনা তখন লিওনেল মেসির জাদুতে মোহগ্রস্ত। সপ্তাহান্তে গোলের সুরভি ছড়িয়ে তিনি ফুটবলের অপূর্ব মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছেন ফুটবলবিশ্বকে। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাঁর সেই ফুটবল মাধুরী দিয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলকে সুরভিত করেছিলেন আলেহান্দ্রো সাবেয়া। এই কোচ মেসিকে কেন্দ্রে রেখে দল সাজিয়ে তৈরি করেছিলেন সাফল্যের রসায়ন। সেটা কার্যকরও হয়েছিল। গ্রুপ ম্যাচে চার গোলের পর তিনি আর গোল পাননি। তবে কারিগরি সহযোগিতা ছিল ঠিকই। ফাইনালে কড়া মার্কিংয়ে থেকেও তৈরি করে দিয়েছিলেন কয়েকটি সুযোগ। কিন্তু সতীর্থরা শিরোপার তীরে ভেড়াতে পারেননি তরি। সেই জার্মানিতে আটকে গিয়ে মেসির কান্নায় শেষ হয় আর্জেন্টিনার শিরোপাস্বপ্ন।

এরপর হোর্হে সাম্পাওলির অধীনে শুরু হয় দুঃস্বপ্নের রাশিয়া মিশন। তার আগে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ খেলা হবে কি না, সে নিয়ে তুমুল সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বাছাই পর্বে। কিটোয় ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির হ্যাটট্রিকে সব সংশয় উড়িয়ে রাশিয়ার টিকিট কাটে আকাশি-হলুদের দল। এরপর ব্রোনিতসি শহরে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে আর্জেন্টিনা এবং রাতারাতি সেটি হয়ে ওঠে এক গুজবের শহর। কোচ সাম্পাওলির নানা পাগলামিতে নানা গুজবের বাতাবরণ। ৩১ বছরের মেসির সঙ্গে তারাভরা আর্জেন্টিনার আকাশ। কে, কোন পজিশনে, কিভাবে খেলে সবই জানা ব্যাপার। এর পরও সবার পজিশন বদলে সাম্পাওলি ওই শহরে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর অদ্ভুতুড়ে ফুটবলের পরীক্ষাগার। শেষে মেসি-আগুয়েরোর চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি পরীক্ষায় ক্ষ্যামা দিলেও বিশ্বকাপযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেননি। এমবাপ্পের ফ্রান্সেই শেষ মেসির বিশ্বকাপ।

বয়সের হিসাব করলে ওটাই লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ হওয়ার কথা। ৩৫ বছরের ফুটবলারের কী আর দেওয়ার থাকে! আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমও তাঁকে সাজিয়েছিলেন মাঠের মনোবল হিসেবে, উপস্থাপন করেছিল অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে। যেন দলের তারুণ্য উজ্জীবিত হবে তাঁর উপস্থিতিতে। কিন্তু সেমিফাইনালের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে দেখি—রোজারিওর ছোট ছেলেটি এখন অন্য মানুষ। রীতিমতো ‘সুপারম্যান’! বয়স যেন একটুও কেড়ে নিতে পারেনি। নিজে গোল করছেন, গোল করাচ্ছেন, আবার প্রতিপক্ষের সঙ্গে গিয়ে ঝগড়াও করছেন! অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ শেষে বলেছিলেন এই পঁয়ত্রিশেও দারুণ বিশ্বকাপ উপভোগের কথা, ‘আমি দারুণ উপভোগ করছি। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছি। আমার অভিজ্ঞতা ও বয়সের কারণে সব কিছুই অন্যভাবে দেখছি। আমরা মাঠে খেলছি আর সমর্থকরা পাগল হয়ে উপভোগ করছে, উৎসাহ দিচ্ছে—এটা ভীষণ আনন্দের। আশা করি, এই কোলাহল শেষ পর্যন্ত থাকবে। ’

কিন্তু গোল বাধিয়েছেন লুই ফন হাল। হঠাৎ কোয়ার্টার ফাইনালের আগে এই ডাচ কোচ আবিষ্কার করেন, ‘মেসি দাঁড়িয়ে থাকে। ’ এখন ক্রোয়েশিয়ান কোচও একই গীত গাইছেন। আলবিসেলেস্তে সমর্থকরাও তাঁদের সঙ্গে একমত। তাদের বিশ্বাস জোরালো হয়ে গেছে, ‘মেসি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলেও হবে। ’ কেউ দাঁড়িয়ে খেলে যদি সেরা হতে পারে, দলকে শিরোপা জেতাতে পারে, তখন আর দৌড়ানোরই বা দরকার কী! বিশ্বকাপে ১০ গোল করা লিওনেলের খেলার ধরনই তো এমন, সেই ব্রাজিল বিশ্বকাপে যেমন দাঁড়িয়ে খেলতে দেখেছিলাম, এখনো তা-ই খেলছেন। শুধু বয়সটা একটু বেড়েছে। বোধ হয় পঁয়ত্রিশেই সেরা বিশ্বকাপ খেলার মনস্থির করেছেন লিওনেল মেসি।