টরন্টো (কানাডা): মানুষ একে অপরের হৃদয়ে কতটা স্থান জুড়ে থাকে, তা হয়তো শব্দমালায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু ভাষার বহিঃপ্রকাশ কিছুটা হলেও সেখানে প্রবোধ, প্রশান্তি, প্রত্যাশা কিংবা অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে। গতকাল (৬ জানুয়ারী) সন্ধ্যায় এক অপরিচিত নম্বর থেকে হঠাৎ একটি ফোন এলো। যিনি ফোন করেছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনলাইন পত্রিকা হককথা’র সম্পাদক এবং টাইম টেলিভিশনের উপস্থাপক ¯েœহভাজন এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনি কী ব্যস্ত? ‘না’ বলতেই হৃদয়বিদারী সেই দুঃসংবাদটি দিলেন। বললেন ‘হাফিজ ভাই’ ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাকে ইন্তেকাল করেছেন। জুম্মার নামাজের পরই অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময়ই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাতে মুহূর্তে বেদনা আপ্লত কন্ঠে পড়লাম ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’। এরপরই টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এডভোকেট আতাউর রহমান খান আজাদকে ঘুমকাতর সকালে তা জানালাম। তিনিও শোকার্থ হলেন।
এই ‘হাফিজ ভাই’ আর কেউ নন, আমাদের অগ্রজ সাংবাদিক ও নিউইয়র্কের অনলাইন পত্রিকা হককথা’র সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হাফিজুর রহমান। শুধু তাই নয়, আশির দশকে দৈনিক দেশ পত্রিকায় তার অতুলনীয় লেখনী আমাদের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এখনও মনে পড়ে, টাঙ্গাইলের ঐতিহাসিক পুলিশ প্যারেড ময়দানের একাংশে যখন সরকার টিএন্ডটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়, সেটি রক্ষায় তিনি একটি আবেগঘন প্রতিবেদন লিখেছিলেন। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলে রাজধানী ঢাকার বাইরে একমাত্র এ ময়দানেই তিনি এসেছিলেন ১৯৭৪ সালের ১০ মে সপরিবারে। ওই প্রতিবেদনে ‘নজরুল সেনা’র কুঁচকাওয়াজের তালে কবিকে অভিবাদন জানানোর উল্লেখ ছিল। আমরা যারা ওই দৃশ্যটি মনে রেখেছি, তাদের কাছে বাকরুদ্ধ কবি সেদিন কুঁচকাওয়াজে ‘আইজ রাইট’ বলার মুহূর্তে ক্ষণিকের জন্য প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। তার অপলক, নির্বাক চোখ দৃষ্টিপান মেলে অস্ফূটকণ্ঠে যেন কিছু বলতে চেয়েছে, বলতে পারেনি! কেবল চেয়ারে বসে তিনি বিভিন্ন দলের কুঁচকাওয়াজ অবলোকন করেছেন। তাই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, ‘ওই ভবনটি নির্মাণ করা হলে শিশুকিশোরদের পদধ্বনিতে ময়দানটি আর কখনোই মুখরিত হবে না’। হয়েছেও তাই! পরবর্তীতে জাতীয় কবির স্মরণে গড়ে ওঠা নজরুল সেনা প্রতিষ্ঠানটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয়ে পরিণত হলেও সেটির অগ্নিবীণা, ধুমকেতু, অগ্রদূত, দোলনচাপা, কনকচাপা ও শতদলের বিশাল কুঁচকাওয়াজ কালক্রমে হারিয়ে গেছে। অথচ এক সময় এই নজরুল সেনা ঢাকা স্টেডিয়ামে জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসের সঙ্গে প্রতিযোগী হয়ে প্রথম অথবা দ্বিতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করত।
আরেকবার টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন তহবিল উত্তোলনের স্বার্থে ভাসানী হলটি মাসব্যাপী একটি যাত্রামঞ্চকে ইজারা দিলে সেখানে প্রিন্সেস লাকী খানের উদোম নৃত্য দেখতে সমাজপতিদের অনেকেই যেতেন এবং মদ্যপ অবস্থায় ভোরে ফিরতেন। এতে প্রতিবাদী হাফিজ ভাই মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খথান ভাসানীর স্ত্রী আলেমা ভাসানীর একটি সাক্ষাতকার সংবলিত প্রতিবেদন ছেপেছিলেন। তাতে কাজ হয়েছিল। এ দুটি প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গী ছিলাম বলে আজো তা স্মরণীয় হয়ে আছে।
হাফিজ ভাই যে কেবল সৎ, মেধাবী ও নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন তাই-ই নয়, বরং কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী চেতনা’ তার মাঝে ছিল চির প্রোথিত। সেই চেতনায় তিনি যেমন নজরুল সেনার অন্যতম সংগঠক ছিলেন, তেমনি টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক সমিতি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকাটি ছিল অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোককথা, সাপ্তাহিক দেশকথা ও লৌহজং পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক কামরুল হাসান চৌধুরীর অগ্রণী ভূমিকাটিও প্রণিধানযোগ্য এবং বরাবরের মতো এডভোকেট আতাউর রহমান খান আজাদ ছিলেন আমাদের সঙ্গবদ্ধতার প্রেরণাপূর্ণ উৎস।
আজ আমার বেদনা, যুক্তরাষ্ট্রে গত সেপ্টেম্বরে সপ্তাহকালের ভ্রমনে গিয়ে হাফিজ ভাইকে দেখে আসার ইচ্ছা থাকলেও নিজের মেয়ের অসুস্থতার কারণে তা আর হয়ে উঠেনি, যদিও মাসখানেক আগে ফোনে তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল। এখন তার সবটাই স্মৃতিগাঁথা, প্রবোধ ও প্রেরণা। তাই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি তার শোকসন্তপ্ত স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যার জন্য থাকলো আমাদের সকলের সমবেদনা ও সহমর্মিতা।
(দৈনিক আমাদের অর্থনীতি)