নিউইয়র্ক ০২:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

জিয়া : প্রতিকূল স্রোতের যাত্রী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৫:৪১:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০১৭
  • / ১৪৯০ বার পঠিত

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে সরকারি সফরে এসে আধিপত্যবাদী শত্রুর চক্রান্তে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি শাহাদত বরণ করেন। তার আকস্মিক মৃত্যুর পর সারা দেশের সব এলাকায়, পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে গ্রামে, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সড়কে দলমত নির্বিশেষে শোকের মাতম নেমে আসে। সেদিন দেশে এবং বিদেশে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে সেদিনই প্রমাণিত হয়েছিল, জিয়াউর রহমান মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন।
তার শাহাদত বরণের পর এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার শহীদ জিয়াকে বাংলাদেশের সেরা নেতা আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, জনগণকে সাহসী নেতৃত্ব দানের মধ্যে দিয়ে তিনি গোটা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বের প্রশংসা করে কার্টার আরো বলেছিলেন, ‘শুধু মুসলিম দেশ ও সমাজের মধ্যেই নয়, প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বসমাজে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমরা তার জন্য কৃতজ্ঞ।’
শহীদ জিয়াউর রহমান পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন সৈনিক হিসেবে। সৈনিক হিসেবে তার ছিল দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, সততা, নৈতিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলাবোধ। আধুনিক ও আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। সব পজেটিভ গুণের সমন্বয়েই তার ব্যক্তিচরিত্র গড়ে উঠেছিল। রাজনীতিতে পদার্পণের পর তার দর্শন ও কর্মে বহুমুখী প্রতিভার প্রতিফলন দেখা যায়। রাজনীতি ও ইতিহাসের শাস্ত্রীয় জ্ঞান এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাকে আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। রাজনীতির বলয়ে পদার্পণের পর দেশ ও সরকার পরিচালনায় দেশের মানুষের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে এবং অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংহত ও নিশ্চিতকরণে তিনি যেসব প্রাজ্ঞজনোচিত ও বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার সামগ্রিক বিচারে মনে হয়, শহীদ জিয়া ছিলেন রাজনীতি ও ইতিহাসের জ্ঞানসম্পন্ন একজন সার্থক জাতীয়তাবাদী নেতা।
প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সানাউল্লাহ নূরী শহীদ জিয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের কালের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান ছিলেন নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী পুরুষ। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে তিনি এক প্রচন্ড ঝড় সৃষ্টি করেছিলেন এ কথাটি তার বেলায় একমাত্র সত্য নয়। সেই ঝড়কে তিনি শান্ত, স্থিত এবং নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন। তাকে পরিণত করেছিলেন জনগণের শক্তিতে, বিশ্বাসে আর প্রত্যাশায়। এখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের স্বরূপ। অনন্য এই গুণটির জন্যই তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলেন। সত্তর এবং আশির দশকের ক্রান্তিকালে বিশ্বে যে ক’জন জননন্দিত নেতার সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি, জিয়া ছিলেন তাদের প্রথম সারির একজন। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে কিংবা নিছক ঈর্ষার কারণে যারা ছিলেন তার চরম বিরোধী তাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি তার উপস্থিতিকে অস্বীকার করা। সম্ভব হয়নি কারো পক্ষেই তার বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতিতে নতুন কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি করা।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। হঠাৎ এসে সবাইকে তিনি চমকে দিলেন। যেন বললেন- ‘আমি এসে গেছি। এখন আমাদের কথা তোমাদের শুনতে হবে’। সত্যি জিয়ার কথা সবাইকে শুনতে হলো। যারা সনাতন রাজনীতির পাকচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, এই নতুন মুখ থেকে তারা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। অনেকে চোখ কপালে তুললেন। বললেন- উজান ঠেলে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নদী পাড়ি দিতে চাইছে কে এই যুবক?’
অসাধারণ প্রতিভা এবং সাহস ছিল বলেই একজন সাধারণ মেজরের র‌্যাংকে অধিষ্ঠিত থেকে এত বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ একটি মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করার মনোবল তিনি দেখাতে পেরেছিলেন এবং সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেই যুদ্ধের অগ্রগামী নেতৃত্বের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।একজন দূরদর্শী সামরিক স্ট্র্যাটেজিশিয়ানের সব গুণই ওই বয়সে তার মধ্যে পরিস্ফুট হতে দেখা গেছে। সামরিক প্রতিভার সাথে রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীরতা অনুধাবনের ক্ষমতা এবং দূরদৃষ্টিরও সমাবেশ ঘটেছিল তার মধ্যে।
একেবারে শুরু থেকেই উজানের বিপদসঙ্কুল পথ ধরে যাত্রা শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে যাওয়ার রাজনীতিকে তিনি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কেননা, অনুকূল হাওয়ায় পাল তুলে দেয়ার নীতি ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘বিদ্রোহ’ বলা হয়, সেই অর্থে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিদ্রোহী। এর বড় প্রমাণ হলো- আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং সত্তর দশকের মধ্য পর্বের রাজনীতিতে তার ভূমিকার সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ‘উই রিভোল্ট’- ‘আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম,’ এই স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে শুরু হয়েছিল তার উজান পাড়ির পালা। মাঝখানে কিছুকাল বিরতি ঘটলেও বিদ্রোহের এ মশালটি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিষ্কম্প হাতে ধারণ করে রেখেছিলেন।
রাজনীতিতে শহীদ জিয়া ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা চারণ কবি যাকে বলে ‘পলিটিক্যাল পোয়েট’ ঘুণেধরা বস্তাপচা তথাকথিত রাজনীতিকে গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, জনগণের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের পক্ষে। ‘আমাদের পথ’ নামক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে, জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বোঝায় ধর্ম-বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মূল এ বিষয়টির সাথে জড়িয়ে আছে আরো আনুষঙ্গিক বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমেই এসবের সমাধান করতে হবে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ। তা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ যাতে থাকবে সততা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।
শহীদ জিয়া শুধু একটি নাম নয়, এ দেশের রাজনীতির একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায় তার নামের পরতে পরতে মিশে আছে। এ জাতি তাকে হারিয়েছে এমন এক সময়, যখন তারই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। ঘাতকের নির্মম আঘাতে তাকে ঝরে যেতে হয়েছে অসময়ে। কিন্তু তিনি বেঁচে রয়েছেন তার কর্মের মাধ্যমে, সৌকর্যের সৌরভে, গণতন্ত্রের দিশারিরূপে ও বাংলাদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় পরম গৌরবময় জাতীয় সম্পদ রূপে।
শহীদ জিয়া দেহগতভাবে আমাদের মাঝে নেই সত্য, কিন্তু তার সত্তা চিরজাগরুক রয়েছে আমাদের জাগতিক চেতনার মধ্যে। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার অবিস্মরণীয় কালজয়ী দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, যা আমাদের একটি মৌল রাষ্ট্রীয় জীবন দর্শন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব একটি একক চেতনারই অবিভাজ্য অংশ। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গোটা দেশকে তিনি কর্মযোগ আন্দোলনে নামিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। তার দর্শনের মধ্যে রয়েছে একটি শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা। এ বিপ্লব কর্মসূচি তিনি নিজে প্রণয়ন করেছেন।
শান্তিপূর্ণ বিপ্লব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করব, যাতে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উৎপাদনের ব্যবস্থা হয় এবং জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সে সুবিধা ভোগের সুযোগ পায়। কাজেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পুরো প্রক্রিয়া বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পারব তা প্রকৃতির নিয়মের মতোই আবর্তনশীল।
লেখক : সহ-প্রচার সম্পাদক, বিএনপি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

জিয়া : প্রতিকূল স্রোতের যাত্রী

প্রকাশের সময় : ০৫:৪১:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০১৭

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে সরকারি সফরে এসে আধিপত্যবাদী শত্রুর চক্রান্তে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি শাহাদত বরণ করেন। তার আকস্মিক মৃত্যুর পর সারা দেশের সব এলাকায়, পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে গ্রামে, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সড়কে দলমত নির্বিশেষে শোকের মাতম নেমে আসে। সেদিন দেশে এবং বিদেশে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে সেদিনই প্রমাণিত হয়েছিল, জিয়াউর রহমান মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন।
তার শাহাদত বরণের পর এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার শহীদ জিয়াকে বাংলাদেশের সেরা নেতা আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, জনগণকে সাহসী নেতৃত্ব দানের মধ্যে দিয়ে তিনি গোটা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বের প্রশংসা করে কার্টার আরো বলেছিলেন, ‘শুধু মুসলিম দেশ ও সমাজের মধ্যেই নয়, প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বসমাজে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমরা তার জন্য কৃতজ্ঞ।’
শহীদ জিয়াউর রহমান পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন সৈনিক হিসেবে। সৈনিক হিসেবে তার ছিল দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, সততা, নৈতিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলাবোধ। আধুনিক ও আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। সব পজেটিভ গুণের সমন্বয়েই তার ব্যক্তিচরিত্র গড়ে উঠেছিল। রাজনীতিতে পদার্পণের পর তার দর্শন ও কর্মে বহুমুখী প্রতিভার প্রতিফলন দেখা যায়। রাজনীতি ও ইতিহাসের শাস্ত্রীয় জ্ঞান এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাকে আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। রাজনীতির বলয়ে পদার্পণের পর দেশ ও সরকার পরিচালনায় দেশের মানুষের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে এবং অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংহত ও নিশ্চিতকরণে তিনি যেসব প্রাজ্ঞজনোচিত ও বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার সামগ্রিক বিচারে মনে হয়, শহীদ জিয়া ছিলেন রাজনীতি ও ইতিহাসের জ্ঞানসম্পন্ন একজন সার্থক জাতীয়তাবাদী নেতা।
প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সানাউল্লাহ নূরী শহীদ জিয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের কালের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান ছিলেন নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী পুরুষ। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে তিনি এক প্রচন্ড ঝড় সৃষ্টি করেছিলেন এ কথাটি তার বেলায় একমাত্র সত্য নয়। সেই ঝড়কে তিনি শান্ত, স্থিত এবং নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন। তাকে পরিণত করেছিলেন জনগণের শক্তিতে, বিশ্বাসে আর প্রত্যাশায়। এখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের স্বরূপ। অনন্য এই গুণটির জন্যই তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলেন। সত্তর এবং আশির দশকের ক্রান্তিকালে বিশ্বে যে ক’জন জননন্দিত নেতার সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি, জিয়া ছিলেন তাদের প্রথম সারির একজন। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে কিংবা নিছক ঈর্ষার কারণে যারা ছিলেন তার চরম বিরোধী তাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি তার উপস্থিতিকে অস্বীকার করা। সম্ভব হয়নি কারো পক্ষেই তার বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতিতে নতুন কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি করা।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। হঠাৎ এসে সবাইকে তিনি চমকে দিলেন। যেন বললেন- ‘আমি এসে গেছি। এখন আমাদের কথা তোমাদের শুনতে হবে’। সত্যি জিয়ার কথা সবাইকে শুনতে হলো। যারা সনাতন রাজনীতির পাকচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, এই নতুন মুখ থেকে তারা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। অনেকে চোখ কপালে তুললেন। বললেন- উজান ঠেলে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নদী পাড়ি দিতে চাইছে কে এই যুবক?’
অসাধারণ প্রতিভা এবং সাহস ছিল বলেই একজন সাধারণ মেজরের র‌্যাংকে অধিষ্ঠিত থেকে এত বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ একটি মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করার মনোবল তিনি দেখাতে পেরেছিলেন এবং সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেই যুদ্ধের অগ্রগামী নেতৃত্বের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।একজন দূরদর্শী সামরিক স্ট্র্যাটেজিশিয়ানের সব গুণই ওই বয়সে তার মধ্যে পরিস্ফুট হতে দেখা গেছে। সামরিক প্রতিভার সাথে রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীরতা অনুধাবনের ক্ষমতা এবং দূরদৃষ্টিরও সমাবেশ ঘটেছিল তার মধ্যে।
একেবারে শুরু থেকেই উজানের বিপদসঙ্কুল পথ ধরে যাত্রা শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে যাওয়ার রাজনীতিকে তিনি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কেননা, অনুকূল হাওয়ায় পাল তুলে দেয়ার নীতি ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘বিদ্রোহ’ বলা হয়, সেই অর্থে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিদ্রোহী। এর বড় প্রমাণ হলো- আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং সত্তর দশকের মধ্য পর্বের রাজনীতিতে তার ভূমিকার সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ‘উই রিভোল্ট’- ‘আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম,’ এই স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে শুরু হয়েছিল তার উজান পাড়ির পালা। মাঝখানে কিছুকাল বিরতি ঘটলেও বিদ্রোহের এ মশালটি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিষ্কম্প হাতে ধারণ করে রেখেছিলেন।
রাজনীতিতে শহীদ জিয়া ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা চারণ কবি যাকে বলে ‘পলিটিক্যাল পোয়েট’ ঘুণেধরা বস্তাপচা তথাকথিত রাজনীতিকে গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, জনগণের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের পক্ষে। ‘আমাদের পথ’ নামক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে, জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বোঝায় ধর্ম-বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মূল এ বিষয়টির সাথে জড়িয়ে আছে আরো আনুষঙ্গিক বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমেই এসবের সমাধান করতে হবে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ। তা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ যাতে থাকবে সততা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।
শহীদ জিয়া শুধু একটি নাম নয়, এ দেশের রাজনীতির একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায় তার নামের পরতে পরতে মিশে আছে। এ জাতি তাকে হারিয়েছে এমন এক সময়, যখন তারই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। ঘাতকের নির্মম আঘাতে তাকে ঝরে যেতে হয়েছে অসময়ে। কিন্তু তিনি বেঁচে রয়েছেন তার কর্মের মাধ্যমে, সৌকর্যের সৌরভে, গণতন্ত্রের দিশারিরূপে ও বাংলাদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় পরম গৌরবময় জাতীয় সম্পদ রূপে।
শহীদ জিয়া দেহগতভাবে আমাদের মাঝে নেই সত্য, কিন্তু তার সত্তা চিরজাগরুক রয়েছে আমাদের জাগতিক চেতনার মধ্যে। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার অবিস্মরণীয় কালজয়ী দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, যা আমাদের একটি মৌল রাষ্ট্রীয় জীবন দর্শন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব একটি একক চেতনারই অবিভাজ্য অংশ। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গোটা দেশকে তিনি কর্মযোগ আন্দোলনে নামিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। তার দর্শনের মধ্যে রয়েছে একটি শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা। এ বিপ্লব কর্মসূচি তিনি নিজে প্রণয়ন করেছেন।
শান্তিপূর্ণ বিপ্লব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করব, যাতে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উৎপাদনের ব্যবস্থা হয় এবং জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সে সুবিধা ভোগের সুযোগ পায়। কাজেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পুরো প্রক্রিয়া বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পারব তা প্রকৃতির নিয়মের মতোই আবর্তনশীল।
লেখক : সহ-প্রচার সম্পাদক, বিএনপি।