আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
- প্রকাশের সময় : ০৩:৫২:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০১৯
- / ৭৩৮ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার শামসুল হক ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রæয়ারী টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মাইঠান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি হঠাৎ করেই নিখোঁজ হন এবং ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ইন্তেকাল করেন। শামসুল হক গবেষণা পরিষদ অনেক খুঁজে মৃত্যুর ৪২ বছর পর ২০০৭ সালে টাঙ্গাইলে কালিহাতী উপজেলার কদিম হামজানিতে মরহুমের কবর আবিষ্কার করেন।
ভাষা সৈনিক শামসুল হক পূর্ব পাকিস্তানের সরকারবিরোধী রাজনীতিতে ছিলেন প্রথম সারির নেতা। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে তার অশেষ অবদান রয়েছে।
১৯৪৩ সালের শেষ দিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আবুল হাশিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীরা প্রায় সকলেই জয়লাভ করেন। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ শতকরা ৯৭ ভাগ আসনেই জয়লাভ করে। ওই সময় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্মিশিবিরের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুল হক। এ সব বিবেচনায় পাকিস্তান সৃষ্টিতে শামসুল হকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া সিলেটকে পাকিস্তানভুক্ত করার গণভোটে তার অবদান রয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্ররা সারা প্রদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেদিন সচিবালয়, নীলক্ষেত ও হাইকোর্টের সামনে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ঘটে। বহু ছাত্র আহত এবং গ্রেফতার হন। যে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সেদিন গ্রেফতার হন তাদের মাঝে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে ২৪ জুন ঢাকা রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের কর্মী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী ছিলেন এই দলের সভাপতি। শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে টাঙ্গাইলের দক্ষিণ মুসলিম কেন্দ্র থেকে মওলানা ভাসানীর সদস্য পদ বাতিল ঘোষণা এবং উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এই উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী। শামসুল হক তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রথম মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæযারী সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভার শুরুতে শামসুল হক সেখানে উপস্থিত হন। তিনি ছাত্রদের বোঝাতে চেষ্টা করেন ওই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়ার পরিণতি- যা ভবিষ্যৎ আন্দোলন ও অন্যান্য কাজের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। কিন্তু ছাত্ররা সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। ২১ ফেব্রæয়ারীর পর সরকার মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আবুল হাশিম, মনোরঞ্জন ধর, শামসুল হকসহ কয়েকজনকে জননিরাপত্তা আইনে গেগ্রফতার করে। ১৯৫৩ সালে শরীর ও মানসিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি মুক্তি পান।
১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন শামসুল হককে পথে পথে ঘুরতে দেখেছেন অনেকেই। তারপর হঠাৎ তিনি নিখোঁজ হন। এই নেতার নিখোঁজ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে রহস্যের সৃষ্টি হয়।
২০০৭ সালে তার নিখোঁজ রহস্য উন্মোচিত হয়। বলা হয়ে থাকে, ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোকারচর গ্রামের মহিউদ্দিন আনসারী (তৎকালীন নামকরা কংগ্রেস নেতা) কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোনো এক স্থান থেকে শামসুল হককে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন শামসুল হক শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়িতে ৭ দিন থাকার পর তার হঠাৎ খুব জ্বর হয়। স্থানীয় হোমিও চিকিৎসক শুকলাল দাস তার চিকিৎসা করেন। প্রচন্ড জ্বরে শামসুল হক ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে মারা যান।
সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন ‘আত্মস্মৃতি : সংগ্রাম ও জয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাকে (শামসুল হককে) আটক করা হয়। তখন তিনি বিবাহিত, একটি কন্যা সন্তানের পিতা। স্ত্রী নরসিংদীর সেকান্দার মাস্টার সাহেবের কন্যা আফিয়া খাতুন এমএ কলেজের লেকচারার। জেলখানায় শামসুল হকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। নিজ পরিবারের প্রতি তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। আফিয়া খাতুন তাকে ত্যাগ করেন। আফিয়া এখন পাকিস্তানে মিসেস আফিয়া দিল।
‘শামসুল হক সম্পূর্ণ বিকৃতমস্তিষ্ক অবস্থায় জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হকের চিকিৎসায় আওয়ামী মুসলিম লীগ কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল বলেও মনে পড়ে না। শামসুল হক ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন- কখনও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে টাকা ধার চাইতেন, কেউ সমাদর করলে আহার করতেন।’
‘টাঙ্গাইলের ওয়ার্টারলু বিজয়ী শামসুল হকের মৃত্যু কোথায় কি অবস্থায় হলো তার কোনো বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখিনি। শোকসভাও করেনি কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্যরা। অথচ এই শামসুল হক একদিন ছিলেন বাংলার তরুণ মুসলিম ছাত্রসমাজের প্রিয় নেতা- ১৯৫২ সালেও ভাষাসংগ্রামী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।’
দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ থেকে তার বহিষ্কার, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিখোঁজ হওয়া ও মৃত্যু রহস্য হয়েই ছিল। এর মধ্যেই ২০০৭ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতির কদিম হামজানিতে তার কবর আবিষ্কার হয়। একইসঙ্গে জোকারচরের জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দীন আনসারির বাড়িতে তার মৃত্যুর বিষয়টি প্রকাশিত হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রয়াত মহিউদ্দীন আনসারীর নাতি সেলিম আনসারী জানান, ১৯৬৫ সালে শামসুল হক তাদের বাড়িতেই মারা যান। তিনি জানান, বিপরীতমুখী রাজনীতি করলেও ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝিতে তার দাদা মহিউদ্দিন আনসারী কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোথাও থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ বন্ধু শামসুল হককে দেখে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শামসুল হকের তথ্য গোপনই থেকে যায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া এই নেতা ‘পাগলের মত’ জীবনযাপন করতেন। একসময়ের তীব্র জনপ্রিয় নেতা সামনে থাকলেও তাকে কেউই চিনতে পারেননি, এমনকি তার মৃত্যুও সেই রহস্য ভেদ করতে পারেনি।
বর্তমানে স্থানীয় শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত সেলিম আনসারী বলেন, ‘আমাদের বয়স তখন ৭-৮ বছর হবে। তিনি বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন, ৪-৫ মাস হবে। একসময় প্রচন্ড জ্বরে তিনি মারা যান।’
আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের বিপরীতমুখী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই বিতর্ক এড়াতে শামসুল হকের মৃত্যুর ঘটনা গোপন করা হয়েছিল বলে জানান তিনি। সেলিম আনসারী বলেন, ‘আমরা তো তখন ছোট, তিনি যে শামসুল হক সেটা বুঝতে পারি নাই। আমাদের বাড়িতে অনেক নেতা থাকতেন, অনেক ফকির থাকতো সবসময়। পরে বুঝতে পেরেছি যে, তিনি সেই বিখ্যাত নেতা ছিলেন। শুধু আমরা না, এলাকার কেউই তাকে চিনতেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শেষে তো এসেছেন ছিন্ন পোশাকে, এক দাড়ি-টুপিওলা মানুষ। আমাদের বাসায় অনেক পাগল থাকতো, সবাই মনে করতো তিনিও এমন একজন পাগল। পুরো ছদ্মবেশ যেটাকে বলে, বলতে পারেন সেটি তেমনি ছিল।’
রাজনৈতিক কারণে মহিউদ্দীন আনসারীও তার পরিচয় গোপন রাখতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দাদা তার (শামসুল হক) পরিচয় প্রকাশ করতেন না। আমাদের সঙ্গেও শেয়ার করতেন না।’
২০০৭ সালে বিষয়টি জানাজানির পর কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠন শামসুল হকের বিষয়ে তাদের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে কিনা জানতে চাইলে সেলিম আনসারী বলেন, ‘না, কেউই তার খোঁজ নিতে যোগাযোগ করেনি।’ তথ্য ও সূত্রঃ আজকের টাঙ্গাইল