পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টার মিনি বাংলাদেশে পরিণত
উৎসবমুখর পরিবেশে ফিলাডেলফিয়ায় তিনদিনব্যাপী মুনা কনভেনশন শুরু
- প্রকাশের সময় : ০১:২১:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ অগাস্ট ২০২৪
- / ১১৯ বার পঠিত
‘ইসলাম : পিস এন্ড জাস্টিস ফর হিউম্যানিটি’ শ্লোগান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরস্থ পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারে উৎসবমুখর পরিবেশে শুক্রবার (৯ আগষ্ট) থেকে শুরু হয়েছে মুনা’র তিনদিনব্যাপী কনভেনশন-২০২৪। এবারের কনভেনশন মুনা’র (মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকা) অষ্টম কনভেনশন। চলবে রোববার (১১ আগষ্ট) পর্যন্ত। এদিকে এই কনভেনশন ঘিরে কনভেনশন সেন্টার মিনি বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। কেননা, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন স্থান থেকে কনভেনশনে যোগদানকারী অধিকাংশরাই প্রবাসী বাংলাদেশী অথবা বাংলাদেশী বংশদ্ভুত আমেরিকান। খবর ইউএনএ’র।
কনভেনশনের বিভিন্ন অধিবেশনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দেশী-বিদেশী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তাদের কথায় অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগ, আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম, অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার, অনিয়মের কথা উঠে আসে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনী জনগণের স্বাধীনতা, গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসন প্রভৃতি বিষয়ও উঠে আসে। অপরদিকে কোন কোন বক্তা তাদের বক্তব্যে নতুন সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। এবং আগামী কনভেনশনের আগেই ফিলিস্তিনীরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে আর আল আকসা মসজিদ ইহুদীদের কাছ থেকে দখলমুক্ত হবে। কনভেনশনের মূল হলে অধিবেশন চলাকালে বক্তাদের আলোচনার সময় মাছে মধ্যেই হলে উপস্থিত হাজার হাজার নর-নারীর কন্ঠে ‘তাকবীর, আল্লাহ আকবর’, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন, ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘কোরআনের আলো ঘরে ঘরে জ্বালো’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। এছাড়াও বিভিন্ন অধিবেশনের আলোচনায় বক্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সকল নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ভোটার প্রক্রিয়ায় অংশ না নিলে অধিকার আদায় প্রতিষ্ঠা হবে না।
এদিকে মুনা কনভেনশন ঘিরে শুক্রবার সকাল থেকে দুপুরে নিউইয়র্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে হাজার হাজার মুসলিম নর-নারী সপরিবারে কনভেনশ সেন্টারে এসে মিলিত হন। এর আগে তারা পূর্বে বুকিং করা হোটেলের কক্ষ কনফার্ম করেন। এরপর তারা কনভেনশনের রেজিষ্ট্রেশনও কনফার্ম করেন। অনেকে বিকেল ও সন্ধ্যায় এসে কনভেনশনে যোগ দেন। ফলে কনভেনশন সেন্টার ও আশপাশের এলাকা মিনি বাংলাদেশে পরিনত হয়।
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলীন, ওজনপার্ক প্রভৃতি এলাকা থেকে একাধিক বাসযোগে হাজার হাজার বাংলাদেশী সপরিবারে এই কনভেনশনে যোগ দেন। আবার অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ী যোগে ফিলাডেলফিয়া আগমন করেন। কনভেনশন আয়োজকদের ধারণা এবারের কনভেনশনে ১২/১৫ হাজারের মতো মুসলিম নর-নারীর সমাবেশ ঘটেছে।
অপরদিকে কনভেনশন সেন্টার ও এর আশপাশের এলাকা সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে এবারের কনভেনশনে নতুন প্রজন্মের ব্যাপক উপস্থিতি। সামার ভ্যাকেশনের সুযোগে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের সাথে এই কনভেনশনে অংশ নিচ্ছেন বলে অনেকই ইউএনএ প্রতিনিধিকে জানান। এছাড়াও কনভেনশনের আয়োজনেরও প্রশংসা করেছেন অনেকেই। কনভেনশনের সবকিছুই টিপটম, পরিপাটি আর অর্গানাইজড দেখা যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে রেজিষ্ট্রেশন করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। তারপর যোগ দিয়েছেন মূল অনুষ্ঠানে। এদিকে কভেনশনের বিভিন্ন আলোচনা ও সেমিনারের মাঝে মাঝে মুনা’র সোস্যাল সাভিস, আল কোরআন দাওয়াহ সেন্টার প্রভুতি সংগঠনের কার্যক্রম ভিডিও কার্যক্রমের মাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি এসব কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনেও বিভিন্ন মানববিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও কনভেনশনের স্পন্সর সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও সংক্ষেপে তাদের কর্মকান্ড তুলে ধরেন। কনভেনশন সেন্টারে বিভিন্ন পণ্যের ১৩৫টি স্টল স্থান পায় বলে সংশ্লিস্টরা জানান।
প্রথম দিনের কর্মকান্ড:
শুক্রবার দুপুরে জুম্মার নামাজ আদায়ের মধ্যদিয়ে মুনা কনভেনশন শুরু হয়। পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারের মূল মঞ্চে বিকেলে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুরুতেই পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একাধিক তেলাওয়াতকারী। এদের মধ্যে ছিলেন কারী ইশতিয়াক বিন শফিক, কারী নজরুল ইসলাম, কারী আহমেদ মাবরুর, কারী হোসাইন সালেহ প্রমুখ। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন কনভেনশন কনভেনর আরমান চৌধুরী। এছাড়াও সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মুনা’র ন্যাশনার প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ইমাম বাবা গালী বারী, শাহীন সিদ্দিকী, লন্ডন থেকে আগত ব্যারিষ্টার হামিদ হোসাইন আজাদ, ফিলাডেলফিয়া সিটি মেয়রের প্রতিনিধি, ড. আয়মান হামাস, ড. মহসিন আনসারী, ওসামা জামাল, ইমাম সিরাজ ওয়াজি, ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ থেকে আগত বিশিষ্ট ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী সাইফুল্লাহ মনসুরের সঙ্গীত উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান।
পরবর্তী সেশনে ‘দ্য ইউনাইটেড গাইডলাইন্স’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন আবু মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, ড. আলতাফ হোসাইন ও সাউন কিং। এরপর মাগরিবের নামাজের বিরতীর পর ‘ইসলামের সভ্যতা ও ঐতিহ্য-যে জাতি আলো ছড়ায়’ শীর্ষক সেশনে ‘ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব’ বিষয়ে ব্যারিষ্টার হামিদ হোসাইন আজাদ, ড. সাঈদুর রহমান চৌধুরী এবং ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী-আমাদের প্রেরণা’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার।
এছাড়াও এদিন মূল পর্বের আলোচনা ছাড়াও ইয়্যুথ কনফারেন্সের পাশাপাশি অন্যান্য কনফারেন্স রুমে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ও সেমিনারগুলোতে অতিথি আলোচকগণ বক্তব্য রাখেন।
দ্বিতীয় দিন শনিবারের কর্মকান্ড:
শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত চলে কনভেনশনের নানা অনুষ্ঠান আর কর্মকান্ড। এর মধ্যে ছিলো বিষয় ভিত্তিক আলোচনা, সেমিনার, ইয়্যুথ প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি। রোববারও অনুরূপ কর্মসুচী থাকবে। তবে এদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত কনভেনশন চলবে। এবারের কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথি এবং বিদেশী ইসলামীক স্কলারগণ আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।
এদিনে ইসলাম, ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইমামদের ভূমিকা বিষয়ক আলোচনা পর্ব দিয়ে শুরু হয় শনিবারের কর্মকান্ড। নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি)-এর ইমাম ও খতিব মির্জা আবু জাফর বেগ ও বাংলাদেশ থেকে আগত ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার সহ বিভিন্ন মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের ইমামগণ এসময় বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট, বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী আব্দুল আজীজ ভূইয়াও বক্তব্য রাখেন এই পর্বে। এছাড়াও মুসলিম সোসাইটি বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন ড. আলতাফ হোসাইন, মুফতি হোসাইন কামানী ও সুলেমান হাী। এরপর ‘ন্যায় পরায়ন সমাজ গঠনের পদ্ধতি’ বিষয়ে আলোচনা করেন আবু আহমেদ নূরুজ্জামান এবং ‘সফল দাওয়া-পদ্ধতি ও কৌশল বিষয়ে আলোচনা করেন ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার।
এরপর ফিলিস্তি বিষয়ক আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ড. ওসামা আবু ইরশাদ, ইমাম ড. মোহাম্মদ আবু তালেব ও শায়েখ আবু নাসির জাংদা।
বিকেলের অধিবেশনে মুনা সোস্যাল সার্ভিস-এর পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরীফ এর উপস্থাপনায় ‘সামাজিক ন্যায়পরনায়তা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলাম’ শীর্ষক সেশনে ‘অন্যায় ও জুলুম সবসময় ন্যায় বিচারের জন্য হুমকী’ বিষেয়ে বক্তব্য রাখেন মুনা’র সাবেক ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসাইন এবং ‘মজবুত ঈমানের আলোয় আলোকিত হৃদয় সাহাবায়ে কিরাম (রা)’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার।
ইমাম দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে কোরআনের আলোকে ঐক্যবব্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জুলমবাজ, দূর্নীতিপরায়নদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বাংলাদেশে কি দেখলাম। দেশের ছাত্র-জনতা অন্যায়, অবিচার, অবিবেচকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো বলেই জুলুমবাজ শাসক পরাজিত হয়েছে।
ড. আবুল কালাম আজাদ বাশার বলেন, ঈমান থাকলেই, নবীজীর (সা:) সাথে থাকলেই সাহাবী হওয়া যায় না। সাহাবীর মর্যাদা পাওয়া কঠিন। মহানবীকে অনুস্মরণ করে যারা সাহাবী হয়েছেন তারা বেহস্তী হবেন। তিনি বিভিন্ন সাহাবীদের জীবনের নানা দিক সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, সাহাবীদের জীবন মেনে চলার আহ্বান জানান। দ্বীন প্রচারে সাহাবীরা যেমন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তেমনী আমাদের দায়িত্ব ইসলামের দাওয়াত বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেয়া। এক্ষেত্রে মুনা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এছাড়াও কীনোট সেশনে বক্তব্য রাখেন ড. ওমর সোলাইমান, ড. আলতাফ হোসাইন, মুনা’র ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট হারুন-অর রশীদ। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন পেনসেলভেনিয়া ষ্টেট সিনেটর নিখিল সাবা, মূলধারার রাজনীতিক তারেক খান প্রমুখ।
পরবর্তীতে চলে ফান্ড রেইজিং পর্ব। এই পর্ব পরিচালনা করেন ড. আলতাফ হোসাইন। এতে উপস্থিত নর-নারীদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক ১ লাখ ৫৮ হাজার ডলারে প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। এরপর বক্তব্য রাখেন আমন্ত্রিত অতিথি ড. ইয়াসির কাদী।
শনিবার দিনও মূল পর্বের আলোচনা ছাড়াও ইয়্যুথ কনফারেন্সের পাশাপাশি অন্যান্য কনফারেন্স রুমে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ও সেমিনারগুলোতে অতিথি আলোচকগণ বক্তব্য রাখেন।
এরপর মাগরিবের নামাজের বিরতীর পর রাত ৯টার দিকে শুরু হয় মনোজ্ঞ ইসলামী সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে বাংলাদেশ থেকে আগত শিল্পী ও আবৃত্তিকার তোফাজ্জল হোসেন খান ও টিভি’র নিউজ প্রেজেন্টার অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মনসুর এবং ডা. আতাউল ওসমানী ও ইকবাল হোসেন জীবনের নেতৃত্বে উম্মাহ শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যরা দলীয় ও এককভাবে ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এছাড়াও রেনেসাঁ কালচারাল গ্রুপ, আটলান্টিক কালচারাল গ্রুপ, নায়াগ্রা কালচারাল গ্রুপ এবং মুনা চিল্ডরেন উইং-এর নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এই পর্বের সঙ্গীতগুলোতেও বাংলাদেশ আর প্যালেস্টাইন পরিস্থিতি উঠে আসে।
কনভেনশনের বিভিন্ন পর্ব পরিচালনা করেন মুনা’র ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ, কনভেনশনের কনভেনর আরমান চৌধুরী, সোস্যাল সার্ভিস-এর পরিচালক হাফেজ আব্দুল্লাহ আল আরীফ, মিডিয়া ও কালচালার বিভাগের পরিচালক আনিসুর রহমান গাজী, অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মনসুর প্রমুখ।