বুকটা ফাইট্টা যায় !

- প্রকাশের সময় : ০৩:০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৪৯ বার পঠিত
হাবিব রহমানঃ “বন্ধু যখন বউ লইডা আমার বাড়ীর সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।” না, আমার বুকটা ফাটে না। এটি বাংলাদেশের লোকগানের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী এবং জাতীয় সংসদের প্রাক্তন সদস্য মোমতাজের ধামাকা গানের ক’টি লাইন। তবে আমার বুকটা ফাইট্টা যায় অন্য একটি কারণে। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে ভূমিকাটা সেরে নেই।
১৯৭৪ সালে আমি বিএ পরীক্ষা পাশ করি। সে সময় পাসের হার ছিলো ১৪%। অর্থাৎ শতকরা ৮৬% ছাত্র ফেল করে। এরপর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা গতি হারায়। পাশের হার পরবর্তীতে কত পৌছে সে প্রসঙ্গ না হয় নাই টানলাম।
ঢাকা শহরেই বড় হয়েছি। মা, ভাই-বোন সবাই বর্তমান। ভাইদের মধ্য আমি সবার ছোট। সংসারের কোন দ্বায় দ্বায়িত্ব নেই। তাই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াই। টুকটাক গল্প কবিতাও লিখি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। বিকাল হলে আড্ডা মারতে যাই বই পাড়া বলে খ্যাত বাংলা বাজারে। মদীনা পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী, বিশিস্ট লেখক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আমার আত্মীয়। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তার সম্পাদিত মাসিক মদীনা তখন খুব জনপ্রিয়। ওখানেও কিছু লেখালেখি করি। তার পত্রিকায় দুটি বিভাগ ছিলো খুব জনপ্রিয়। একটি সমকালীন প্রশ্নের জবাব এবং অপরটি মুসলিম জাহান। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে বিভিন্ন মুসলিম দেশের খুবই সফল যোগাযোগ ছিলো। অনেক মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে তার ছিলো খুব আন্তরিক সম্পর্ক। যেমন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সলের সাথে ছিলো তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মুতামারে আলমে আল ইসলামি নামক সউদি ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৌদি বাদশাহ ফয়সল। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারী জেনারেল। শ্রীলংকার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এমনিভাব সারা বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সাথেও ছিলো তার গভীর সম্পর্ক। সে সব প্রতিষ্ঠানের নান ম্যাগ্যাজিন আসতো তার কাছে। এগুলো তিনি আমাকে দিতেন যেন ওখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ নিউজগুলো নিয়ে মুসলিম জাহান পাতাটি সমৃদ্ধ করি।
প্রায় সময় মাগরিব নামাজ পড়তাম শ্রীশ দাশ লেনের বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং সংলগ্ন মসজিদে। নামাজের পর রাস্তা সংলগ্ন ঘাসে বসে আড্ডা দিতাম। এসময় আড্ডায় নিয়মিত শরীক হতেন লেখক সাংবাদিক এবং তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি কলেজ) জনাব আখতার ফারুখ। তিনি তখন দৈনিক সংগ্রামেরও সম্পাদক। তিনি একজন ভালো অনুবাদকও ছিলেন। সে সময় তার অনূদিত “আল-ফারুখ” বইটি বেরিয়েছে। খলিফা ওমর (রাঃ) জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে উর্দূতে লিখা বইটির তার সাবলিল অনুবাদ আমাকে খুবই আকৃষ্ট করে। আমি এক নাগারে বইটি পড়ে শেষ করে পরে একদিন এক সান্ধ্য আড্ডায় বইটি নিয়ে তার সাথে একটা দীর্ঘ আলোচনায় মিলিত হই। আখতার ফারুখ তার বই নিয়ে আমার আলোচনায় এতই প্রীত হন যে তিনি আমাকে দৈনিক সংগ্রামে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। সংগ্রাম পত্রিকার অফিস তখন বংশাল রোডে। একজন সাব অডিটর হিসাবে আমি সংগ্রামে যোগদান করি।
তখন টেলিপ্রিন্টারের যুগ। নিউজগুলো সব ইংরেজীতে আসতো। শিফট ইনচার্য তা ভাগ করে দিতেন সাব এডিটরদের তা অনুবাদ করার জন্য। নিজের অনুবাদ করা অখ্যাত নিউজগুলোও পরদিন পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে দেখে শিহরিত হতাম।
কিছুদিন কাজ করার পর মনে হলো বাংলা ভাষাটা আরো একটু ভালো করে আয়ত্ব করতে পারলে এই পেশায় আরো ভালো করতে পারতাম। একদিন হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চাকুরিটা ছেড়ে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। অনেকে ব্যঙ্গ করলো। সমালোচনাও করলেন অনেক বন্ধু। বিএ পাস করে যেখানে এম এ ভর্তি হবার কথা। সেখানে ডিমোশান নিয়ে অনার্স ভর্তি হওয়ার জন্য।
যাকগে তিনবছর পর অনার্স শেষ করলাম। আবার মাথায় ভুত চাপলো। ভাবলাম সাংবাদিকতা যখন করবো তখন সাংবাদিকতায়ই বা মাস্টার্সটা শেষ করি না কেন। বাংলায় মাস্টার্স পরে একসময় করে নেবো ক্ষণ।
ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করার পরও সাংবাদিকতায় মাস্টার্সে ভর্তি হতে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান শামসুল মজিদ হারুন। তিনি বল্লেন- এমন পিকিউলিয়ার সার্টিফিকেট আমি আগে দেখেনি। পাশ কোর্সে বিএ, বাংলায় অনার্স। এখন আবার এসেছো সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করতে। এক বছর তো বাকী। বাংলায় মাস্টার্সটা করে নিয়ে তারপর একটা চাকুরিতে ঢুকে পড়। এই বিভাগে একটা সিট অনেক মূল্যবান। নতুন একজনকে পড়তে সুযোগ দাও।
আমি আমার কাহিনীটা তাকে খুলে বল্লাম। জানালাম আমার খুব আশা সাংবাদিকতা করার। তাই এ লাইনে আরো দক্ষ হবার জন্য আমাকে সাংবাদিকতায় দু’ বছরের এই মাস্টার্স কোর্সটা করার সুযোগ দিলে খুবই উপকৃত হবো। আমার অনুনয় বিনয়ে তাঁর মন গল্লো। ভর্তি হবার সুযোগ দিলেন।
আমাদের সময়ে সাংবাদিকতা বিভাগে বেশীরভাগ শিক্ষক ছিলেন পার্ট টাইম। বিভিন্ন পত্রিকার সিনিয়র সব সাংবাদিক। যেমন ডেইলি অবজার্ভারের এডিটর ড. মুনিম, ডেইলি নিউ নেশানের হাসান সাঈদ, দৈনিক বাংলা থেকে খোন্দকার আলী আশরাফ, বিটিভি থেকে একজন সহ এমনি আরো অনেকে।
আমাদের রিপোর্টিং ক্লাস নিতেন আতাউস সামাদ এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র কাজী জাওয়াদ। কাজী জাওয়াদ ক্লাসে রিপোর্টিং এর থিউরিটিক্যাল দিকটা পড়ালেও আতাউস সামাদ স্যার রিপোর্টিং এর জন্য নিয়ে যেতেন ফিল্ডে। যেমন বিরোধীদলের ডাকা রেডিও টেলিভিশন ঘেরাও। স্যার আমাদের নিয়ে যেতেন রেডিও বা টিভি অফিসের সামনে। সমস্ত সময় সেখানে অবস্থান করে প্রত্যেকে নিজ নিজ মত রিপোর্ট করে স্যারের কাছে জমা দিতে হতো। রাস্তার পাশে বসেই স্যার খাতা দেখতেন। কার রিপোর্টে কি ত্রুটি আছে তা তুলে ধরতেন। যার রিপোর্টে ভালো হতো তার রিপোর্টটা কাটছাঁট করে তিনি কন্ঠ দিয়ে বিবিসিতে পাঠাতেন। উল্লেখ্য, আতাউস সামাদ স্যার সে সময় বিবিসি’র রিপোর্টার ছিলেন। এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। বলতে চাচ্ছি একজন রিপোর্টার হবার জন্য আমাদেরকে এভাবেই সৈনিকদের মত মাঠে-ময়দানে অনুশীলন করতে হতো।
দৈনিক বাংলার সাংবাদিক খোন্দকার আলী আশরাফ আমাদের ফিচার পড়াতেন (সে সময় তিনি দৈনিক বাংলায় একটি জনপ্রিয় রম্য কলাম-“দুর্জন উবাচ” লিখতেন)। তিনি কখনো থিউরিটিক্যাল পড়ানোয় বিশ্বাস করতেন না। সব সময় বাইরে পাঠাতেন বিষয় নির্ধারণ করে দিয়ে। যেমন বল্লেন, যাও আজ তোমার বিষয়-ফুটপাতে চশমা বিক্রেতা। ইত্যাদি, ইত্যাদি। বায়তুল মোকাররম, পল্টন, নিউমার্কেট ইত্যাদি ঘুরে সপ্তাহখানিক সময় ব্যয় করে একটা রিপোর্ট তৈরি করে স্যারের কাছে জমা দিতে হতো।
এতক্ষণ এত বড় ভূমিকা টানলাম বা ধান ভারতে শিবের গাত গাইলাম অন্য একটি কারনে। গত কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম লোক নিয়োগের। বিজ্ঞাপনের ভাষাটা ছিল এমনঃ
“টেলিভিশনে কাজ করার জন্য প্রেজেন্টার ও রিপোর্টার প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা লাগবে না।যোগাযোগ করুন।”
আমার জানামতে টেলিভিশনের একজন নিউজ প্রেজেন্টার হতে হলে একটা নিদৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও থাকতে হয় সুন্দর বাচনভঙ্গি, স্পস্ট ও আকর্ষনীয় উচ্চারণ, অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সামাল দেবার ক্ষমতা ইত্যাদি।
অপরদিকে একজন রিপোর্টার হতে হলে অবশ্যই বেসিক জার্নালিজমটা জানতে হয়। একটি সম্ভাবনাময় ও চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা আজ দেশে-বিদেশে অনেক উঁচু মাপের পেশা। পৃথিবীতে যতগুলো পেশা আছে সাংবাদিকতা তার মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। সাংবাদিকতায় অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পেশায় প্রবেশ করতে পারলে একটি সম্ভাবনাময় ও উজ্জ্বল ক্যরিয়ার গড়া সম্ভব। তবে সাংবাদিকতা করার জন্য সাংবাদিকতা পড়া ম্যান্ডেটরী নয়। তারপরও একটা বেসিক যোগ্যতা এবং এসম্পর্কীয় মিনিমাম অভিজ্ঞতা বাঞ্ছনীয়।
ভাবছিলাম- একজন সফল রিপোর্টার হবার জন্য কত কাঠখড় পুড়ালাম। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করলাম। কাজও করলাম বহু বছর। তারপরও নিজকে একজন সফল সাংবাদিক বা রিপোর্টার বলতে ভয় হয়। আর এখন টেলিভিশনের মত একটা টেকনিক্যাল কাজের জন্য অভিজ্ঞতাহীন প্রেজেন্টার, রিপোর্টার চাওয়া হয়, তখন চীৎকার করে বলতে হচ্ছে হয়- ধরণী দ্বিধা হও! অথবা শিল্পী মোমতাজের ভাষায় বলতে হয়- ‘ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়’।