৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধই স্বাধীনতার ইতিহাস নয়

- প্রকাশের সময় : ০২:১৭:৪২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
- / ৮৮৭ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: ১৯৭০’র ২২ ফেব্রুয়ারী স্মরণে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক সভায় বক্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দিনটি ঐতিহাসিক দিন। কেননা, এদিন ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্র ইউনিয়নের জনসভায় ১১ দফা কর্মসূচী সম্বলিত প্রচারপত্রে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ ঘোষণা দেয়া হয়। ছাত্র সমাজের যে ঘোষণা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। বক্তারা বলেন, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধই স্বাধীনতার ইতিহাস প্রকৃত ইতিহাস নয়। মূলত: ১৯৪৭ সালের পর থেকেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১-এর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আর দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের নেপথ্যের মূল রূপকার মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনিই সর্বপ্রথম ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে স্বায়াত্তশাসনের কথা বলেন, স্বাধীনতার কথা বলেন। বক্তারা বলেন, সহনশীলতার মাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়েই দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস রচনা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে। বক্তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলো এটা যেমন সত্য, তেমনী মওলানা ভাসানী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পিতা এটাও ইতিহাসের সত্য। পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাও সত্য। আর ভাসানী-মুজিবের সম্পর্ক ছিলো পিতা-পুত্রের মতো। ইতিহাসের যার যার প্রাপ্য সম্মান তাঁকে দিতে হবে।
সচেতন প্রবাসী বাংলাদেশী সমাজ-এর ব্যানারে ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারী উদযাপন কমিটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারী শনিবার সন্ধ্যায় উক্ত সভার আয়োজন করে। নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস্থ কাবাব কিং রেষ্টুরেন্টের পার্টি হলে আয়োজিত সভার শুরুতে সকল শহীদ স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। খবর ইউএনএ’র।
প্রবীণ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক আজকাল সম্পাদক মনজুর আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ও শিক্ষাবীদ অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। সভায় মূল আলোচক ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু। সভায় আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট মঈনুদ্দীন নাসের, সাবেক ছাত্রনেতা লুৎফর রহমান হেলাল, বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক ড. মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক নিউইয়র্কের সাবেক সহ সভাপতি আজহারুল হক মিলন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, ২২ ফেব্রুয়ারী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক কাজী সাখাওয়াত হোসেন আজম ও সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকন। সভা পরিচালনা করেন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট মাকসুদুল হক চৌধুরী। উল্লেখ্য, আতিকুর রহমান সালু পরবর্তীকালে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের পর্যায়ক্রমে সাধারণ সম্পাদক (১৯৭০-১৯৭১) ও সভাপতি (১৯৭২-১৯৭৩) ছিলেন।
অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী রেখা আহমদ সহ ডীনা মাহবুব, নূরুল হক ও লুবনা কাইজার। সবশেষে প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পী স্বপ্না কাওসার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এসময় তলায় সঙ্গত করেন কাওসার হোসেন মন্টু।
সভায় আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু তার দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করে বলেন, আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ থেকে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়া হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ও ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার। বক্তব্য রাখেন ১৯৬২-এর আইয়ুবের সামরিক শাসন ও শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনের নেতা এবং তৎকালীন শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমেদ (মরহুম সাবেক প্রধানমন্ত্রী), ডাকসু’র সাবেক ভিপি ও তৎকালীন উদীয়মান কৃষক নেতা রাশেদ খান মেনন (বিমান ও পরিবহন মন্ত্রী) এবং ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাহবুবউল্লা (ড. মাহবুবউল্লা)।
ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ২২ ফেব্রুয়ারীর জনসভার শুরুতে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার (কর্মসূচী) প্রস্তাবনা পাঠ করার সুযোগ হওয়ার কথা উল্লেখ করে আতিকুর রহমান সালু বলেন, ঐ সভায় স্বাধীন বাংলার পক্ষে বক্তব্য রাখার জন্য সামরিক আদালতে কাজী জাফর আহমেদ ও রাশেদ খান মেননকে তাদের অনুপস্থিতিতে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন। এছাড়া মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুবউল্লাকে এক বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। আমাকে (সালু) পুলিশ হন্য হয়ে খুজে। তিনি বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারী পল্টনের জনসভা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।
আতিকুর রহমান সালু বলেন, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো ছাত্র আন্দোলনের ‘নেইম ও ফেইম’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ‘ভ্যান গার্ড’-এর ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আবদুল্লাহ আল নোমান (সাবেক মন্ত্রী), সাদেক হোসেন খোকা (সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র), জসিম উদ্দিন আহমেদ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি), শিল্পী ফকির আলমগীর, কাজী সিরাজ (সাংবাদিক) প্রমুখ অংশ নেন। তিনি বলেন, ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে আমরাই প্রথম জনসভা করে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেই।
সালু বলেন, ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল সুর ও আকঙ্খা ছিলো সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, সকল বৈষম্যের অবসান এবং শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজো বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি বলেন, সত্তুরের ২২ ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় জীবনের অনন্য দিন, ইতিহাসের বাতিঘর। দেশের চলমান রাজনীতির মত পার্থক্য ও কলুষ রাজনীতি দিয়ে সত্তুরের ২২ ফেব্রুয়ারীকে বিচার করলে চলবে না। ২২ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিতহাসের ‘মাইল ফলক’। তাই স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২২ ফেব্রুয়ারী চিরকাল আমাদের পথ দেখাবে।
সভায় ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এতো বড় যে, তা লিখে শেষ করা যাবে না। তারপরও দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, জানাতে হবে। তিনি বলেন, কোন সরকারই সত্তুরের ২২ ফেব্রুয়ারীকে স্মরণ করবে না। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রবাস থেকে আমাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
মঈনুদ্দীন নাসের বলেন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ‘আসসালাুম আলাইকুম’-এর পর সত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারীর জনসভার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়। এটা ইতিহাস। আমাদেরকে সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা সেদিন অনেকই বুঝতে না পারায় দেশের রাজনীতিতে অনেক ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর ছিলেন দূরদর্শী নেতা। সত্তুরের নির্বাচনের পর শেখ মুজিব যে ক্ষমতা পাবেন না, তা ভাসানী আগেই বুঝেছিলেন। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন, শেখ মুজিব নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবী করেননি। তিনি বলেন, উলফা নেতাদের হস্তান্তর করে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না। আমরা সচেতন না হলে, দেশ প্রেমিক না হলে বহিশত্রুদের আক্রমন থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না।
লুৎফর রহমান হেলাল বলেন, সত্তুরের ২২ ফেব্রুয়ারী অস্বীকার করলে একাত্তুরকেই অস্বীকার করা হবে। তিনি বলেন, দেশের রাজনীতিকদের চারিত্রিক পরিবর্তন, ক্ষমতার মোহ জাতির স্বপ্ন পূরণ করতে পারছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ছিলো না। আর স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’ নাম নেয়।
ড. মাহবুব হাসান বলেন, মওলা ভাসানী কত বড় মাপের নেতা ছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে শ্রদ্ধা জানাতেন। তিনি শুধু শেখ মজিবের নয়, আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক পিতা ছিলেন। তিনি বলেন, সত্তুরের ২২ ফেব্রুয়ারীর ইতিহাসকে জানতে হবে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশের ইতিহাস নিয়ে গবেষনা করতে হবে, সত্যকে তুলে ধরতে হবে।
মনজুর আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যত তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হবে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস ততই বেড়িয়ে আসবে। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য হচ্ছে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দল তাদের মত করে স্বাধীনতার কথা বলে। আর দেশের ইতিহানবীরা ইতিহাস নয়, রাজনৈতিক কলাম লেখে। তিনি বলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর রিত রূপই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎ নিয়ে ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকার তা অস্বীকার করেনি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের দেশ, দেশের স্বাধীনতার সার্বিক ও সঠিক ইতিহাস চাই।
সত্তুরের ২২ ফেব্রুয়ারী স্মরণে ‘বাইশে ফেব্রুয়ারী ১৯৭০’ শীর্ষক একটি তথ্যবহুল স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। প্রবীণ সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের সম্পাদিত এতে রাশেদ খান মেনন, মোস্তফা জামাল হায়দার, আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু, মনজুর আহমেদ, প্রফেসর জসীম উদ্দিন, আলী ইমাম, ড. লাইলী উদ্দিন প্রমুখের লেখা প্রকাশিত হয়।