নিউইয়র্ক ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিবেক, মানবতা ও স্বচ্ছতার নিরিখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:০৯:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০১৪
  • / ১১১৬ বার পঠিত

নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ও দৈনিক কালের কন্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ও সিনিয়র ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ নিয়ে হতাশার কিছু নেই। তবে সাংবাদিকতাসহ পেশাগত সকল ক্ষেত্রেই বিভক্তি দু:খজনক। এজন্য বিভিন্ন পেশায় নেতৃত্বদানকারী কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গই দায়ী। তারা বলেন, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের বিবেক, মানবতা ও স্বচ্ছতার নিরিখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে দেশের নেতৃত্ব দিতে দেশে-প্রবাসে সাংবাদিকদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ও টাইম টিভি’র সিইও আবু তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার শুরুতে ঢাকা থেকে আগত অতিথিদেরকে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ ও শুভেচ্ছা জানানো হয়। ক্লাবের পক্ষে সভাপতি আবু তাহের দৈনিক কালের কন্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ক্লাবের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সনজিবন কুমার দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর, ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত অর্থ সম্পাদক আজাদ আহমেদ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম এবং ক্লাব সদস্য ও দৈনিক প্রথম আলো’র নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন সিনিয়র ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু’র হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন। এরপর নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ক্লাবের কার্যক্রম, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য তুলে ধরে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বাংলা নিউজ২৪ডটকম-এর বিশেষ প্রতিনিধি শিহাবউদ্দিন কিসলু।
সভায় ক্লাবের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ক্লাবের অন্যতম উপদেষ্টা মনজুর আহমদ ও নিনি ওয়াহিদ, সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক দেশবাংলা/বাংলা টাইমস-এর প্রকাশক ডা. চৌধুরী সারোয়ারুল হাসান, সিনিয়র সহ সভাপতি ও সাপ্তাহিক রানার-এর প্রধান সম্পাদক তাসের মাহমুদ, সহ সভাপতি ও আইঅন বাংলাদেশ টিভি’র পরিচালক রিমন ইসলাম এবং সাবেক সহ সভাপতি ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান। সভা পরিচালনা করেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও নিউইয়র্ক ভিক্তিক বার্তা সংস্থা ইউএনএ’র সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ।
সভায় ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘বাঙালীর জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার ৭১ আর শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা’। তিনি বলেন, ৫২ থেকে ৭১ বাঙালীর গৌরবের ইতিহাস তরুণরাই গড়েছে। বাংলাদেশকে তরুণরা এগিয়ে নিচ্ছে, আগামীতেও নেবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ নিয়ে হতাশা একবারেই অমূলক। তিনি বলেন, শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেই যে মুক্তিযোদ্ধা হয় তা-না, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার নানা বিষয় রয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্নভাবে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা। দেশের সকল বীরঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদেরকে সেই মর্যাদাই দেয়া উচিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাহিনী তার শৈল্পিক গাঁথুনিতে তুলে ধরে বলেন, এক কিশোর-বালকের মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলার গল্পের উদাহরণ টেনে বলেন, ছেঁড়া মানচিত্রকে জোড়া লাগাতে হলে এর পেছনের খন্ড-বিখন্ড মানুষকে জোড়া দিতে হবে। তা না হলে ছেঁড়া মানচিত্রকে জোড়া দেয়া সম্ভব নয়। তাই বিখন্ডিত মানুষদের জোড়া লাগাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখতে চেয়েছি, তা পাওয়া সহজ হবে।
ইমদাদুল হক আরো একটি গল্পের সারমর্মে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একলোক তাঁর একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঝর ঝর করে কাঁদছিলেন। তাঁর কান্না দেখে ছেলে মৃত্যুর খবর দিতে আসা অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও কাঁদছিলেন। এসময় ওই ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা কেন কাঁদছেন জানি না? আমি আমার ছেলের মৃত্যর জন্য কাঁদছি না। আমি কাঁদছি এই ভেবে যে, আমার যদি আরও এমন পাঁচটি সন্তান থাকতো এবং তাঁরা সবাই যদি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হতো তাহলে আমার জীবনটা স্বার্থক হতো। এই হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, আমরা সবাই এক হলে গোটা বাংলাদেশটাই এক হবে, তখন আর বিভাজন থাকবে না। তিনি উপস্থিত সুধীবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলেন, বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন, মনে মনে হলেও প্রতিদিন অন্তত একবার উচ্চারণ করুন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। তিনি বলেন, এই দেশকে বড় ভালোবাসি বলেই পশ্চিম জার্মানি আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। দেশের টানে ছুটে এসেছি। ঠিক তখনই আমি ‘পরাধীনতা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম।
সভায় শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের সন্তান শাহীন রেজা নূর বাংলাদেশে সকল বিভাজনের মূলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়ে মৌলিক অবস্থানের বিতর্ককে দায়ী করে বলেন, যারা এ বিতর্ক করছেন তারা মতলববাজ। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই বিতর্ক আনতে চান। কিন্তু তারা জানেন না, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ কেন, মাত্র ৩ হাজার মানুষ শহীদ হলেও তাদের আত্মত্যাগের যে চেতনা ও শপথ তা যেকোনো সংখ্যাকেই ছাড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, যারা টেলিভিশন টকশোতে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেন তারা বিবেক বর্জিত এবং মানুষ নামের কলঙ্ক।
শাহীন রেজা নূর বাবা সিরাজউদ্দিন হোসেনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার বাবা হিসেবে নয়, সাহসী ও নীতি-আদর্শের বিবেচনায় সিরাজউদ্দীন হোসেনের মতো সাংবাদিকের আজ বড় প্রয়োজন। তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সেই গৌরবময় সময় ফিরিয়ে আনার উপরও গুরুত্বরোপ করেন। তিনি বলেন, সমাজের অংশ হিসেবে সাংবাদিকতায় পচন থাকলেও গৌরবেরও অনেক কিছু আছে। দেশের সাংবাদিকতা নিয়ে হতাশার কোনো কারণ নেই।
সভায় নঈম নিজাম বলেন, কিছু অনিভজ্ঞ ব্যক্তি সাংবাদিকতার মত মহান পেশায় প্রবেশ করে শুধু পেশার বারোটা বাজিয়েছেন তা নয়, একই সাথে তারা পেশাদার সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধতায় ফাটল ধরিয়েছেন। এর ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই এই পেশার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থাকছে না। তিনি বলেন, মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির খবর বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রথম প্রকাশ করে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিন কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন যারা ইউনিয়ন সাংবাদিকতা তথা নেতৃত্ব দেন তাদের অনেকে কখনোই সাংবাদিকতা করেননি। কেউ কেউ অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক। তাদের জন্যই দেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না। তারা ইউনিয়নের নেতা হয়ে ব্যক্তি স্বার্থে বিরোধ জিইয়ে রাখেন। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য দেশে সবগুলো পেশাই আজ দলবাজীতে আক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও বিভক্ত। পেশাগত সার্বিক মর্যাদার অক্ষুন্ন রাখার জন্য তিনি সকল সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাংবাদিকতায় নতুনদের অবদানের কথা তুলে ধরে নঈম নিজাম বলেন, দেশে পেশাদার সাংবাদিকদের মধ্যে কোনো বিভক্তি নেই। অনেক পেশাদার সাংবাদিক জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পাচ্ছে না। স্বার্থান্বেষী কতিপয় ‘সুবিধাবাদী দলকানা সাংবাদিক নেতা’ নামধারীদের কারণেই সাংবাদিক সমাজ আজ কলঙ্কের শিকার। ‘এসব দলবাজ সাংবাদিক মোড়লরা হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ, খালেদার চেয়ে বড় বিএনপি এবং নিজামীর চেয়ে বড় জামাতী’। তার যার যার মতো আখের গোছাতে ব্যস্ত। তিনি বলেন, ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সাংবাদিকতাকে ‘দলকানা রোগ আর দলবাজ’ দের হাত থেকে বের করে আনতে হবে। তিনি প্রবাসের সাংবাদিকদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও পেশাগত মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার অনুরোধ জানান।
ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু তার স্মৃতিচারণে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরেন এবং কয়েকটি আলোচিত ছবি তোলার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র), সৌদী বাদশা ফাহাদ, ফান্সের প্রেসিডেন্ট মিতেঁরা, ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসীর আরাফাত প্রমুখ বিশ্বনেতার নাম উল্লেখ করে বলেন, প্রায় পৌনে ২০০ বিশ্বনেতার ছবি তুলেছেন এবং তাঁদের সাথে তারও ছবি রয়েছে। ভবিষ্যতে এসব ছবি নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। পরিবারকে সময় না দেয়ার কষ্ট আমাকে কষ্ট দেয়। তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ফটোগ্রাফারের দ্বিতীয় দফা অফার গ্রহণ না করে অবসর নিয়েছি।
সভায় প্রেসক্লাব ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু, ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, জনপ্রিয় নাট্যাভিনেত্রী রেখা আহমদ, প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন, সাপ্তাহিক ২০০০-এর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আকবর হায়দার কিরণ, সাপ্তাহিক আজকাল-এর নির্বাহী সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সেলিম, যমুনা টিভি’র প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান সাকী, একুশে টিভি’র প্রতিনিধি ইমরান আনসারী, সাংবাদিক মনিজা রহমান, সাপ্তাহিক রানার-এর নির্বাহী সম্পাদক আশরাফুল হাসান বুলবুল, সাপ্তাহিক আজকাল-এর প্রতিনিধি মঞ্জুরুল ইসলাম, বার্তা সংস্থা বাংলাপ্রেস-এর সম্পাদক সাবেদ সাথী, টাইম টিভি’র সৈয়দ ইলিয়াস খসরু ও আনোয়ার হোসেন বাবু সহ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মারুফ চৌধুরী, আজিজুল হক মুন্না, এম সৌরভ  প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাবেক কার্য নির্বাহী সম্পাদক, শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের পুত্র শামীম রেজা নূর ও সেলিম রেজা নূর এবং ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনুর স্ত্রী-কন্যা সভায় উপস্থিত ছিলেন।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিবেক, মানবতা ও স্বচ্ছতার নিরিখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে

প্রকাশের সময় : ০৭:০৯:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০১৪

নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ও দৈনিক কালের কন্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ও সিনিয়র ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ নিয়ে হতাশার কিছু নেই। তবে সাংবাদিকতাসহ পেশাগত সকল ক্ষেত্রেই বিভক্তি দু:খজনক। এজন্য বিভিন্ন পেশায় নেতৃত্বদানকারী কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গই দায়ী। তারা বলেন, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের বিবেক, মানবতা ও স্বচ্ছতার নিরিখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে দেশের নেতৃত্ব দিতে দেশে-প্রবাসে সাংবাদিকদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ও টাইম টিভি’র সিইও আবু তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার শুরুতে ঢাকা থেকে আগত অতিথিদেরকে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ ও শুভেচ্ছা জানানো হয়। ক্লাবের পক্ষে সভাপতি আবু তাহের দৈনিক কালের কন্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ক্লাবের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সনজিবন কুমার দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর, ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত অর্থ সম্পাদক আজাদ আহমেদ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম এবং ক্লাব সদস্য ও দৈনিক প্রথম আলো’র নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন সিনিয়র ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু’র হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন। এরপর নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ক্লাবের কার্যক্রম, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য তুলে ধরে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বাংলা নিউজ২৪ডটকম-এর বিশেষ প্রতিনিধি শিহাবউদ্দিন কিসলু।
সভায় ক্লাবের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ক্লাবের অন্যতম উপদেষ্টা মনজুর আহমদ ও নিনি ওয়াহিদ, সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক দেশবাংলা/বাংলা টাইমস-এর প্রকাশক ডা. চৌধুরী সারোয়ারুল হাসান, সিনিয়র সহ সভাপতি ও সাপ্তাহিক রানার-এর প্রধান সম্পাদক তাসের মাহমুদ, সহ সভাপতি ও আইঅন বাংলাদেশ টিভি’র পরিচালক রিমন ইসলাম এবং সাবেক সহ সভাপতি ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান। সভা পরিচালনা করেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও নিউইয়র্ক ভিক্তিক বার্তা সংস্থা ইউএনএ’র সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ।
সভায় ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘বাঙালীর জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার ৭১ আর শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা’। তিনি বলেন, ৫২ থেকে ৭১ বাঙালীর গৌরবের ইতিহাস তরুণরাই গড়েছে। বাংলাদেশকে তরুণরা এগিয়ে নিচ্ছে, আগামীতেও নেবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ নিয়ে হতাশা একবারেই অমূলক। তিনি বলেন, শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেই যে মুক্তিযোদ্ধা হয় তা-না, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার নানা বিষয় রয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্নভাবে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা। দেশের সকল বীরঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদেরকে সেই মর্যাদাই দেয়া উচিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাহিনী তার শৈল্পিক গাঁথুনিতে তুলে ধরে বলেন, এক কিশোর-বালকের মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলার গল্পের উদাহরণ টেনে বলেন, ছেঁড়া মানচিত্রকে জোড়া লাগাতে হলে এর পেছনের খন্ড-বিখন্ড মানুষকে জোড়া দিতে হবে। তা না হলে ছেঁড়া মানচিত্রকে জোড়া দেয়া সম্ভব নয়। তাই বিখন্ডিত মানুষদের জোড়া লাগাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখতে চেয়েছি, তা পাওয়া সহজ হবে।
ইমদাদুল হক আরো একটি গল্পের সারমর্মে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একলোক তাঁর একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঝর ঝর করে কাঁদছিলেন। তাঁর কান্না দেখে ছেলে মৃত্যুর খবর দিতে আসা অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও কাঁদছিলেন। এসময় ওই ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা কেন কাঁদছেন জানি না? আমি আমার ছেলের মৃত্যর জন্য কাঁদছি না। আমি কাঁদছি এই ভেবে যে, আমার যদি আরও এমন পাঁচটি সন্তান থাকতো এবং তাঁরা সবাই যদি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হতো তাহলে আমার জীবনটা স্বার্থক হতো। এই হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, আমরা সবাই এক হলে গোটা বাংলাদেশটাই এক হবে, তখন আর বিভাজন থাকবে না। তিনি উপস্থিত সুধীবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলেন, বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন, মনে মনে হলেও প্রতিদিন অন্তত একবার উচ্চারণ করুন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। তিনি বলেন, এই দেশকে বড় ভালোবাসি বলেই পশ্চিম জার্মানি আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। দেশের টানে ছুটে এসেছি। ঠিক তখনই আমি ‘পরাধীনতা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম।
সভায় শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের সন্তান শাহীন রেজা নূর বাংলাদেশে সকল বিভাজনের মূলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়ে মৌলিক অবস্থানের বিতর্ককে দায়ী করে বলেন, যারা এ বিতর্ক করছেন তারা মতলববাজ। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই বিতর্ক আনতে চান। কিন্তু তারা জানেন না, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ কেন, মাত্র ৩ হাজার মানুষ শহীদ হলেও তাদের আত্মত্যাগের যে চেতনা ও শপথ তা যেকোনো সংখ্যাকেই ছাড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, যারা টেলিভিশন টকশোতে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেন তারা বিবেক বর্জিত এবং মানুষ নামের কলঙ্ক।
শাহীন রেজা নূর বাবা সিরাজউদ্দিন হোসেনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার বাবা হিসেবে নয়, সাহসী ও নীতি-আদর্শের বিবেচনায় সিরাজউদ্দীন হোসেনের মতো সাংবাদিকের আজ বড় প্রয়োজন। তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সেই গৌরবময় সময় ফিরিয়ে আনার উপরও গুরুত্বরোপ করেন। তিনি বলেন, সমাজের অংশ হিসেবে সাংবাদিকতায় পচন থাকলেও গৌরবেরও অনেক কিছু আছে। দেশের সাংবাদিকতা নিয়ে হতাশার কোনো কারণ নেই।
সভায় নঈম নিজাম বলেন, কিছু অনিভজ্ঞ ব্যক্তি সাংবাদিকতার মত মহান পেশায় প্রবেশ করে শুধু পেশার বারোটা বাজিয়েছেন তা নয়, একই সাথে তারা পেশাদার সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধতায় ফাটল ধরিয়েছেন। এর ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই এই পেশার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থাকছে না। তিনি বলেন, মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির খবর বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রথম প্রকাশ করে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিন কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন যারা ইউনিয়ন সাংবাদিকতা তথা নেতৃত্ব দেন তাদের অনেকে কখনোই সাংবাদিকতা করেননি। কেউ কেউ অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক। তাদের জন্যই দেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না। তারা ইউনিয়নের নেতা হয়ে ব্যক্তি স্বার্থে বিরোধ জিইয়ে রাখেন। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য দেশে সবগুলো পেশাই আজ দলবাজীতে আক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও বিভক্ত। পেশাগত সার্বিক মর্যাদার অক্ষুন্ন রাখার জন্য তিনি সকল সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাংবাদিকতায় নতুনদের অবদানের কথা তুলে ধরে নঈম নিজাম বলেন, দেশে পেশাদার সাংবাদিকদের মধ্যে কোনো বিভক্তি নেই। অনেক পেশাদার সাংবাদিক জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পাচ্ছে না। স্বার্থান্বেষী কতিপয় ‘সুবিধাবাদী দলকানা সাংবাদিক নেতা’ নামধারীদের কারণেই সাংবাদিক সমাজ আজ কলঙ্কের শিকার। ‘এসব দলবাজ সাংবাদিক মোড়লরা হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ, খালেদার চেয়ে বড় বিএনপি এবং নিজামীর চেয়ে বড় জামাতী’। তার যার যার মতো আখের গোছাতে ব্যস্ত। তিনি বলেন, ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সাংবাদিকতাকে ‘দলকানা রোগ আর দলবাজ’ দের হাত থেকে বের করে আনতে হবে। তিনি প্রবাসের সাংবাদিকদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও পেশাগত মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার অনুরোধ জানান।
ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনু তার স্মৃতিচারণে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরেন এবং কয়েকটি আলোচিত ছবি তোলার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র), সৌদী বাদশা ফাহাদ, ফান্সের প্রেসিডেন্ট মিতেঁরা, ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসীর আরাফাত প্রমুখ বিশ্বনেতার নাম উল্লেখ করে বলেন, প্রায় পৌনে ২০০ বিশ্বনেতার ছবি তুলেছেন এবং তাঁদের সাথে তারও ছবি রয়েছে। ভবিষ্যতে এসব ছবি নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। পরিবারকে সময় না দেয়ার কষ্ট আমাকে কষ্ট দেয়। তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ফটোগ্রাফারের দ্বিতীয় দফা অফার গ্রহণ না করে অবসর নিয়েছি।
সভায় প্রেসক্লাব ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু, ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, জনপ্রিয় নাট্যাভিনেত্রী রেখা আহমদ, প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন, সাপ্তাহিক ২০০০-এর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আকবর হায়দার কিরণ, সাপ্তাহিক আজকাল-এর নির্বাহী সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সেলিম, যমুনা টিভি’র প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান সাকী, একুশে টিভি’র প্রতিনিধি ইমরান আনসারী, সাংবাদিক মনিজা রহমান, সাপ্তাহিক রানার-এর নির্বাহী সম্পাদক আশরাফুল হাসান বুলবুল, সাপ্তাহিক আজকাল-এর প্রতিনিধি মঞ্জুরুল ইসলাম, বার্তা সংস্থা বাংলাপ্রেস-এর সম্পাদক সাবেদ সাথী, টাইম টিভি’র সৈয়দ ইলিয়াস খসরু ও আনোয়ার হোসেন বাবু সহ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মারুফ চৌধুরী, আজিজুল হক মুন্না, এম সৌরভ  প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাবেক কার্য নির্বাহী সম্পাদক, শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের পুত্র শামীম রেজা নূর ও সেলিম রেজা নূর এবং ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান বিনুর স্ত্রী-কন্যা সভায় উপস্থিত ছিলেন।