প্রবীণ সাংবাদিক শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক সিরাজুল হকের ইন্তেকাল

- প্রকাশের সময় : ০১:৩৯:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
- / ৭ বার পঠিত
নিউইয়র্ক (ইউএনএ): প্রবীণ সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক, জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য সিরাজুল হক বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে নিউইয়র্কের কুইন্স জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। তিনি নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবেরও সদস্য ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা সহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ২ ছেলে ও ২ মেয়ে এবং নাতি-নাতনী সহ বহু আত্বীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। শুক্রবার বাদ জুমা তার নামাজে জানাজা জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে। খবর ইউএনএ’র।
জানা যায়, প্রবীণ সাংবাদিক সিরাজুল হক দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে তার প্রবাস জীবনে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স ভিলেজে কন্যার বাসায় বসবাস করতেন। গত ১৯ জুন বৃহস্পতিবার নিয়ম মাফিক ডায়লেসিস শেষ করে বাসায় ফেরার পর হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর তাঁকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন। মরহুম সিরাজুল হক প্রবাসের বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট এবিএম সালেহ উদ্দীনের শ্বশুর এবং সাঈদা আখতার রেজভীনের পিতা। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তার মরদেহ ঢাকায় দাফন করা হবে বলে এবিএম সালেহ উদ্দীন জানিয়েছেন।
শোক প্রকাশ: প্রবীণ সাংবাদিক সিরাজুল হকের ইন্তেকালে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মমিন মজুমদার ক্লাবের পক্ষ থেকে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন মিডিয়ার সম্পাদক ও সাংবাদিক এবং কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ সিরাজুল হকের ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে মরহুমের বিদেহী আতœার মাগফেরাত কামনা করেছেন।
অধ্যাপক সিরাজুল হকের জীবনী:
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও বর্ষীয়ান সাংবাদিক অধ্যাপক সিরাজুল হক ১৯৫৭ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশুকালে দুইবছর বয়সে মাতৃহারা এবং কৈশোরের স্কুলজীবনে ৮ম শ্রেণীতে থাকাকালীন অবস্থায় পিতৃহারা হন। তাঁর বাবা নূর বক্স হাওলাদার ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট সমাজসেবক এবং ব্রিটিশ আমলে তাঁর দাদা ছিলেন বরিশালের পোস্ট মাস্টার। ছাত্রজীবনে প্রতিটি পর্যায়ের মেধাতালিকায় শীর্ষ স্থানের অধিকারী সিরাজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ অনার্স এবং সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে এম এ পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন পাকিস্থান হানাদার বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণকারী শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল হাই, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, ড. দীন মুহাম্মদ সহ অনেকে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম হলের) হলে নিয়মিত থাকাকালীন অবস্থায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও খন্ডকালীন সাংবাদিকতা করতেন ।
বরিশালের কামারখালি কলেজের বাংলার অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে চাকুরীর মধ্যদিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কলেজের কাজে ঢাকা থেকে বরিশাল ফেরার পথে তিনি পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধৃত হন। তাঁর ডায়রীতে বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ফোন নাম্বার পাওয়ায় তাঁদের সন্দেহ বেড়ে যায়। কয়েকদিন পাকিস্তানী ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় তিনি অত্যাচারের শিকার হন এবং এক পর্যায়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
পরবর্তীতে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতার সময় সাংবাদিকতায় সরাসরি যুক্ত হন। তিনি শিক্ষকতার জীবনে কয়েকটি কলেজে অধ্যাপনা এবং অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতায় প্রথমে ‘দৈনিক আজাদ’-এ সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। দৈনিক ‘জনপদ’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল গাফ্ফার চোধুরী সম্পাদক থাকাকালীন সময় লন্ডন চলে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে তিনি একই পত্রিকায় (জনপদের) দীর্ঘকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ইংরেজি ওয়াল ফজর (দি ডন) পত্রিকা, সাহিত্য ও গবেষণা পত্রিকা মাসিক তাহজীব এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকা নিউজ লেটারের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। অধ্যাপক সিরাজুল হক অখন্ড ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকাকালীন সময়ে ইউনিয়নের নির্বাচনে সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ও সাংবাদিক আনোয়ার জাহীদ প্যানেলে বিপুলভোটে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হন ।
সাংবাদিকতার জীবনে তিনি বর্ষীয়ান সাংবাদিক ফাজলে রশীদ, আতাউস সামাদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী, আনোয়ার জাহিদ, নির্মল সেন, রিয়াজ উদ্দীন আহমদ, আমানউল্লাহ কবীরসহ অনেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অধ্যাপক সিরাজুল হক সাংবাদিকতা ছাড়াও সাহিত্যাঙ্গনে সংস্কৃতি মনষ্ক মানুষ ছিলেন। বাংলা, ইংরেজিসহ কয়েকটি ভাষায় তাঁর পান্ডিত্য ছিলো। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি কবি ও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন।
তাঁর মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে শিশুতোষ, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, শিশুতোষ ও গবেষণাধর্মীসহ গ্রন্থসংখ্যা অনেক। এছাড়াও তাঁর সম্পাদিত ও অনুদিত বেশ কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ রয়েছে। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অধ্যাপক সিরাজুল হক বিভিন্ন সময় রেডিও এবং টিভিতে উপস্থাপনা করেছেন। তিনি ইরান সরকারের চাকুরী নিয়ে তেহরান থাকাকালীন তেহরান রেডিও’র বাংলা বিভাগ ও ইংরেজি তেহরান টাইমস-এ কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও ইরানে তেহরানের প্রপাগেশন সেন্টারের প্রধান হিসেবে কয়েক বছর চাকুরী করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন নিঃস্বার্থ সমাজকর্মী, মানবতাবাদী,বন্ধুপ্রিয় সদালাপী মানুষ হিসেবে এবং কর্মজীবনে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠতায় তাঁর বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে । কর্মজীবনে তিনি সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিদের চাকুরী প্রাপ্তির ব্যাপারে নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় তাঁর বিশেষ ভূমিকা ও সুনাম ছিল প্রসংশনীয়। সাংবাদিকতার জীবনে অধ্যাপক সিরাজুল হক ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ছাড়াও গ্রিস, রোম, লিবিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।
বাংলাদেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও বর্ষীয়ান সাংবাদিক অধ্যাপক সিরাজুল হক পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনকালে একবার তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী ছিলেন।