পার্কচেস্টার জামে মসজিদ নিয়ে এসব কী হচ্ছে!
- প্রকাশের সময় : ০৫:৩০:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ অগাস্ট ২০১৫
- / ১০২২ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিচালনায় যে কটি মসজিদ আছে তার অন্যতম হচ্ছে পার্কচেস্টার জামে মসজিদ ও ইসলামি সেন্টার। ১৯৮৮ সালে ভার্জিনিয়া এভিনিউতে মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন হওয়ার পর নান্দনিক নির্মাণ শৈলীতে চারতলা ভবনটি একনজরে দর্শকদের নজর কাড়ে। মসজিদে প্রতিদিন নামাজের পর বয়ান, সামারে বাচ্চা ও বয়স্কদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের জন্য সামার স্কুল, মৃতদেহের গোসল থেকে দাফন পর্যন্ত সমুদয় কর্মকা- দায়িত্ব নিয়ে করার ফলে সাধারণ জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা খুব বেড়ে যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নান্দনিক এই মসজিদটি দলাদলির কালো থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যুগের পর যুগ ধরে বিবদমান গ্রুপের কর্মকা- সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের বিরক্তির কারণ ঘটাচ্ছে। অতীতে এক পক্ষের অভিযোগ ছিল অপর পক্ষ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। তারা সাধারণ সভা বা নির্বাচন অনুষ্ঠান না করে ক্ষমতা আকড়ে থাকতে চান। কিন্তু তৎকালীন কার্যকারী পরিষদ এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই বলে বারবার মন্তব্য করেছেন।
২০০৫ সালে মসজিদটি প্রথম মামলার জালে জড়িয়ে পড়ে। একই বছর জুলাই মাসে কার্যকরী কমিটির সদস্য আবদুল বাছির খান বিভিন্ন অনিয়মের উল্লেখ করে ব্রঙ্কস সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোর্টের নির্দেশে ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি মসজিদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন পরিচালনা করে অনেস্ট ব্যালট এসোসিয়েশন। সেই নির্বাচনে দায়িত্ব থাকা কমিটি পরাজয় বরণ করে। কিন্তু তারা- সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বলে অনেস্ট ব্যালট এসোসিয়েশনকে অভিযুক্ত করে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে। কোর্ট তখন কোনো খরচ না নিয়ে অনেস্ট ব্যালট এসোসিয়েশনকে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয়।
ইতিমধ্যে অন্য একটি ঘটনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। ২০০৫ সালে মসজিদের সদস্য আবদুল বাছির খানের দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে আদালত মসজিদ কমিটিকে মসজিদের অ্যাকাউন্ট থেকে ইমামের বেতন ও ইউটিলিটি বিলের অর্থ ছাড়া কোনো অর্থ না ওঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু তৎকালীন কমিটি আদালতের নির্দেশ অমান্য করে মসজিদ ফান্ড থেকে অর্থ উত্তোলন করলে আবদুল বাছির খান আবারো আদালত অমান্যের মোশন দাখিল করলে আদালত তা গ্রহণ করে। আদালতের রায় অমান্য করে সাইড ওয়াক মেরামত, অ্যাটর্নি ফিসহ প্রয়োজন ছিল না এমন সব ব্যয়ের কাগজপত্র হাজির ও ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য মসজিদ কমিটির সদস্যদের কেন ব্যক্তিগত দোষী সাব্যস্ত কিংবা জরিমানা বা শাস্তি দেয়া হবে না- এ ব্যাপারে শুনানির দিন ধার্য করে। অবশ্য পরে দুই বিবদমান গ্রুপের সম্মতিতে ৫ সদস্যের একটি বিবাদ মীমাংসা কমিটি গঠিত হয় এবং পরবর্তীকালে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তা মীমাংসা হয়।
এরপরে পরবর্তী কমিটির বিভিন্ন অনিয়মের উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট কাইয়ুম চৌধুরী ২০১০ সালে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করেন।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে সর্বশেষ মামলাটি দায়ের করা হয় ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট। মসজিদের সাবেক সভাপতি লিয়াকত আলী এবং সাবেক কার্যকরী সদস্য আবদুল বাছির খান বাদি হয়ে ব্রঙ্কস সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি দায়ের করেন।
উল্লেখ্য, গত বছর কার্যকরী কমিটি থেকে সভাপতিসহ ৮ জন সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। মসজিদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জড়িত আবদুল বাছির খান তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, ‘আমি গত কয়েক মাস যাবৎ লক্ষ্য করছি, আমাদের কার্যকরী কমিটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না। তাদের কর্মকা- আমার পছন্দনীয় নয়। আমি বহুবার কার্যকরী কমিটিকে পরামর্শ দিয়েছি গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ সময় কমিটি মসজিদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় গঠনতন্ত্র অনুসরণ করেননি। বর্তমানে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও কার্যকরী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য অনুধাবন করছেন, আমরা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছি। হঠাৎ করে সংবাদপত্রের খবরে যখন দেখলাম সভাপতিসহ কার্যকারী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। আমি তাতে ‘শকড’ হয়েছি। তাই আজ ১৮ (২০১৪) আগস্ট তারিখে পার্কচেস্টার মসজিদের কার্যকরী কমিটির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।’
১৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি থেকে সভাপতিসহ ৮ জন সদস্য পদত্যাগ করায় স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মুসুল্লিরা আশা প্রকাশ করেছিলেন, নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তা না করে কার্যকরী কমিটি শূন্য পদে নতুন সদস্য কো-অপ্ট করে কমিটির কার্যক্রম সচল রাখেন।
বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে পদত্যাগী সভাপতি লিয়াকত আলী এর কার্যকরী সদস্য আবদুল বাছির খান বাদি হয়ে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট ব্রঙ্কস কাউন্টি সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। আর্জিতে তারা উল্লেখ করেন যে, তারা যাদের কো-অপ্ট করেছেন তা গঠনতন্ত্র অনুসারে হয়নি বা এ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যে মিটিং ডাকা হয় তাতে কোরাম পূর্ণ হয়নি। তারা নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান।
দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পর জাজ এ ব্যারেল তার রায়ে অতি সত্বর নির্বাচন করার জন্য মসজিদ কমিটিকে নির্দেশ প্রদান করেন।
নির্বাচন কবে হচ্ছে- এ ব্যাপারে বর্তমান কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক খলিলুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে কার্যকরী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুসারে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে নিয়মিত সভায় নির্বাচন কমিটি গঠনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর গত সপ্তাহে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে পার্কচেস্টার জামে মসজিদের নামে একটি বিজ্ঞাপন নতুন করে বিতর্ক তৈরি করে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, কার্যকরী কমিটির কর্মকা-ে অসন্তুষ্ট হয়ে নয়, যে কয়জন কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন তারা ব্যক্তিগত কারণে তা করেছেন। দুই পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনে পদত্যাগী ৫ জনের পদত্যাগপত্রের কপি তুলে ধরা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে সাধারণ মুসল্লিদের কোনো অপপ্রচারে ‘প্রলুব্ধ’ না হওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়।
এই অপপ্রচার কারা করছে অথবা কি অপপ্রচার তা জানতে চাইলে প্রভাষক খলিলুর রহমান জানান, যারা পদত্যাগ করেছে তারাই অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বর্তমান কমিটি গত ঈদুল ফিতরের নামাজের সময়সূচির বিজ্ঞাপনের অর্থ মসজিদ ফান্ড থেকে না নিয়ে স্পন্সরের মাধ্যমে সে খরচের ব্যবস্থা করে সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু কার্যকরী কমিটি থেকে নির্বাচনের আগে পদত্যাগী সদস্যদের নিয়ে দুই পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনের খরচ কে বহন করবে- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মুসুল্লি মহলে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রভাষক খলিলুর রহমান জানান, পার্কচেস্টার জামে মসজিদ কমিটির নামে এ বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হলেও মসজিদ কমিটি এ অর্থ পরিশোধ করবে না। তাহলে কে করবেন অথবা এতে তার স্বার্থ কি- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকেন।
মসজিদ কমিটির পদত্যাগী সভাপতি লিয়াকত আলী বাংলা পত্রিকাকে বলেন, আমার কখনো নেতৃত্বের লোভ ছিল না। কিন্তু কিছু লোকের পীড়াপীড়িতে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হই। আমি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় অনেকে সহজে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। পরবর্তীকালে আমি সভাপতি নির্বাচিত হই। কিন্তু কার্যত দেখলাম, আমি একজন পুতুল সভাপতি। আমার মতামতের কোনোই গুরুত্ব নেই। আমাকে ছাড়া তারা সিদ্ধান্ত নেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন।
লিয়াকত আলী বলেন, সাবেক সভাপতি ময়েজ উদ্দিন লুলু মিয়ার বিরুদ্ধে তারা যখন অডিট কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে আমি তখন তার ৪ বছর সময়কালের পুরোটার অডিট করার প্রস্তাব দিই। কিন্তু বর্তমান সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক খলিলুর রহমান লুলু মিয়ার সাথে এক টার্মে সাধারণ সম্পাদক থাকায় তারা সে সময়টা অডিটে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হননি। ৪ বছরের পরিবর্তে তারা ২ বছরে অডিট করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা আমার মতামতের সামান্যতম গুরুত্ব দেননি।
লিয়াকত আলী আরো বলেন, মসজিদ সংলগ্ন একটি বাড়ি ক্রয় করার জন্য কমিটির কয়েকজন সদস্য অতিউৎসাহী হয়ে ওঠেন। আমাকে বাদ দিয়েই তারা বাড়ি ক্রয়ের চুক্তি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আমি জানতে পারি এই বাড়ি ক্রয়ের মধ্য দিয়ে কমিটির কয়েকজন ‘পার্সেন্টেজ ব্যবসা’ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমি তাতে বাধা দিই এবং পদত্যাগ করায় তাদের সে সাধ পূরণ হয়নি।
আমি পদত্যাগ করে তাদের বলেছি নতুন নির্বাচন দিতে। মুসুল্লিরা ভোট দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করুক। কিন্তু তারা তাতে রাজি হননি। পরে আমি বাধ্য হয়ে কোর্টের আশ্রয় নিই এবং কোর্ট দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেন।
মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবদুস শহীদের কাছে মসজিদ কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞাপন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বর্তমান কমিটির কর্মকা-ে অসন্তুষ্ট হয়েই সভাপতিসহ ৮ জন সদস্য পদত্যাগ করেছি। জনসমক্ষে তাদের হেয় করতে চাইনি বলেই ‘ব্যক্তিগত কারণ’ উল্লেখ করেছি। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি থেকে সভাপতিসহ ৮ জনের পদত্যাগ ব্যাপারটি যে স্বাভাবিক নয়, তা যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন।
আবদুস শহীদ প্রশ্ন রাখেন, বর্তমান কমিটি ‘কার্যকরী কমিটি থেকে কতিপয় সদস্যের পদত্যাগ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য’ শিরোনামে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে কাদের জানাতে চাইলেন? যদি মসজিদের মুসুল্লিদের জানানোর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে শুক্রবার নামাজের পর অথবা ওয়াক্তিয়া জামাতে মুসুল্লিদের সামনে তা তুলে ধরতে পারতেন। এ জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করতে হতো না। তা না করে তারা পত্রিকায় পূর্ণ দুই পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। এই ব্যয়ভার কে বহন করবে? সাধারণ মুসুল্লিদের দানের অর্থ অপচয় করার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। কেউই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। বর্তমান কমিটিকেও একদিন এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
মসজিদের একজন মুসুল্লি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মসজিদ কমিটিতে কি এমন মধু আছে তা বুঝতে পারি না। অতীতে দেখেছি যারা কমিটিতে থাকেন পরে তারা সেখান থেকে যেতে চান না। নিজেদের প্রয়োজনে তারা গঠনতন্ত্র সংশোধন করেন। আমরা প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আমাদের রক্ত জল করে উপার্জিত অর্থ মসজিদের কাজের জন্য দান করি। আর কমিটির লোকজন নিজেদের জেদ মেটাতে কোর্ট-কাচারি করে সে অর্থ ব্যয় করেন। সাধারণ মুসুল্লিদের অর্থ খরচের বেলায় তাদের মতামত নেয়ার প্রয়োজনটুকু অনুভব করেন না- তা সত্যিই দুঃখজনক। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)