১ জুলাই ২০২২ অপরাহ্ণে নিউ ইয়র্কের লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট রূপ পেয়েছিল এক টুকরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শতবর্ষী এই দেশশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের প্রবাসী এলামনাইরা নিজেদের স্মৃতির স্বর্ণসুষমায় হিরন্ময় করে তুলেছিলেন সময়টাকে। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র সঞ্চালনায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম জন্মদিনে শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানের শুভসূচনা হয়। ম্যারিয়টের ফরেস্টহিল ও ফ্রেশমেডো রুম তখন দেশমাতৃকার প্রতি অপ্রতিরোধ্য আবেগের ফল্গুধারায় সিক্ত হতে থাকে। প্রথা মেনে পরিবেশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতও। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, অর্জন ও ঐতিহ্য নিয়ে দুটি ডকুমেন্টরি প্রদর্শিত হয়। চিরচেনা জায়গার প্রিয়তম স্থানগুলো দেখতে দেখতে মনের অজান্তেই সকলে ফিরে যান নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোতে।
শতবর্ষ পূর্তি উদযাপনের এ অনুষ্ঠানটি ছিলো একেবারেই ব্যতিক্রমী। অনুষ্ঠানে সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি বা বক্তৃতার প্রচলিত প্রথার অনুসরণ ছিলো না। অনুষ্ঠানটিকে সকলের অংশগ্রহণে সর্বজনীন আনন্দের স্মারক হিসেবে তুলে ধরার প্রত্যয়ই অনূদিত হয়েছে সকল কর্মকাÐে। উপস্থিত প্রত্যেকের পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ ছিল অনুষ্ঠানের একমাত্র উপজীব্য। স্মৃতিচারণে প্রত্যেকে নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় হিসেবে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বকালকে উল্লেখ করেছেন পাশাপাশি নিজেদের বর্তমান অবস্থান ও অর্জনের নেপথ্যেও এই প্রতিষ্ঠানের অনবদ্য ভ‚মিকার কথা অকুণ্ঠচিত্তে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে প্রায় সবাই গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করণ, শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যার সমাধান ও মানসম্পন্ন খাবার ও স্বাস্থ্যসেবার কথা বলেছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জনাব মাহতাব উদ্দিন আহমদ (লোক প্রশাসন, ১৯৭৫-৭৬), সাবিনা ইয়াসমিন (আইন, ১৯৯০-৯১), ফারহানা পারভীন (আইন, ১৯৯০-৯১), মাহমুদ স্বপন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ১৯৯০-৯১), ইব্রাহীম খলিল (ইসলামিক স্টাডিজ, ১৯৯১-৯২), খলিলুল্লাহ (গণিত, ১৯৯৬-৯৭), রাজীব মুক্তাদির (সমাজবিজ্ঞান, ১৯৯৮-৯৯), কোহিনূর বেগম (মৃত্তিকাবিজ্ঞান, ১৯৯৮-৯৯), মোহাম্মদ রোকন (ইতিহাস, ১৯৯৮-৯৯), মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (ইসলামের ইতিহাস, ১৯৯৮-৯৯), ইমরান আনসারী (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ২০০০-০১), সজল রোশন (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ২০০০-০১), মামুন রশীদ (ইসলামের ইতিহাস, ২০০৪-০৫), সিলভিয়া সাবরিন (পুষ্টিবিজ্ঞান, ২০০৬-০৬), রেজোয়ানা নাজনিন (সমাজবিজ্ঞান, ২০০৭-০৮), রুখসানা করিম (সঙ্গীত, ২০০৭-০৮), লোকমান হোসাইন (আইন, ২০০৭-০৮), আহসান হাবীব (আইন), শামীম আল আমিন, উম্মে সিদ্দীকা, সামিরা তহসূন, এস সালেহ, এম সুদাইস, মারুফুল ইসলাম, আহমাদ আফনান প্রমুখ।
উদ্যোক্তা আইটিভি ইউএসএ’র কর্ণধার মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, অতিমারী কোভিডের কারণে শতবর্ষপূর্তির উৎসব এক বছর পরে হলেও এ অনুষ্ঠান নিউ ইয়র্কে আমাদের আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ়করণে এবং সর্ববিধ নেটওয়ার্কিং-এ ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। তিনি এলামনাইদের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, এমআইটি, ইয়েলের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খ্যাতি ও সমৃদ্ধির পেছনে এলামনাইদের ভ‚মিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এলামনাই হিসেবে আমাদেরকেও এমন ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
স্টেট ইউনির্ভার্সিটির শিক্ষক ও সাংবাদিক ইমরান আনসারী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জাতিসত্ত¡া গঠনে অনবদ্য অবদান রেখেছে। জনগণের জীবনমান ও চিন্তাধারার মানদÐ ঠিক করে দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস রচনা করেছে। তিনি শীঘ্রই এলামনাইদের জন্য একটি ফলউৎসব আয়োজনেরও ঘোষণা দেন।
অনুষ্ঠানে সোশ্যল মিডিয়ার জনপ্রিয় ব্যক্তি সজল রোশন তাঁর সহজাত ঠংয়ে বলেন, বাংলাদেশে খ্যাতিমান হওয়ার জন্য তিনটি ডিগ্রি আপনার অবশ্যই থাকতে হবে। এসএসসি, এইচএসসি এবং টিএসসি! জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক রুকসানা করিম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রতিটি বছর সঙ্গীতে বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করার দূর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম, নিউ ইয়র্কে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সকল উদ্যোগের সাথে একাত্ম হতে চাই।
নিউ ইয়র্কে অন্যতম বাঙালি উদ্যোক্তা খলিল বিরিয়ানীর স্বত্ত¡াধিকারী জনাব খলিলুল্লাহ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নিজের নামকে ব্রান্ডিং করার প্রেরণা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছি। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার ঋণ অশেষ। তিনি নিজের ব্রান্ডকে আরও সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করার মাধ্যমে এ ঋণ পরিশোধের প্রত্যয় ঘোষণা করেন।
এটর্নি আহসান হাবীব বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার পরিচিতি ও বিশ্বস্ততার মাত্রা ঠিক করে দিয়েছে। এখানে আইনবিদ হিসেবে যাত্রাশুরুর প্রাক্কালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পরিচয় আমাকে সবিশেষ সহযোগিতা করেছে। এ কারণে এখনো কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় নিয়ে সামনে এলে তার আর কোনো পরিচয় প্রয়োজন পরে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আইন কর্মকর্তা ফারহানা পারভীন বলেন, নিউ ইয়র্কে এসে আইনকর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরুর সাহস ও সফলতার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাই ছিল আমার মূলধন।
নিউ ইয়র্কের হাইস্কুল থেকে সদ্য অবসরগ্রহণকারী শিক্ষক জনাব মাহতাব উদ্দিন বলেন, দারুন অস্থির সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু করেছিলাম। কিন্তু সময়ের অস্থিরতা অতিক্রমের সক্ষমতা বরাবরের মতোই এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখাতে পেরেছিল বলেই অদ্যবধি প্রিয়দেশ কাক্সিক্ষত গন্তব্যেই অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যেতে পারছে।
মামুন রশীদ বলেন, নিউ ইয়র্কে এলামনাইদের একটি অভিন্ন ও সর্বজনীন প্লাটফর্ম তৈরির চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি এ চেষ্টা সফল করার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও লেখক ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হলো, বিভিন্ন জাতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠা করেছে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে একটি জাতিকে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও স্মৃতিচারণ শেষে উম্মে সিদ্দীকা ও সামিরা তাহসূন তৈরিকৃত সুদৃশ্য ও বিশালাকৃতির কেক কাটা হয়। অভ্যাগতদের বৈকালিক নাস্তায় আপ্যায়নের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাইদের অভিন্ন একীভ‚ত প্লাটফর্ম তৈরির প্রত্যয় নিয়ে অভ্যাগতরা ঘরে ফিরে যান। আইটিভি ইউএসএ ও রেডিও ৭৮৬ মিডিয়া পার্টনার হিসেবে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করে।
হককথা/টিএ