নিউইয়র্কে বাংলাদেশী তরুণদের মাঝে মাদকের বিস্তারে উদ্বেগ

- প্রকাশের সময় : ১০:৪৯:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৭৩ বার পঠিত
শামীম আল আমিন: নিউইয়র্কে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে দেখা দিয়েছে মাদকের ভয়াবহ সমস্যা। বিশেষ করে তরুণেরা বিভিন্ন ধরণের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। যার ফলে সাম্প্রতিকালে অন্তত বিশ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে একটি মুক্ত আলোচনায় বক্তারা জানিয়েছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর রোববার কুইন্সের জ্যামাইকায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উদ্বেগ প্রকাশ করে, সংকট সমাধানে সন্তানের সঙ্গে বাবা মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সম্মিলিত প্রয়াস নেয়াসহ নানান পরামর্শ উঠে আসে।
সচেতন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত এই মুক্ত আলোচনায় কমিউনিটির নেতা, রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের অত্যতম উদ্যোক্তা নাসির আলী খান পল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তারা মাদক সমস্যার ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে সংকট সমাধানে কি করণীয় রয়েছে; তা নিয়ে বিস্তারিত পরামর্শ দেন।
শুরুতেই নাসির আলী খান পল জানান, ‘সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ১২ জন প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ অতিরিক্তি মাদক সেবনের কারণের মৃত্যুর কথা সামনে এসেছে। তবে এই সংখ্যাটা হবে আরও বেশি; ২০ জনের মতো’। তিনি জানান, লোকলজ্জার বা সামাজিক ভীতির কারণে বাবা মায়েরা সন্তানদের এসব মৃত্যুর ঘটনাকে হৃদরোগ বা অন্য কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন। ফলে সংকটের সঠিক চিত্র সামনে আসছে না’।
স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও মাদকের ভয়াবহতার কথা স্বীকার করলেন। জানালেন, এ নিয়ে গুরুত্ব দিয়েই কাজ করছে তারা। এ সময় বক্তব্য রাখেন ১০৭ প্রিসেঙ্কট এর পুলিশ কর্মকর্তা সাওয়াল আহমেদ এবং ১০৩ নম্বর প্রিসেঙ্কট এর পুলিশ কর্মকর্তা নিলাদ্রী দাস। পুরো অনুষ্ঠানটিতে সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশী আমেরিকান পুলিশ এসোসিয়েশন-বাপা। সংগঠনটির সভাপতি ক্যাপ্টেন কারাম চৌধুরী মাদক সমস্যা সমাধানে তাদের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এই সংকটে কারো সহায়তা প্রয়োজন হলে, আমরা পাশে আছি’।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জুন্নুন চৌধুরী নিউইয়র্কে মাদকের সংকট বাড়ার পেছনে নানা কারণ তুলে ধরেন। তার মধ্যে পরিবারের ভেতরে সম্পৃক্ততার অভাব, বাবা মায়ের অতি প্রত্যাশা, সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব, হতাশা এবং বন্ধুদের চাপ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, এটিকে কেবল একটি সমাজিক সমস্যা হিসেবে দেখলেই চলবে না। মানসিক বিষয় হিসেবেও বিবেচনা করতে হবে। সংকটে পরলে কিভাবে সহায়তা পাওয়া যাবে তার বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া কিংবা লুকিয়ে রাখলে হবে না। সমস্যায় পরলে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। নিউইয়র্ক সিটিতে এ নিয়ে নানা সহায়তা দেয়া হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সাংবাদিক ও লেখক হাসান ফেরদৌস মাদক সংকট সমাধানে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিতভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তরুণদের কথা বেশি করে শুনতে হবে। বিশেষ করে তাদের সাফল্যের কথাও প্রচার পেতে হবে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমকেও মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে’।
জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক মনজুর চৌধুরী বলেন, ‘করোনা মহামারীতে তরুণদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। সেই কারণেও মাদকের সংকট বেড়েছে’। এ নিয়ে ধর্মীয় নেতাদেরও কাজ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে জুম্মার নামাজের খুতবায় বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে যেনো ইমামরা কথা বলেন, সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে’।
বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক হওয়া উচিত বন্ধুত্বপূর্ণ-এমন মন্তব্য করে সাংবাদিক রওশন হক বলেন, সন্তানদের কথা বুঝতে হবে। তাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাতে হবে। কালচারাল গ্যাপ বা সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে এদেশে বেড়ে ওঠা সন্তাদের মনোভাব বুঝতে বাবা মায়েদের অনেক সময় বেগ পেতে হয়। সেই সঙ্গে ব্যস্ত এই নগরে টিকে থাকার জন্যে কাজে ব্যস্ত থাকার কারণেও সন্তাদের ঠিকভাবে সময় দিতে পারেন না অনেকে। এসব কারণেও সন্তানের পথ হয় আলাদা। শত কষ্টেও বিষয়টি নজরে নেয়ার কথা বলেন তিনি।
বক্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের আগামী প্রজন্মের সাফল্যের গল্প কম নয়। তবে আছে ভীত হওয়ার মতো অনেক কারণও। তারই একটি ভয়াবহ মাদক সমস্যা। আসক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ; তাই সংকট সমাধানের যেকোন উদ্যোগে তরুণদের বেশি করে সম্পৃক্ত করার আহবান জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি অনুভা শাহীন বলেন, মাদকের সমস্যা কথা এলে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে দুই ধরণের মানুষ দেখা যায়। এক ধরণের মানুষ, যারা পিছু হটে যায়, বিব্রত বোধ করে। আর আরেক ধরণের মানুষ কেবল সমালোচনাই করে। সংকট যেহেতু চিহিত করা গেছে, আশা করছি সমাধানের উদ্যোগও হবে জোড়ালো।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, কেবল তরুণদের সচেতন করলেও চলবে না। মাদকের উৎস বন্ধ করতে হবে। তার জন্য প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপও চেয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে অতি প্রত্যাশার চাপে সন্তানদের ভারাক্রান্ত না করে উৎসাহ জোগানো এবং সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করারও পরামর্শ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, শহীদ হাসান, সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার সিইও এম এম শাহীন, কমিউনিটি নেতা মোরশেদ আলম, কমিউনিটির নেত্রী মাজেদা উদ্দিন, লেখক ও সাংবাদিক ফাহিম রেজা নূর, জ্যাকসন হাইটস বিজনেস এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ নেওয়াজ, সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, উত্তর আমেরিকা প্রথম আলোর আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী, সাপ্তাহিক নবযুগ এর সম্পাদক শাহাবউদ্দিন সাগর, সঙ্গীত শিল্পী রানো নেওয়াজসহ অনেকে। সার্বিক সহায়তা দিয়েছেন কমিউনিটি বোর্ড মেম্বার আহনাফ আলম এবং রিয়েলটার আনোয়ার হোসেন।
এদিকে অনুষ্ঠানে টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর পূর্তিতে নিহতদের স্মরণ করা হয়। ঘৃণ্য সেই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় যারা ফার্স্ট রেসপন্ডার ছিলেন, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজ করেছেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন। তাদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়।