নিউইয়র্কের মুক্তিযোদ্ধা সমাচার-১ : বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগের প্রশংসা : তালিকা নিয়ে প্রশ্ন
- প্রকাশের সময় : ১২:৪৪:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৫
- / ৭০৫ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের গৌরব, আমাদের অংহকার। এই স্বাধীনতা, গৌরব, অহংকার আর অর্জনের নেপথ্যে রয়েছেন দেশের সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে শহীদ হয়েছেন। আবার অনেকেই প্রাণে বেঁচে পেয়েছেন বীরের মর্যাদা। আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেশের জন্য অধিকতর বীরোত্তপূর্ণ অবদানের জন্য কেউ পেয়েছেন বীর শ্রেষ্ঠ, কেউবা বীরোত্তম, কেউবা বীর প্রতীক আবার কেউবা বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছেন। সরকারীভাবে স্বীকৃত ও প্রদত্ত খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭জন বীর শ্রেষ্ঠ, ৬৯জন বীরোত্তম, ১৭৫জন বীর বিক্রম এবং ৪২৬জন বীর প্রতীকধারী। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য জাতির দূর্ভাগ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও আজো আমাদের শহীদ বা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরী করতে হয়নি। অবশ্য জনশ্রুতি রয়েছে দেশের জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এই তথ্য নিয়েও রয়েছে তর্ক-বিতর্ক। দেশের মতো প্রবাসেও বিশেষ করে নিউইয়র্ক তথা উত্তর আমেরিকায়ও মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, তাঁদের সম্মান প্রভৃতি বিষয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। পরাধীনতার হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও নানা তর্ক-বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ নানা মত-পথ আর রাজনীতির ধারায় বিভক্ত। একাত্তুরের মুক্তিযোদ্ধারা আজ নানা পরিচয়ে পরিচিত। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজ বিতর্কের শিকার, অনেককে ‘রাজাকার’ হিসেবেও চিহ্নিত! অভিযোগ রয়েছে দেশ-প্রবাসের ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র সংখ্যা বাড়ছে। এসব বিতর্ক, অভিযোগ লজ্জার, নিন্দনীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আজ কেউ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, কৃষক-শ্রমিক এমনকি রিক্সা চালক। তারপরও সবার প্রথম পরিচয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’।
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আজ প্রবাসী। নিউইয়র্ক তথা উত্তর আমেরিকায় জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেরই বসবাস। এই প্রবাসেও মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক নামে সংগঠন। প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধারাও রাজনীতিসহ নানা মতে, নানা পথে বিভক্ত। অধিকার আর মর্যাদার ব্যাপারেও ক্ষুব্ধ অনেক মুক্তিযোদ্ধা। এনিয়ে প্রবাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও আপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের আসন ও মর্যাদা নিয়েও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এদিন ঐ অনুষ্ঠান মঞ্চে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আসন রাখা হয়নি এনিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিধা বিভক্ত একাংশের আহ্বায়ক আব্দুল মুকিত চৌধুরী। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী ক্ষোভের সাথে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
এদিকে কমিউনিটির একটি মহল অনেককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘স্বীকৃতি‘ দিতে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেটের একজন আরেকজনকে, আবার আরেকজনকে আরেকজনকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। প্রয়োজনে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে প্ল্যাক, ক্রেস্ট দিতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। ইতিপূর্বে ‘ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অভিযোগে একটি সামাজিক সংগঠনের সভাপতি পদ থেকে একজনকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধা ‘যথাযথ সম্মান’ না পাওয়ায় কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই যাচ্ছেন না। আবার অনেকে মান-সম্মানের ভয়ে নিজেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেই লজ্জাবোধ করেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটির এমনি প্রেক্ষাপটে নানাদিক বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্্ক নিউইয়র্ক এবারের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো উদ্যোগ নেয়। সোসাইটির উদ্যোগটি ভালো ও প্রশংসিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত ২৯ মার্চ ব্রুকলীনে আয়োজিত সোসাইটির স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা হয়। এনিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াগুলোতে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সোসাইটির পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো ৭৯জন। তবে নানা কারনেই তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সোসাইটির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি বা অনুপস্থিত ছিলেন। সোসাইটি সূত্রে জানা গেছে ঐ অনুষ্ঠানে ৩০/৩৫ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সোসাইটির এবারের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য সোসাইটির কার্যকরী পরিষদের সকল কর্মকর্তার সহযোগিতায় সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ আলী এবং ক্রীড়া ও আপ্যায়ন সম্পাদক এনায়েত আলীকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের বাইরেও তিনটি বিষয়কে (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টরের নাম, সেক্টর কমান্ডারের নাম ও মুক্তি বার্তা নম্বর) প্রাধান্য দিয়ে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ এবং সকল প্রবাসীর সহযোগিতা কামনা করা হয়। সেই হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৭৯জন মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে এই বাইরেও আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারেন বলে সোসাইটির কর্মকর্তারা জানিয়ে বলেন, আগামীতে তারা সোসাইটিতে প্রমাণ স্বাপেক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে পরবর্তীতে তাদেরকেও সম্মানিত করা হবে। কর্মকর্তারা বলেন, আমরা চাই প্রবাসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করে জাতির বীরদের সম্মান জানাতে। চাই ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের নিয়ে প্রবাসে যেনো আর বিতর্ক না হয়। সেই সাথে তারা সকল রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশেরও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানান।
এব্যাপরে সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহীম হাওলাদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইউএনএ প্রতিনিধিকে জানান, আমরা আমাদের জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে গর্ব করি। তাঁদেরকে আমরা সম্মান জানাতে চাই। যেখানে সরকারের পক্ষেই আজো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা সম্ভব হয়নি। সেখানে আমাদের জন্য কজটি কঠিন হলেও উদ্যোগ নিতে দোষের কিছু নেই। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে এই প্রথমবারের মতো ব্যাপকারে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে সম্মানিত করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তারপরও সোসাইটির এই উদ্যোগে ভুলত্রুটি হতে পারে। সবার সহযোগিতা পেলে আগামীতে সকল ভুল-ত্রুটি শুধরে আমরা প্রবাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরী করতে পারবো। যা ইতিহাসের অংশ হবে, আমাদের নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। তিনি বলেন, আমরা ভালো কাজের প্রশংসা না পেলেও সকল প্রবাসীর সমর্থন চাই।
বাংলাদেশ সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী ইউএনএ প্রতিনিধিকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টরের নাম, সেক্টর কমান্ডারের নাম ও মুক্তি বার্তা নম্বর প্রভৃতি ডকুমেন্টের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে আমরা ৭৯জন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পেলেও পরবর্তীতে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম পেয়েছি। তবে সব মিলিয়ে ৯০জনের মতো প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। এজন্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী সহ আরো অনেকের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে সোসাইটির তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না পরলেও ৩০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা প্রবাসের সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সাধ্যমত সম্মান জানাতে চাই। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেশ ও প্রবাসের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা’ তৈরী করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করতে পারি মাত্র। তাঁরা আমাদেরকে সহযোগিতা না করলে ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা‘ তৈরী করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রবাসের একজন সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাকে তার তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টরের নাম, সেক্টর কমান্ডারের নাম ও মুক্তি বার্তা নম্বর চাইলে তিনি (মুক্তিযোদ্ধা) আমাদের উপর ক্ষেপে যান। সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজনেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সঠিক ডকুমেন্ট নিয়ে এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মন্তব্য করে মোহাম্মদ আলী বলেন, তা নাহলে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সেই সাথে তর্ক-বিতর্ক আর বিভ্রান্তি চলবেই। এসবের অবসান দরকার। তিনি বলেন, প্রবাসে বসবাসকারী যেসকল মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্ত হতে পারেননি, আগামী দিনে তাদেরকে তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে সাধ্যমত সম্মানিত করার চেষ্টা করা হবে। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।