নিউইয়র্কের ঘটনায় দায় কার?

- প্রকাশের সময় : ১২:৫৩:৪৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১২ বার পঠিত
এম এম মাসুদ ও সিদ্দিকুর রহমান সুমন: সরকারের তরফে পূর্ব প্রস্তুতির কথা বলা হলেও নিউইয়র্কে হেনস্তার শিকার হতে হলো প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের। এ ঘটনায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এ সফর নিয়ে অন্তর্বরতী সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে। নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের ব্যর্থতার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে দাবী করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। হামলা ও হেনস্তার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে অন্তর্বরতী সরকার। এক বিবৃতিতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। নিউইয়র্কে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাধারণ প্রবাসীরাও। তারা বলছেন এ ধরনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এমন ঘটনা এড়াতে সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি বলেও মনে করছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে আসা বাংলাদেশী কামাল বলেন, একটি দলের কর্মীদের মুখে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা বর্ণনা করার মতো নয়। এরা নিজের দেশকে অন্য দেশের মাটিতে হেয় করে ফেললেন। এতে বিদেশীদের কাছে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় আমাদের। এই হামলা শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, এটি বাংলাদেশের মর্যাদা, আমাদের গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার এবং একটি নতুন পথচলার উপরও হামলা। এ ছাড়া বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
নিউইয়র্ক সময় সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকাল তিনটার পর প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীরা জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
সরজমিন দেখা গেছে, জাতীয় ৫ নেতৃবৃন্দকে বিমানবন্দরে রেখে সরকারি প্রটোকল নিয়ে আগেই বের হয়ে যান প্রধান উপদেষ্টা। তার প্রস্থানের প্রায় ১ ঘণ্টা পর বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং এনসিপি’র সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা কোনো প্রটোকল ছাড়াই বিমানবন্দর থেকে বের হন। তখনই ঘটে অপ্রত্যাশিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা। শুরু হয় ডিম নিক্ষেপ ও গালিগালাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনাল থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে যাওয়ার সময় এনসিপি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগর এক নেতা। এসময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী বিএনপি মহাসচিব, এনসিপি’র নেতৃবৃন্দকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। ডা. তাসনিম জারার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে।
ডিম নিক্ষেপের সময়ে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আকতার হোসনের সামনে ছিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাস্তায় শুয়ে তাদের গাড়ির গতিরোধ করার চেষ্টা করেন।
এর আগে তাদের আগমনের পক্ষে সকাল থেকেই ৪ নম্বর টার্মিনালের মুখে জড়ো হন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তবে এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন না। তখন তারা অবস্থান করছিলেন ৮ নম্বর টার্মিনালে। সেখানেই তারা শোডাউন করেন।
উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিস কমিউনিকেশনের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। অতিথিদের বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সময় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী সেখানে হাজির হয়ে উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে শুরু করে। এ সময় মির্জা ফখরুল, আখতার হোসেন ও তাসনিম জারাকে উদ্দেশ্য করে ‘জয় বাংলা’, ‘রাজাকার’, ‘টের পাইছে’সহ অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান ডিম নিক্ষেপের এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন। পরে তাকে আটক করে নিউইয়র্ক পুলিশ।
গ্রেপ্তারের তথ্যের সততা স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হাসিব মামুন জানান, ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছে। বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) তাকে আদালতে প্রেরণ করা হতে পারে।
হামলার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এনসিপি নেতা আকতার হোসেন বলেন, আমরা সেই প্রজন্ম যারা হাসিনার গুলির সামনে দাঁড়াতে ভয় পায়নি। অতএব, কারও ভাঙা ডিমে আমাদের কিছু যায়-আসে না।
হামলার বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আওয়ামী লীগ জন্মগত এবং প্রকৃতিগতভাবে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা যে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ওপর হামলে পড়বে এটাতে আমরা আর অবাক হই না। এনসিপি’র সদস্য সচিব আরও বলেন, অন্তর্র্বতী সরকার এক বছরে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেটি খুব সামান্য অগ্রসর হয়েছে। আওয়ামী লীগের যেসব সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছে, তারা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে। অন্তর্বরতী সরকারের কাছে আহ্বান রাখবো, আওয়ামী লীগের যেসব লোকজন দেশে এবং দেশের বাইরে হামলা করছে তাদের অতিদ্রুত বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে।
এদিকে হামলার পর এনসিপি’র নেতাকর্মীদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। এ সময় তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে স্লোগান দিয়ে বলেন, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর ফ্যাসিবাদ নো মোর, ইনকিলাব ইনকিলাব জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ, মুজিববাদ মুর্দাবাদ, বিচার চাই বিচার চাই, শেখ হাসিনার বিচার চাই, গণহত্যার বিচার চাই, শেখ হাসিনার বিচার চাই’।
এ ঘটনায় সামাজিকমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ প্রবাসীরা। সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার সময় মির্জা ফখরুল, আখতার হোসেন ও তাসনিম জারা আলাদা হয়ে হাঁটছিলেন। এ সময় জামায়াত সমর্থিত প্রবাসীরা অনুরোধ করলেও তারা একত্রে চলেননি। ফলে সুযোগ পেয়ে আওয়ামী লীগের একদল কর্মী মির্জা ফখরুল ও আখতারকে হেনস্তা করে। অন্যদিকে, জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে চারপাশ ঘিরে ঘন নিরাপত্তা দিয়ে সুরক্ষিতভাবে গাড়িতে তুলে দেন জামায়াতের কর্মীরা।
ফেসবুকসহ সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে, বিমানবন্দরে বিএনপি কিংবা এনসিপি’র তেমন কোনো কর্মী উপস্থিত ছিল না। বিপরীতে জামায়াতপন্থি কর্মীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয় এবং তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একদল ডা. তাহের এবং অন্যদল মির্জা ফখরুলদের সহায়তা করছিলেন।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ড. ইউনূসের নিউইয়র্ক আগমনের বিরোধিতা করবে এবং তার হোটেলের সামনেও প্রতিদিন বিক্ষোভ চালাবে। সেই অনুযায়ী তারা রোববারের ঘটনার পরও আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়।
তাসনিম জারার স্ট্যাটাস: যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর হামলার ঘটনায় পরাজিত শক্তির ভয় ও হতাশা দেখছেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা। নিজের ফেসবুক পেজে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি কথা বলেন। তাসনিম জারা লিখেছেন, ‘আজ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর আমাদের দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর হামলা হয়েছে। তাকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়েছে, গালিগালাজ করা হয়েছে। এটি ব্যক্তি আখতার হোসেনের ওপর আক্রমণ নয়, তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে করা হয়েছে।
জামায়াত নেতা তাহেরের নিন্দা: জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ নিয়ে হতাশ বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। সোমবার স্থানীয় সময় রাতে ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এটা আমি পরে জানতে পেরেছি। বিমানবন্দরে থাকা অবস্থায় আমি জানতাম না, কারণ সেখানে প্রচুর বাংলাদেশী আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছে, স্লোগান দিয়েছে এবং স্বাগত জানিয়েছে। তিনি বলেন, এটি হতাশ বা উদ্বিগ্ন হাওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। কারণ ১০ জন এসে একটা মেরে দিতে পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য এটি খুবই লজ্জাজনক। এখানে যারা এটি করেছে তারাই অপমানিত হয়েছে। তারাই বাংলাদেশকে অসম্মানিত করেছে।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির সোমবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, নিউইয়র্কের কনস্যুলার অফিস সঠিকভাবে বিষয়টি সমন্বয় করতে পারেননি। যার ফলে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, দলের মহাসচিবকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে না পারা বিএনপি’র ব্যর্থতা বলে দাবী করেন অনেক নেতাকর্মী। তারা বলছেন, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র নেতাকর্মীদেরও সমন্বয়ের অভাব ছিল। বিমানবন্দরে বিএনপি’র অন্তত ৫০০ নেতাকর্মী উপস্থিত থাকার পরও কেন এমনটা হলো তা খতিয়ে দেখার কথা বলছেন তারা। (দৈনিক মানবজমিন)