নিউইয়র্ক: প্রবাসী চট্টগ্রামবাসীদের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠন চিটাগাং এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা ইন্্ক’র (চট্টগ্রাম সমিতি) কার্যকরী পরিষদ ও ট্রাষ্ট্রিবোর্ডের মধ্যকার দ্বন্দ্বে নতুন সঙ্কটে পড়েছে সংগঠনটি। বিশেষ করে সমিতির ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনাকে কেন্দ্র করেই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে কার্যকরী পরিষদ আর ট্রাষ্টিবোর্ডের মধ্যে। পাল্টা-পাল্টি অভিযোগের পাশাপাশি একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া বিভক্তিও দেখা দিয়েছে কার্যকরী পরিষদে। এরই মধ্যে সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভায় আগামী দু’বছরের জন্য মনোনীত করা হয়েছে টাষ্ট্রিবোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান ও কো চেয়ারম্যান।
সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রাম সমিতি ভবনে নব নির্বাচিত ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মুনির আহমেদ এবং কো-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সিরাজী’র শপথ গ্রহন অনুষ্ঠিত হয়। শপথ বাক্য পাঠ করান সমিতির সভাপতি আকবর আলী। এসময় উপস্থিত ছিলেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ আবু তাহের। উক্ত শপথ গ্রহন শেষে নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান সমিতি’র সকলকে নিয়ে একসাথে কাজ করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। সমিতি’র কার্যক্রম যাতে সুন্দর ও সুষ্টভাবে পরিচালিত হয় তার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। শেষে সভাপতি আকবর আলী নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও কো চেয়ারম্যানকে অভিনন্দন জানিয়ে শপথ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর সমিতির কার্যকরী পরিষদের মাসিক সভায় উপস্থিত সকলের সর্বসম্মতিক্রমে গঠনতন্ত্রের বিধি মেনে ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন করা হয়। এই দুই পদে ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের ১১জন সদস্যের মধ্য থেকেই নতুন দু’জনকে মনোনীত করা হয়। ইতিপূর্বে সমিতির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান ছিলেন যথাক্রমে মোহাম্মদ হানিফ ও মোহাম্মদ সেলিম।
গত বছর অনুষ্ঠিত সমিতির দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন হওয়ার পর ‘আকবর-তাহের’ এর নেতৃত্বে নতুন কার্যকরী পরিষদ বিগত নভেম্বর মাসে শপথ নেয়ার মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই নির্বাচনে সভাপতি পদপ্রার্থী আকবর আলীর প্রতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও তৎকালীন/বিদায়ী ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফের ব্যাপক সমর্থন ছিলো। কিন্তু নির্বাচন শেষে নতুন কার্যকরী পরিষদ দায়িত্ব নেয়ার পর ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফ ও কো-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম সমিতির আর্থিক ব্যবস্থা তথা ব্যাংক একাউন্ট তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবী করেন যা সমিতির গঠনতন্ত্র সিদ্ধ নয়। এনিয়ে কার্যকরী পরিষদ ও ট্রাষ্ট্রি বোর্ড বিশেষ করে বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করায় সমিতির বৃহত্তর স্বার্থে ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় কার্যকরী পরিষদ। সেই মোতাবেক বোর্ডের ঐ দু পদে রদবদল করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
এদিকে নতুন ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান মনোনয়নের খবরের তীব্র প্রতিবাদ করেন সাবেক সভাপতি ও তৎকালীন/বিদায়ী ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফ ও কো-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম। তারা নিজেদেরকে স্ব পদে বহাল দাবী করে বলেছেন, সমিতির কার্যকরী পরিষদ শুধুমাত্র ট্রাষ্টি বোর্ড গঠন করতে পারেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান নির্বাচন করবেন ট্রাষ্টি বোর্ডের ১১ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে। চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদ পরিবর্তনের যদি প্রয়োজন হয় অথবা সমিতির স্বার্থ বিরোধী কোন কাজে জড়িত হয় অথবা কার্যকরী পরিষদের সাথে ট্রাষ্টি বোর্ডের কোন ধরণের মতবিরোধ হলে সংবিধানের ধারা ১০:১২ অনুযায়ী সম্প্রসারিত বোর্ড (যাহা কার্যকরী পরিষদ, ট্রাষ্টি বোর্ড ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে গঠিত) এর সভা আহ্বান করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এতে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে আতœপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান কার্যকরী পরিষদ এ ধরণের কোন নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে সরাসরি ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা গঠনতন্ত্র বিধি অনুযায়ী কার্যকরী পরিষদের এখতিয়ার বহির্ভুত।
সমিতির ব্যাংক একাউন্ট নিজেদের আওতায় রাখার জন্য চাপ বা কুক্ষিগত করার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে তারা বলেন, ‘আমরা যদি এমন জঘন্য অপরাধ করে থাকলে আজ পর্যন্ত কার্যকরী পরিষদ কোন ধরণের কারণ দর্শানোর চিঠি দেয়নি কেন’? তারা বলেন, সমিতির কর্মকান্ডে সহযোগিতার পাশাপাশি অভিষেক অনুষ্ঠানে ট্রাষ্টি বোর্ডের পক্ষ থেকে নগদ ৭০০০ ডলার অনুদান (চেয়ারম্যানের ৩০০০ আর কো-চেয়ারম্যানের ১০০০ ডলারসহ) প্রদান ছাড়াও বার্ষিক ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। যেখানে চেয়ারম্যানের ১৬০০ ডলারের অনুদান রয়েছে। তারা দাবী করেন সমিতির ব্যাংক একাউন্টের ব্যাপারে গঠনবিধির ১২:২ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, ভবন পরিচালনার জন্য ব্যাংক একাউন্ট থাকবে। ভবন পরিচালনা, সংরক্ষণ, সংস্কার, ভাড়া তোলা, মর্টগেজ দেওয়া, ভবন সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা এমনকি মামলা পরিচালনার দায়িত্বভারও ট্রাষ্টি বোর্ডের উপর অর্পিত বলে গঠনবিধিতে সুষ্পষ্টভাবে ধারা ১০:৭ (ক) থেকে ১০:৭ (ঙ)-তে উল্লেখ আছে।
এদিকে সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহম্মদ এস আলী (আলী নূর) এক বিবৃতিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সমিতির গঠনতন্ত্র লংঘনের অভিযোগ এনে বলেন, গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ১০-এর ১২ ধারা লংঘন করে, অবৈধভাবে কোরামবিহীন সভা করে ট্রাষ্টি বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করা হয়েছে। তিনি এই রদবদলের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গঠনতন্ত্র মোতাবেক সমিতি পরিচালনা করবেন। তিনি আরো বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তিন কমিটি বা এনলার্জ বোর্ডের সভা আহ্বান করার কথা বলা হলেও সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক তা করেননি। এমনকি ট্রাষ্টি বোর্ডের দেয়া তিন তিনটি চিঠির জবাবও কার্যকরী পরিষদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি বরং ট্রাষ্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তিনি সকল অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রবাসী চট্টগ্রামবাসীদেরকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম সমিতির উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে সভাপতি আকবর আলী বলেন, আমরা গঠনতন্ত্র মোতাবেক কিছু করিনি। মূলত: সমিতির বিদায়ী চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যানের গঠনতন্ত্র বিরোধী দাবী-দাওয়া এবং ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনার দাবী চলমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর তারা সহযোগিতা করছেন না। সর্বশেষ আয়োজিত পথমেলাও তারা সহযোগিতা করেননি। তিনি আরো বলেন, ট্রাষ্টি বোর্ড থেকে তাদেরকে বাদ দেয়া হয়নি, শুধুমাত্র রদবদল করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে আকবর আলী বলেন, সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভায় কোরাম হতে কমপক্ষে ১১ কর্মকর্তা/সদস্য লাগে। সভার কোরাম পূর্ন হওয়ায় আমরা ট্রাষ্টি বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক যে সভায় অনুপস্থিত ছিলেন, সেই সভায় কোরাম হয়েছে, কি হয়নি তা তিনি জানেন কিভাবে?
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু তাহেরও একরই রকম কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের কাছে রেকর্ড রয়েছে যে, সমিতির একাউন্ট পরিচালনার ভার মোহাম্মদ হানিফ চেয়েছিলেন। যা গঠনতন্ত্র বিরোধী। তিনি বলেন, ট্রাষ্টি বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বকাল হবে আগামী দুই বছর।
চট্টগ্রাম সমিতির চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংগঠনের বিদায়ী সভাপতি কাজী সাখাওয়াত হোসেন (কাজী আযম) বলেন, দুই বছরের জন্য নির্বাচিত কার্যকরী কমিটিকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া উচিৎ। সকলের তাদের সহযোগিতা করা উচিৎ। তিনি বলেন, কার্যকরী পরিষদ ভালো-মন্দ করলে তা আগামী সাধারণ সভায় আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)