বিশেষ প্রতিনিধি: জ্যামাইকার হিলসাইড। দুপুর ২টা। প্রতিদিনের মতো কোনো চিত্র নয়, হঠাৎই ঘটে একটি দুর্ঘটনা। পাল্টে দেয় সমস্ত চিত্র। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে ওয়াকিং সাইন ও রেড লাইট জ্বলে থাকার পরও দু’জন বেপরোয়া গাড়িচালকের কারণে প্রাণ হারাতে বসেছেন কলেজছাত্রী মুশরাত হক। এখন জ্যামাইকা হাসপাতালের আইসিইউতে (কোমা) রয়েছেন।
মুশরাত হক পড়াশোনা করেন ফার্মিংডেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। লেখাপড়া করে চিকিৎসা পেশায় সম্পৃক্ত হবেন, এমন স্বপ্ন দেখলেও সেই স্বপ্ন এখন ভঙ্গ হওয়ার পথে। মুশরাত অন্যান্য দিন কলেজে গেলেও গত সোমবার (২৬ মার্চ) যাননি। দুপুরে গিয়েছিলেন জিমে। জিম থেকে এসে বাসায় লাঞ্চ করবেন বলে গিয়েছিলেন। বাবার কিছু পেপারসও সাইন করে দেওয়ার কথা ছিল। বাবাকে বলে গিয়েছিলেন, বাবা আমি এক ঘণ্টার জন্য জিমে যাচ্ছি। ফিরে এসে তোমার কাগজ সাইন করে দেব। কিন্তু আর ঘরে ফেরা হলো না মুশরাতের। এখন মুশরাত জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। জ্যামাইকা হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা মুশরাতকে চিকিৎসকেরা ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। ৭২ ঘণ্টা পার হতে সময় লাগবে বৃহস্পতিবার (২৯ মার্চ) দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এর আগে কোনো কিছুই করার নেই পরিবারের সদস্যদের। কেবল অপেক্ষা করা ছাড়া। মুশরাতের দুর্ঘটনায় তাদের পরিবারে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে।
মুশরাতের পারিবারিক সূত্র জানায়, সোমবার দুপুর দুইটার দিকে জ্যামাইকা হিলসাইডে মান্নান সুপার মার্কেটের কাছে ৯৯ সেন্স দোকানের সামনে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হক মুশরাত হক। দুই তরুণ ওই রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় ওই সময় রেড লাইট এবং ওয়াকিং সাইন ছিল। কিন্তু তারপরও তারা তা মানেননি।
জ্যামাইকা অ্যাভিনিউয়ের জিম থেকে বাসায় ফেরার জন্য মুশরাত রাস্তা পার হচ্ছিলেন। মুশরাত যখন গাড়ির নিচে পড়েন, তখনো ওয়াকিং সাইন রয়েছে। হাতে সময় ছিল আরও ১৯ সেকেন্ড। ওই সময়ে তার বেশ ভালোভাবেই ওই পারে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়েও রাস্তার এপার থেকে ওপারে যেতে পারেননি। দুর্ঘটনার শিকার হন। লাল রঙের গাড়িটি তাকে চাপা দেয়। ওই গাড়িতে একজন স্প্যানিশও ছিলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী রয়েছেন বেশ কয়েকজন। এর মধ্যে দু’জন সাক্ষী তার পরিবারকে জানিয়েছেন, দুই তরুণ রাস্তায় বেআইনিভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ওখানে গাড়ি চালানোর স্প্রিড ২৫ মাইল। তারা ওই বেগে গাড়ি চালানোর কথা থাকলেও এর চেয়ে বেশি বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এ কারণেই তাদের গাড়ির নিচে পড়ে যান মুশরাত। এছাড়া দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পরও গাড়িচালক ও গাড়িতে থাকা তার অপর সঙ্গী দ্রুত গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মুশরাতকে গাড়ি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে কিছুদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। এ সময়ে ওই এলাকায় থাকা বাঙালী ও অন্য মানুষেরা চিৎকার করতে থাকে। তারা দৌড়ে এসে গাড়িটি আটকানোর চেষ্টা করে এবং গাড়িটি আটকে ফেলে। গাড়ির ভেতরে থাকা ওই দু’জনকেও তারা পালাতে দেয়নি। ঘটনার পরপর ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে আটক করে। মুশরাতকে হাসপাতালে পাঠায়। সেই সঙ্গে গাড়িটিও তারা জব্দ করে। এ ঘটনার আগ পর্যন্ত কিছুই জানত না তার পরিবার। কারণ তখনো তার পরিবারের কাছে কেউ খবর দিতে পারেনি। হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানোর পর হাসপাতাল থেকে ফোন আসে মুশরাতকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরিচিতজনরাও পরে তাকে চিনতে পেরে ফোন করেন বলেন জানান মুশরাতের ভাই আতিক হক।
মুশরাতের চাচা মোকাদ্দেস হক বলেন, আমরা কল্পনাও করতে পারিনি এমন ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর আমাদের হাসপাতাল থেকে জানানো হয় মুশরাত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল থেকে খবর পাওয়ার পর এক মিনিটও দেরি করা সম্ভব হয়নি। আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই। পরে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাকে চারজন চিকিৎসক চিকিৎসা দিচ্ছেন। নিউরোসার্জনদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন তিনি। ঘটনার পর চিকিৎসকেরা জানান, তার অবস্থা সংকটাপন্ন। তার ব্রেনে সার্জারি করতে হবে। মাথার মগজ আংশিক সরে গেছে। পরে তারা পরিবারের অনুমতি নিয়ে রাত সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অপারেশন করেন। তার মাথার খুলি মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, তার ব্যাপারে এখনই তারা আশাবাদী হতে পারছেন না। অপারেশন করা হয়েছে। ৭২ ঘণ্টা দেখতে হবে। ৭২ ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। যদি মিরাকল কিছু হয়, তাহলে মুশরাতকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
মুকাদ্দেস বলেন, ক্লিনিক্যালি ডেড বলেই ধরে নিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এরপর তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও আমরা এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না। আল্লাহর কাছে সবাই দোয়া করছি। অন্যরাও যেন দোয়া করেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুশরাতের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাবা মোশাররফ হোসেন ব্যবসা করেন। ঘটনার দিন মা অপেক্ষা করছিলেন মেয়ের ফিরে আসার। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হলো না। তারা হাসপাতালে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন।
জ্যামাইকা হাইস্কুলের পেছনে তাদের বাসা। মুশরাতরা তিন ভাইবোন। এর মধ্যে মুশরাত দ্বিতীয়। বড় ভাইয়ের বয়স ২০, কলেজে পড়ে। ছোট ভাইয়ের বয়স ১৩, ক্লাস সিক্সে পড়ে। সুখী পরিবার। ভাইদের সঙ্গে মুশরাতের ছিল প্রচন্ড বন্ধুত্ব। তার ভাইয়েরাও বোনের এই দুর্ঘটনার খবরে মুষড়ে পড়েছে। তার বড় ভাই আতিক বলেন, তাকে কোমায় রাখা হয়েছে। আমাদের কাউকে তাকে দেখার জন্য অ্যালাউ করছে না। অপেক্ষা করছি আমরা হাসপাতালে। কখন একটু ভালো খবর পাব এই আশায় নির্ঘুম রাত কাটছে।
জ্যামাইকাবাসীর অনেকেই মনে করছেন, এখানে এই ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও এ রকম একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রায় মাস দুয়েক আগেও একজন মধ্যবয়সী নারীকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করেছে বেপরোয়া গাড়িচালক। তাকে পিষিয়ে দিয়েছে। এর আগেও আরো বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা মনে করেন, এই এলাকাটিতে সমস্যা আছে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য মানুষ সতর্ক থাকলেও সমস্যা রয়েছে রাস্তায়। কারণ এলাকাটি ব্যস্ত। রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এ কারণে মানুষের আনাগোনা বেশি। বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে মানুষ আসে কেনাকাটা করার জন্য। অনেকেই আসে কেবল আড্ডা দেওয়ার জন্য। তারা এমনভাবে আড্ডা দেয় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, এতে করে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণও রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজনকে টিজ করে। মানুষ বিব্রত হলেও প্রতিবাদ করে না। এছাড়া রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকেই বিড়ি-সিগারেট খায়। রাস্তাটির পাশে অনেকেই ডাবল ও ট্রিপল পার্কিং করে। পার্কিং করার কারণে গাড়ি চলাচলে সমস্যা হয়। সব মিলিয়ে এখানে মানুষের চলাচলে সমস্যা বাড়ছে।
তারা মনে করেন, এখানে যাতে আগামী দিনে আর কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য কংগ্রেসম্যান ও কংগ্রেস ওমেনের কাছে আবেদন জানানো তারা যেন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেন। মুশরাতের পরিবারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন করা হবে। সেই সঙ্গে তারা মেয়রের কাছেও আবেদন জানাবেন। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যেই সব সংস্থা জড়িত রয়েছে, তাদের কাছেও আবেদন জানাবে।
মুশরাতের চাচা বলেন, এখানে স্প্রিড বাম্পার বসানো জরুরি, যাতে করে যেকোনো গাড়ি চলাচলের সময় দ্রুত স্প্রিডে যেতে না পারে। পাশাপাশি এই রাস্তায় গাড়ি চলাচলের স্প্রিড ২৫ মাইল। কিন্তু এটা পরিবর্তন করা দরকার। স্প্রিড লিমিট যদি ১৫ মাইল হয়, তাহলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে বলেও জানান।
তিনি বলেন, আমি ড্রাম ও ফ্রেন্ডস সোসাইটির সঙ্গে জড়িত। সেই সংগঠনের পক্ষ থেকেও আমরা ব্যবস্থা নেব। মুশরাতের চাচা মোসাদ্দেক ভাতিজির শোকে কাতর। তিনি ভীষণ বিষণœ। আর কোনো দিন যেন কোনো পরিবারকে এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে না হয় কিংবা কারো মায়ের কোল খালি না হয় সে জন্য তিনি জোর দিয়ে এই দাবি করেন। বলেন, গণমাধ্যমকেও এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, এখানকার গণমাধ্যমগুলোতেও এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে রাস্তার দুই পাশের দোকানগুলো ফুটপাতে মালামাল রেখে দখল করে রেখেছে। দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটা যায় না। একজন মানুষ যে বিপদে পড়লে ফুটপাতের ওপর গিয়ে দাঁড়াবে, সেই উপায়ও নেই। বিশেষ করে হিলসাইডের ১৬৭ স্ট্রিট থেকে ১৬৯ স্ট্রিট পর্যন্ত।
মুশরাতের জন্ম এখানেই। তার বাবা ও মা ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে আসেন। মুশরাতের লেখাপড়া এখানে। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করার পর ডাক্তার হবেন। অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশেই থাকতে পছন্দ করতেন মুশরাত। কমিউনিটি সার্ভিসের সঙ্গে তেমন জড়িত ছিলেন না। লেখাপড়া ভালোভাবে করার জন্য তার চেষ্টাও ছিল। এর পাশাপাশি ব্যায়াম করা তার পছন্দ ছিল। সে কারণেই তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করেন।
এদিকে ঘটনা ঘটার পর রক্ত দেখে মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। পরে অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থায় রাস্তার রক্ত পরিষ্কার করা হয়। মুশরাতের পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, এ ঘটনায় এখনো তারা কোনো মামলা দায়ের করেনি। অপেক্ষা করবেন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। তার জ্ঞান ফিরলে এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। যেহেতু গাড়ি চালক ও তার বন্ধু আটক আছে, তাদের প্রিসেন্ট ১০৭-এ রাখা হয়েছে এ কারণে তারা তাড়াহুড়ো করছেন না। আরও খবর নিয়ে জানা গেছে, চার দিন আগে মুশরাতের বার্থ ডে ছিল। বার্থ ডের অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে। শখ করে বাবাকে বলেছিল, পছন্দের একটি ব্যাগ কিনে দেওয়ার। বাবা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওই ব্যাগ নিয়ে সে পার্টিতে যাবে। কিন্তু সেই ব্যাগটিও তার ব্যবহার করা হলো। ওই ব্যাগ ধরে তার বাবা কাঁদছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে গাড়ি চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়েছে। (সাপ্তাহিক ঠিকানা, ২৮ মার্চ ২০১৮)