নিউইয়র্ক: একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আর বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা জাতির বীর সন্তান। এনিয়ে দেশে প্রবাসে কারো কোন প্রশ্ন নেই। সবাই চায় জাতির বীর সন্তানরা যেখানেই যেভাবেই থাকুন ভালো থাকুন, সম্মানের সাথে থাকুন। কিন্তু দেশে-প্রবাসে জাতির বীরদের অসম্মান-বিভক্তিতে বিব্রত প্রবাসীরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত: রাজনৈতিক মতাদর্শ আর নেতৃত্বের কোন্দলই মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তির প্রধান কারণ।
বাংলাদেশ সরকার সময়ে সময়ে মুক্কিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা আশার কথা শোনান। মাঝে-মধ্যে সেই আশার একটু-আধটু বাস্তবায়িত হলেও সার্বজনীনভাবে আজো হাজারো মুক্তিযোদ্ধা অনাদরে, অবহেলায় জীবন-যাপন করছেন। তাদের অনেকেই নানা অভিমানে অভিমানাহত। জাতির বীর সন্তানদের জীবনাচার, তাদের নিয়ে দেশে-প্রবাসের নানা খবর মিডিয়ায় প্রকাশের ফলে স্বভাবতই দেশের সচেতন মানুষ বিব্রত। আজো মিডিয়ায় সচিত্র খবর আসে ‘একাত্তুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজ ফকির, কেউ ভিক্ষা করছে, কেউবা রিক্সা চালিয়ে বাঁচার সংগ্রাম করছে, কেউবা চিকিৎসা পাচ্ছে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সাম্প্রতিককালে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ নিয়ে স্থানীয় মিডিয়ায় নানা খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে। এসব খবরের প্রেক্ষাপটে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশীরাও নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা জাতির বীরদের অসম্মান-বিভক্তিতে বিব্রতবোধ করছেন।
নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় বসবাসকারী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, দেশে-প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধরা যথাযথ সম্মান না পাওয়া অত্যন্ত দু:খজনক। অবশ্য এজন্য তিনি সর্বাগ্রে মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই দায়ী করে বলেন, আমাদের বিভক্তির জন্যই এমনটি হয়েছে। তারপর রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার রাজনৈতিক বিভাজন আর নেতৃত্বের কোন্দল। তাছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৪ বছরেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণীত না হওয়ায় এই সমস্যা আরো বাড়ছে।
জ্যামাইকায় বসবাসকারী মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান একে এম সফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। কিন্তু আমাদের পূর্ব পূরুষ যেভাবে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের দু:সহ ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে চোখে কান্না এসে যায়। চরম ঘৃণা জন্মে পাক হানাদার আর স্বাধীনতা বিরোধী আল বদর/রাজাকারদের প্রতি। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির বীর সন্তান। অবশ্যই তাদের সম্মান দেয়া উচিৎ, সম্মান জানানো উচিৎ। আর কোন কারণে তাদের সম্মান দেখাতে বা জানাতে না পারলে অন্তত: তারা যেনো অসম্মানিত না হন সেই দিকে সবারই নজর রাখা উচিৎ। কোন কোন অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধারা অসম্মানিত হওয়ায় তিনি বিব্রতবোধ করেন বলে জানান।
নিউইয়র্কের রিচমন্ডহীলে বসবাসকারী মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম খান বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পরিনি। তিনি বলেন, একটি জাতির জীবনে এমন মুক্তিযুদ্ধ আর দ্বিতীয়বার আসবে না। যাদের জন্য আমরা স্বাধীন হয়েছি তারা আমাদের জাতির বীর সন্তান। অবশ্যই তারা সম্মানিত ব্যক্তি। আমরা চাইলেও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যাদের জন্য আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি, স্বাধীন হয়েছি তারা যদি অসম্মানিত হন, দেশে অবহেলায় জীবন কাটান তাহলে দু:খের শেষ নেই। তিনি বলেন, সরকার থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি মানুষের উচিৎ সাধ্যমত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা। তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তি আর অসম্মানের ঘটনায় বিব্রতবাধ করি।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রাণকেন্দ্র জ্যাকসন হাইটসে বসবাসকারী সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, আমি দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি সত্য কিন্তু যুদ্ধের সময়ের কথা মনে আছে। তখন ১০/১২ বছরের কিশোর আমি। সেই দিনে বীভৎস অবস্থার কথা এখনো চেখে ভাসে। তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে হলে সর্বাগ্রে দেশ ও প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক পতাকাতলে আসতে হবে। আর মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত না হলে জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞই থাকবো বলে মন্তব্য করেন তিনি।