অর্থের বিনিময়ে এগুলো জোগাড় করে দিতে কাজ করছে ‘সিন্ডিকেট’ : বাংলাদেশীদের ‘প্রক্লেমেশন’ পাওয়ার হিড়িক
- প্রকাশের সময় : ০২:৪৭:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অগাস্ট ২০১৮
- / ৭৪৪ বার পঠিত
শাহাব উদ্দিন সাগর: নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে প্রক্লেমেশন আর সাইটেশন পাওয়ার হিড়িক পড়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কমিউনিটির কেউ না কেউ সিটি বা স্টেট কিংবা মূলধারার রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে প্রক্লেমেশন-সাইটেশন পাচ্ছেন। সমাজকল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য এ ধরনের প্রক্লেমেশন বা সাইটেশন প্রদান এ দেশের এক প্রচলিত রীতি। অনেক কিছু বিচার বিবেচনা ও যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এই সম্মাননা দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এখন কোনরকম যাচাই-বাছাই কিংবা যোগ্যতা নির্ধারণ ছাড়াই এই সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ এখন কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের।
অভিযোগ উঠেছে, একদা বাংলাদেশ কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এ ধরনের সম্মাননা পেলেও এখন বাছ-বিচারহীনভাবে দেয়া হচ্ছে প্রক্লেমেশন বা সাইটেশন। যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনীতিকরা একসময় বাছাই করে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে অবদান রাখার জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দিতেন। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই।
অভিযোগ উঠেছে, মূলধারার রাজনীতিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি এই সব প্রক্লেমেশন-সাইটেশন এনে দেয়ার ‘বাণিজ্য’ করছেন। এটি এখন এক ধরনের ওপেন সিক্রেট যে মূলধারার রাজনীতিকদের নানাভাবে সম্মত করিয়ে এই সব ব্যক্তিরা তাদের পছন্দের অনেক গুরুত্বহীন মানুষদের জন্য প্রক্লেমেশন বা সাইটেশন জুটিয়ে দিচ্ছেন।
আরো অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন জোগাড় করে দেয়ার ক্ষেত্রে গোপনে অর্থ লেনদেনের ব্যাপারটিও চলছে। বলা হচ্ছে, বাজারের পণ্যের মতো এখন প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। আর এই কেনা-বেচার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে একটি বিশেষ সিন্ডিকেট, যারা কিনা নিজেদেরকে মূলধারার রাজনীতিক হিসেবে সমাজে পরিচয় দিয়ে বাহবা নিচ্ছেন। কমিউনিটিতে এ অভিযোগ এখন ব্যাপকভাবে প্রচারিত যে, এসব প্রক্লেমেশন ও সাইটেশনের জন্য সিটি, স্টেট ও কংগ্রেসম্যান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দর হাঁকানো হয়।
কমিউনিটির বিশিষ্টজনরা বলছেন, মেলা ও বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে এই সাইটেশন ও প্রক্লেমেশন বাণিজ্য বেশি হয়ে থাকে। অনুষ্ঠান যারা স্পন্সর করেন তারা আগেভাগেই প্রক্লেমেশন ও সাইটেশনের পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে নেন। এ নিয়ে রীতিমতো দর কষাকষি চলে। কংগ্রেশনাল প্রক্লেমেশন নিতে হলে কত বা সিটি ও স্টেট থেকে এ ধরনের সম্মাননা পাওয়ার জন্য কত দিতে হবে তা ফায়সালা করেই অনেকে অনুষ্ঠান স্পন্সর করেন। এর সঙ্গে একটি সম্মাননা ক্রেস্টও চেয়ে বসেন অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি মেলা বা উৎসব-অনুষ্ঠানে সাইটেশন ও প্রক্লেমেশন দেয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে মেলা বা উৎসবের আয়োজকদের নাম থাকে শীর্ষ স্থানে। এর সাথে যুক্ত হয় কমিউনিটির অন্য ব্যক্তিদের নাম। যাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি প্রকৃত অর্থেই প্রক্লেমেশন লাভের যোগ্য হলেও তাদের সাথে এমন অনেকের নামই আসে যাদের এগুলি পাওয়া নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিউনিটির একাধিক ব্যক্তি বলেন, এক সময় বাংলাদেশী কমিউনিটির কোন ব্যক্তি কংগ্রেশনাল প্রক্লেমেশন বা সাইটেশন পেলে আমরা তাকে অভিনন্দিত করতাম, তাকে দেখতে যেতাম। তারা ছিলেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাদের সেসব প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন আমাদের কাছে ‘সোনার হরফে বাঁধা’ সম্মাননার মর্যাদা পেত। কিন্তু এখন ঘরে ঘরে প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন। এসব প্রক্লেমেশন ও সাইটেশনগুলোতে গৎবাঁধা সব কথা লেখা থাকে। একই ধরনের লেখায় শুধু নামটা বসিয়ে একটি কাগজের ফোল্ডারে তুলে দেয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতে। অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে কমিউনিটিতে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মাননাগুলো পাচ্ছেন এসব ব্যক্তিরা।
প্রক্লেমেশন ও সম্মাননা পাওয়া অনেক ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে নানা অপরাধে গ্রেফতার হওয়া কিংবা সমাজকল্যাণমূলক কোন কাজে জড়িত না থাকা ব্যক্তিদেরও দেখা মিলছে।
পাঁচ বছর আগে জ্যামাইকার একজন বাংলাদেশী একটি কংগ্রেশনাল প্রকেèমেশন পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি এক বছর এই প্রক্লেমেশন খুবই যতœ করে লিভিংরুমের দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন আমি এটিকে নামিয়ে বেইসমেন্টে নিয়ে গিয়েছি। কারণ এ প্রক্লেমেশন আমার দৃষ্টিতে আর মর্যাদার প্রতীক নেই। এখানে এখন কাজ করছে অর্থ ও কানেকশন।
গুরুত্বর্পূূর্ণ তথ্য উল্লেখ করে ওই ব্যক্তি বলেন, আমরা দেখি প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন নির্ধারণ হয়ে যায় মুলধারার রাজনীতিকদের নির্বাচনের ‘ফান্ড রেইজিং’-এর সময়। ফান্ড রেইজিংয়ে কারা যোগ দিলেন এবং কারা কত বেশি কন্ট্রিবিউট করলেন তাদের নাম লিখে রাখা হয় আয়োজকদের খাতায়। এর পর সুযোগ মতো ওই মূলধারার রাজনীতিকদের কাছ থেকে তাদের নামে প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন এনে সংশ্লিষ্টদের হাতে দেয়া হয়। এসময় মূলধারার রাজনীতিকদের বুঝানো হয় ‘এইসব লোক নির্বাচনে আপনাকে সাহায্য করেছেন, তারা আপনার সঙ্গে আছেন, ভবিষ্যতেও তাদের আপনাকে লাগবে।’
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নিউইয়র্কে প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন এনে দেয়ার জন্য কয়েকটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা নিজেদের মূলধারার রাজনীতিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এমনও অভিযোগ আছে, এ সিন্ডিকেটের লোকেরা শুধু যে অর্থের বিনিময়ে প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন এনে দিয়ে থাকেন তাই না, কে কতজনকে কত বেশি এগুলি এনে দিতে পারেন তার জন্য তাদের মধ্যে চলে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা।
আমেরিকায় বাংলাদেশী কমিউনিটি বির্নিমানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বেশ ক’জন খ্যাতনামা ব্যক্তি বলেন, প্রক্লেমেশন জোগাড় করে দেয়ার এ ধরনের তৎপরতা খুবই ঘৃণ্য কাজ। প্রক্লেমেশন ও সাইটেশনের এখন আর আগের মতো মূল্য নেই। এখন হাত বাড়ালেই তা পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রক্লেমেশন জোগাড় করা সিন্ডিকেটের সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। আমাদের মনে হয় বাংলাদেশীরাই সবচেয়ে বেশি প্রক্লেমেশন ও সাইটেশন নিয়ে থাকেন মূলধারার রাজনীতিকদের কাছ থেকে। যাতে কিনা অনেক মূলধারার রাজনীতিকের অফিসও মহা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তারা এগুলো দিতে এখন আর আগ্রহ দেখাননা। কারণ এগুলি এখন সব অপাত্রের হাতে গিয়ে পড়ছে।(সাপ্তাহিক আজকাল)