সর্বস্তরের বিপুল প্রবাসীর অংশগ্রহণ ॥ সমন্বয়ের অভাব : কবির চিন্তা-চেতনা লালন-পালনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে নজরুল সম্মেলন সমাপ্ত
- প্রকাশের সময় : ০৩:২৬:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ মে ২০১৬
- / ৮৯৩ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা-চেতনা লালন-পালনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো ষোড়শ উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলন। কুইন্স বরোর জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউস্থ সুসান বি এন্থনী স্কুল মিলনায়তনে ২৮-২৯ মে যথাক্রমে শনি ও রোববার দু’দিনব্যাপী এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবছর নজরুল সম্মেলনের স্বাগতিক সংগঠন ছিলো নিউজার্সীর শতদল আর সহযোগি সংগঠন ছিলো জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি। সম্মেলনের শ্লোগান ছিলো ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’। প্রথম দিন সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া) বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান ইকবাল বাহার চৌধুরী। সম্মেলনের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে ছিলো কবির জীবনী নিয়ে আলোচনা, সেমিনার, কবির কবিতা পাঠ, নাটিকা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি। এছাড়াও ছিলো শিশু-কিশোর-কিশোরীদের আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, রচনা, সঙ্গীত ও নৃত্য প্রতিযোগিতা। আরো ছিলো বই, পোষাক-পরিচ্ছেদ আর খাবরের স্টল। প্রতিদিন অপরাহ্ন থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানমালা চলে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: নজরুল সম্মেলনের প্রথম দিন ২৮ মে শনিবার সন্ধ্যায় এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এই পর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সম্মেলনের প্রধান অতিথি ইকবাল বাহার চৌধুরী, বিশেষ অতিথি নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে নিযুক্ত কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, আমন্ত্রিত অতিথি কবি নাতনী অনিন্দিতা কাজী, সম্মেলন কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ড. দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ, সহ সভাপতি অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সাবেক কর্মকর্তা ওয়াহিদ হোসাইনী, প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর ডিকেন্স ও সাংস্কৃতিক কমিটির চেয়ারম্যান এমদাদুল হক। স্বাগত বক্তব্য রাখার পর এই পর্ব পরিচালনা করেন সম্মেলনের আহ্বায়ক মো: কবির কিরণ।
অনুষ্ঠানে ইকবাল বাহার চৌধুরী তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে কবি নজরুলের সাথে তার পারিবারিক সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯২৬ সালে কবি নজরুল চট্টগ্রামে আমাদের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। তাঁর অনেক বিখ্যাত কবিতা আমাদের বাড়ীতেই লিখেছেন। কবি যখন জেলে আটক ছিলেন তখন জেলখানা থেকে পাওয়া কবির কবিতা ও গান সেই সময়ে সূর্যসেনরা দল বেধে পরিবেশন করতেন। তিনি বলেন, নজরুলকে দেশে প্রবাসে আরো ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে কবি নজরুলকে নিয়ে যেতে হবে, কবির চিন্তা-চেতনাকে তুলে ধরতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি বা গীতিকারই নন তিনি একজন ফিলোসোফার (দার্শনিক), পলিটিশিয়ান (রাজনীতিক) সর্বপরি একজন যোদ্ধা ও বীর ছিলেন। কবিকে যথাযথ সম্মান দিতে ও জানাতে পারলেই নজরুল সম্মেলন সফল ও স্বার্থক হবে।
কনসাল জেনারের শামীম আহসান বলেন, বাংলা সাহিত্যকে যাঁরা বিশ্বের দরবাসে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সম্মানিত করেছেন তাঁদের শিরোমনি কবি নজরুল আর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুল-রবিকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যের কথা চিন্তাও করা যায় না। বাংলা সাহিত্য জগতে নজরুল-রবি অবিচ্ছেদ্য। তাই তাদেরকে আরো জানতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। কবি নজরুলকে যথাযথভাবে সম্মানিত করতে পারলে, তার চিন্তা-চেতনাকে লালন-পালন করতে পারলেই নজরুল সম্মেলন সফল ও স্বার্থক হবে।
কবি নাতনী অনিন্দিতা কাজী বলেন, দু:খী-সংগ্রামী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে অবহেলিত হলেও শেষ বয়সে তিনি যথাযথ সম্মানিত হয়েছেন। কবি ঢাকায় চির শায়িত আছেন। অনিন্দিতা কাজী বলেন, কবি নজরুলকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই আমাদের দায়িত্ব ও কাজ। আমার ভালো লাগছে যে, বাংলাদেশের বাইরেও বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে নিয়ে ভাবছেন, কবির চেতনার কথা বলছেন। কবি নজরুল ছড়িয়ে আছেন বিশ্বব্যাপী। কবি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে। নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুলকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য তিনি সংশ্লিস্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
পরে অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন কনসাল জেনারেল পতœী প্যান্ডোরা চৌধুরী ও সাবরিনা কবীর ছন্দা।
অপ্রীতিকর ঘটনা: এদিকে উদ্বোধনী পর্ব শেষে মূল মঞ্চের পিছনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ফলে কিছুক্ষণের জন্য অনুষ্ঠান পরিচালনায় বিঘœ ঘটে। জানা গেছে, সম্মেলনের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝির কারণে ঐ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে সিনিয়র ব্যক্তিবর্গের হস্তক্ষেপে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে।
পরবর্তীতে সম্মেলনের সদস্য সচিব ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার মূল মঞ্চে আমন্ত্রিত অতিথি ও পৃষ্ঠপোষক সহ সম্মেলন কমিটির কর্মকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেন।
সেমিনার: নজরুল সম্মেলনে একাধিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ‘নজরুল ও সুফিজম’,‘অনাবিষ্কৃত নজরুল’, ‘যুক্তরাষ্ট্রে নজরুলের একাডেমীক কার্যক্রম’,‘কবি নজরুলের সাহিত্য অনুবাদ’ প্রভৃতি বিষয়ে সেমিনারগুলো অনুষ্ঠিত হয়। অথিথিগণ ছাড়াও প্রবাসের বিশিষ্টজনরা এসব সেমিনারে অংশ নেন। সেমিনারগুলো নজরুলের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠে। বিশেষ করে কবির শৈশব, কৈশর ও যৌবনের সংগ্রামী জীবন, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, কবির সংগ্রামী চেতনা, বিদ্রোহ, দেশপ্রেম, প্রেম-ভালবাসা, ভালোলাগা উঠে আসে বারংবার। সেমিনারগুলোতে বক্তারা বলেন, নজরুলকে নিয়ে যতই গবেষণা করা হবে তাঁকে গভীরভাবে ততই জানা যাবে, উপলব্ধি করা যাবে। কবিকে জানার শেষ নেই।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশ থেকে আগত জনপ্রিয় নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা, সুজিত মোস্তফা, লিনা তাপসী, অনুপ বড়–য়া ও শহীদ কবীর পলাশ, ভারত থেকে আগত কবি নজরুলের নাতনী অনিন্দিতা কাজী, নিউজিল্যান্ড থেকে আগত সাবিহা মাহবুব। আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে নৃত্য পরিবেশন করেন বাংলাদেশ থেকে আগত মুনমুন ও তার দল। এছাড়া ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আগত সামিয়া মাহবুব ও ফ্লোরিডা থেকে আগত শিল্পী শর্মীষ্টা ব্যানার্জী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অপরদিকে প্রবাসের শিল্পীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শতদল, সুর-ছন্দ, উদীচী যুক্তরাষ্ট্র, বাফা, রঙালয়, সঙ্গীত পরিষদ নিউইয়র্ক, সৌখিন শিল্পী গোষ্ঠী, বহ্নিশিখা, সুরবাহার, শিল্পকলা একাডেমী, জ্যামাইকা থিয়েটার, পন্ডিত কৃষান মহারাজ তাল তরঙ্গ। এছাড়াও প্রবাসের শিল্পীরা সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন এবং কবিতা আবৃত্তি করেন।
নজরুল সম্মেলনের বিভিন্ন পর্ব উপস্থানায় ছিলেন শারমীর রেজা ইভা, আবীর আলমগীর, সাবিনা শারমিন নিহার, ডানা ইসলাম, সৈয়দা আক্তার পারভীন ও মেহের কবীর।
নিউইয়র্ক ছাড়াও ট্রাইষ্টেট এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ষ্টেট থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা নজরুল সম্মেলনে যোগ দেন। সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক নজরুল প্রেমীর উপস্থিতিতে সম্মেলনটি মিলন মেলায় পরিণত হয়। তবে সম্মেলনে আয়োজকদের মাঝে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী মোতাবেক অনুষ্ঠান সময়মত পরিবেশিত হয়নি এবং অনেক অনুষ্ঠান পরিবেশনায় সংক্ষেপ করতে হয়।
এবারের নজরুল সম্মেলন আয়োজনে টাইটেল স্পন্সর ছিলেন রাহাত মুক্তাদীর ইনক’র সিইও রাহাত মুক্তাদীর, গ্র্যান্ড স্পন্সর ছিলেন বিশিষ্ট সমাজেসেবী ও রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর মো: আনোয়ার হোসেন এবং গোল্ড স্পন্সর ছিলেন পিপল এন্ড টেক ও ওয়েলকেয়ার। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)