ভাসানী ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও মওলানার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
- প্রকাশের সময় : ০৭:৪৭:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০১৬
- / ৮৮৪ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, আফ্রো-এশিয়া ল্যাতিন আমেরিকার অবিসংবাদিত মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে নিউইয়র্কস্থ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফাউন্ডেশন আয়োজিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা বলেছেন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তা আজ ভুলন্ঠিত হতে চলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু নীতির ফলে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হতে চলেছে। দেশে মজলুমের উপর জুলমবাজদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চলছে। অথচ কোথাও প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই। ভাসানী’র ‘খামোশ’ বলার মতো নেতা নেই। বক্তারা বলেন, মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকলে এমন অবস্থা হতো না। বক্তারা মওলানা ভাসানীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
সিটির জ্যাকসন হাইটস্থ মেজবান রেষ্টুরেন্টে গত ২০ নভেম্বর রোববার আয়োজিত ‘রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণে মওলানা ভাসানীর শিক্ষা’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা ভাসানীর একনিষ্ট সহচর, সাবেক মন্ত্রী ও লেখক মোস্তফা জামাল হায়দার। সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন মওলানা ভাসানীর কর্মী, অবিভক্ত ঢাকার মেয়র, সাবেক মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং মওলানা ভাসানীর উপর প্রথম পিএইচডি প্রাপ্ত কানাডার মন্ট্রিয়েলস্থ ডাউসন কলেজের অধ্যাপক ড. আবিদ বাহার। খবর ইউএনএ’র।
সম্মেলনের আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক দেওয়ান সামসুল আরেফীন এবং অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল আলী ইমাম শিকদার। বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সম্মেলনের কর্মকান্ড চলে। সেমিনার ছাড়াও সম্মেলনের কর্মকান্ডের মধ্যে থাকবে মওলানার উপর স্থিরচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শণী, ভাসানী ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রকাশনা ও পুস্তকাবলী প্রদর্শন এবং বিভিন্ন খ্যাতিমান লেখকের লেখা সমৃদ্ধ ‘ভাসানী’ শীর্ষক স্মরণিকা প্রকাশ। স্মরণিকাটি সম্পাদনা করেন সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের।
সম্মেলন শেষে আগামী তিন বছরের (২০১৭-২০১৯) জন্য ফাউন্ডেশনের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটির সভাপতি সৈয়দ টিপু সুলতান এবং সেক্রেটারী জেনারেল পদে আলী ইমাম শিকদার পুন:নির্বাচিত হন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে মওলানা ভাসানীর জীবনের উপর নির্মিত সøাইড শো প্রদর্শণ করা হয়। এরপর বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী স্বপ্না কাউসারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করার পর মওলানা ভাসানী সহ সমগ্র বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
আলোচনায় অংশ নেন সাপ্তাহিক আজকাল সম্পাদক মনজুর আহমদ, সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুর রহিম আজাদ, ফাউন্ডেশনের সহ সভাপতি মঈনুদ্দীন নাসের ও টিপু সুলতান, সহ সাধারণ সম্পাদক আজহারুল হক মিলন, কোষাধ্যক্ষ মাহাম্মদ হোসেন খান, কার্যকরী কমিটির সদস্য আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, রিটা রহমান, কাজী ফৌজিয়া, এডভোকেট অহিদুর রহমান, আবু মোহাম্মদ ইশতিয়াক আজিজ প্রমুখ। এছাড়া কবিতা পাঠ করেন নূরুল হক, শাহান শাহ, এম এ ছাদেক প্রমুখ।
সম্মেলনে মোস্তফা জামাল হায়দার তার বক্তব্যে মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরে বলেন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তা আজ অনুপস্থিত। মওলানা ভাসানী ছিলেন সকল অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, হুশিয়ার। তিনি বলেন, সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। আজ মওলানা ভাসানী নেই, ফলে দেশের সমস্যা আরো বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে হবে।
সাদেক হোসেন খোকা বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া এবং স্বাধীনতা পরবর্তী তাঁর জীবদ্দশায় দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন মওলানা ভাসানী হুজুর। আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার ইঙ্গিত দেন। পরবর্তীতে এক জনসভায় বলেন- ‘ওরা কেউ আসেনি’। তাই প্রকৃত অর্থে মওলানা ভাসানীই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক। তিনি বলেন, ভাসানীর সকল সিদ্ধান্তই সঠিক ছিলো। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের ঘটনার পর যার (শেখ মুজিব) প্রধান দায়িত্ব পালন করার কথা ছিলো, তিনি জাতিকে কোন দিক নির্দেশনা দিলেন না। বরং কোন দায়বদ্ধতা না থাকার পরও মওলানা ভাসানী জাতিকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতে অবস্থান অনুকুল না থাকার পরও সেখানে অবস্থান করেছেন। তিনি বলেন, মওলনা ভাসানী স্বাধীন দেশে ফিরে বলেছেন- ‘আমরা পিন্ডির জিঞ্জির ভেঙ্গেছি, দিল্লীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হতে নয়’। তিনি মওলানার ভাসানীর আদর্শ বুকে ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের আন্দোলনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ড. আবিদ বাহার বলেন, স্বল্প সময়ে মওলানা ভাসানীর ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ভাসানীতে চিনতে-জানতে আমাকে কানাডা থেকে তিনবার বাংলাদেশ সফর করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ভাসানীর রাজনৈদিক চরিত্রের মূল ছিলো ‘টলারেন্স আর রেসপেক্ট’। যা আজকের রাজনীতিতে দেখা যায় না। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর ধর্ম নিরপেক্ষতা আজ ধর্ম হীনতায় পরিণত হয়েছে। তাঁর রাজনীতি ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা।
মনজুর আহমদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছে আমাদের প্রশ্ন আজ দেশের অবস্থা এমন কেন? বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কারণ কি? বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে চেহারা কি? আমরা কি এখনো সর্বভৌম? কেনো কোথাও প্রতিবাদ নেই? দেশের রাজনীতিকরা কি ব্যর্থ, তারা কি হাত গুটিয়ে নিয়েছেন? আজকের বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী উপেক্ষিত কেনো? দেশ এমন একজন রমনীর হাতে যিনি কিনা প্রতিবাদ নয়, চাটুকারিতা চান। কোথায় আমাদের দূর্বলতা, কোথায় সংকীর্ণতা?
আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু বলেন, মওলানা ভাসানীর অবস্থান অনেক উপরে থাকার পরও বাংলাদেশে আজ তিনি উপেক্ষিত। আমাদের ইতিহাস আমাদের মতো করেই লিখতে হবে। তা নাহলে নতুন প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জানবে। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। ভাসানীকে অনুভব করতে না পারলে বাংলাদেশকে অনুভব করা যাবে না। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তিনি মওলানা ভাসানীর রাজনীতি প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে বলেন, দেশকে সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এছাড়া প্রবাসে মওলানা ভাসানীতে তুলে ধরার জন্য প্রতি মাসে স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করার জন্য তিনি ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
সম্মেলনে ৫ দফা সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাঠ করেন ফাউন্ডেশনের সহ সভাপতি মঈনুদ্দীন নাসের। সম্মেলনে ভাসানী হুজুর ভক্ত বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী উপস্থিত ছিলেন।