পিতার ‘ভালোবাসার-ক্যানভাসে’ আঁকা ‘কন্যার রঙতুলি’
- প্রকাশের সময় : ০১:৩০:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ জুন ২০১৮
- / ১৩০৭ বার পঠিত
শান চৌধুরী: ‘নাজাহ্ চৌধুরী প্রাবন্তি’। ছোট্ট এ কিশোরীর জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বড় বোন ‘তামান্না রহমান পূর্বা’র লেখা-পড়ার সুবাধে বাংলাদেশে বসবাস তার। টানা কয়েক বছর ধরেই ‘লাল-সবুজ আর প্রকৃতির অভয়ারণ্যের সাথে মিশে গেছে সে। ‘প্রাবন্তি ও তার বড় বোন পূর্বা’ এবং বাবা-মা সবাই আমেরিকান নাগরিক। কর্মব্যস্ত অভিবাসী পিতা বেশীর ভাগ সময় নিউইয়র্কে অবস্থান করেন। যদিও উভয়ে বছরে অন্তত একবার বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে সময় কাটান। কখনো ‘সামার-ভেকেশেন’ আবার কখনো ‘ঈদ-ছুটি’; পুরো পরিবার মিলে একসঙ্গে উপভোগ করে এসব বিশেষ দিন।
‘নাজাহ্ চৌধুরী প্রাবন্তি’ গেল কয়েক বছর ধরেই ‘মা-বোনের’ সাথেই বাংলাদেশে অবস্থান করছে। নিজে পড়ছে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আর বড় বোন ‘পূর্বা’ ময়মনসিংহ মেডিকেলে ইটার্ণ করছে। এমবিবিএস পাশ করা ‘পূর্বা’র মেডিকেলের প্রাথমিক স্তর প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগিরই পুরোপুরি ভাবে নিজেদের জন্মভূমি নিউইয়র্কে থিঁতু হচ্ছে তারা দু’বোন। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারি অভিবাসী ‘বাবা-মায়ের’ কঠোর পরিশ্রম আর ত্যাগের ফসল ‘প্রাবন্তি-পূর্বা’। নিজ দেশে কিংবা আমেরিকাতে বাস করুক না কেন; তাদের জীবন চলার পথে কোন কিছুর কমতি রাখেন নি পিতা-মাতা। বাস্তব হলেও সত্য তথাকথিত আধুনিক যুগে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারি সন্তানদের আদর্শিক ভাবে গড়ে তোলেছেন তারা। যার জলন্ত উদাহরণ ফুটে উঠে, দু’বোনের কৃতিকর্মে, আদর্শ এবং চিন্তা-চেতনায়।
বিশ্ব-ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে জন্মনেয়া কিংবা বেড়ে উঠা ‘প্রাবন্তি-পূর্বার’ রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য কিংবা স্বীয় গুনাবলি। তাদের একজন ‘প্রকৃতি-প্রেমী’ আর অন্যজন ‘মানবসেবী’। এছাড়া দু’জনের মধ্যেই আছে ভিন্ন ভিন্ন আবেগ। রয়েছে অন্যের জন্য কিছু একটা করতে পারার অসম প্রতিযোগিতা। ডাক্তারি পাশ করা ‘পূর্বা’ অসহায় ‘রোগিদের-সেবা’ দিয়ে এরই মধ্যে সহপাঠি আর অগ্রজদের মধ্যমণি বনে গেছে। আর স্কুল পড়–য়া কিশোরী ‘প্রাবন্তির’ মাঝে রয়েছে প্রকৃতি প্রেম আর শিশুদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা।
এ পরিবারটির সাথে আমার একটানা উঠা বসা দীর্ঘ দিনের। রয়েছে রক্তের সম্পর্ক আর ভালোবাসা! সে সবে ইতিহাসে নাই বা গেলাম। ‘ভাই-বোন, বাবা-মা কিংবা বন্ধু-বান্ধব’; সব সম্পর্কই টিকে থাকে একে-অন্যকে বোঝা-পড়ার মাধ্যদিয়ে। কোন ‘দাঁড়িপাল্লায়’ এসব সম্পর্কের যন্ত্র কিংবা মাপকাঠি নেই।
‘নাজাহ্ চৌধুরী প্রাবন্তি’ আর ‘তামান্না রহমান পূর্বা’ এ দু’জন মেধাবি সন্তানের গর্বিত বাবা-মা হিসেবে সফল এক বাংলাদেশী অভিবাসীর গল্প বলছিলাম। সন্তানদের দেশীয় সংস্কৃতি আর পারিবারিক মূল্যবোধ এবং পাওয়া না পাওয়ার মধ্যেই বড় করেছেন তাদের অভিভাবকরা। এ দু’জনকে আমি গেল চার বছরে যতদুর দেখেছি; ততটাই অবাক হয়েছি। ছোট্ট এ পরিবারটিতে ভালোবাসায় ‘টুই-টম্বুর’। পিতার সাথে কন্যাদের, আর মায়ের সাথে আদরের সন্তানদের! সে যে কি অপূর্ব ‘ক্যামেস্ট্রি’!! যা না দেখলে বোঝা যেতো না।
শুরুতেই বলছিলাম- পিতার ‘ভালোবাসার-ক্যানভাসে’ আঁকা ‘কন্যার-রঙতুলি’। বড় মেয়ে ডাক্তার। ছোট্ট মেয়েটি লেখা-পড়ার পাশাপাশি ‘চিত্রকর্মে’ ডুবে থাকে। আমেরিকায় জন্ম নিয়েও ‘বাংলা/ইংরেজী’ দুটো ভাষাতেই সমানভাবে পারদর্শী ‘নাজাহ্’। তার রয়েছে অসম্ভ মেধাশক্তি। এক কথা ‘গড-গিফটেড’। একটু আবেগি বটে। কিন্তু অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে কমতি নেই তার। বসে বসে দেখছিলাম পুরো ঘরটিকে ‘প্রাবন্তি’ সাজিয়েছে রঙতুলির এক অপরূপ ‘ক্যানভাসে’। চিত্রকর্মের প্রতি তার অফুরাণ ভালোবাসা আর ঝোঁক দেখে অভিভূত সবাই এবং আমি। বিশেষ করে আদরের কন্যার আবদার পূরণে কমতি নিয়ে তার বাবার।
ছোট্ট বেলায় পড়েছি/শুনেছি ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন’র কথা। স্কুলজীবন থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল যার। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ জয়নুলের নাম বাংলা-ভাষাভাষিরা ভুলতে পারবে না কোন দিন। এমনকি তার আঁকা দুর্ভিক্ষ নিয়ে ছবিটি সম্পর্কে জানে এবং চেনে না বর্তমান প্রজন্মের এমন কেউ নেই।
জয়নুল আবেদীন শিল্পকলায় অবদানের জন্য জীবদ্দশায় পেয়েছেন শিল্পাচার্য খেতাবসহ বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার জনকের উপাধিও। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন জয়নুল। যদিও তার আদি বাড়ি ময়মনসিংহের ‘ত্রিশাল থানার’ দরিরামপুর গ্রামে।
১৯৭৫ সালের পর থেকেই দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন জয়নুল আবেদীন। ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার মাত্র ছ’মাস মাথায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মারা যাওয়ার পর তার প্রতিষ্ঠিত চারুকলা অনুষদের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ এ ‘শিল্পাচার্যকে’।
আরেক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়্যুম চৌধুরী কথাও সবার জানা। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের অন্যতম রূপকার। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত আর্টস ইনস্টিটিউট, ঢাবির চারুকলার অসংখ্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ছিলেন-চিত্রশিল্পী কাইয়্যুম চৌধুরী। যিনি একাধারে ‘স্বাধীনতা ও একুশে’ পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য চিত্রশিল্পী। এছাড়া, তৎকালিন পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার’সহ শিল্পকলায় পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনীতে জন্মগ্রণ গুণী শিল্পী কাইয়্যুম চৌধুরী ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর চলে যান মৃত্যুযবনিকার ওপারে।
দু’জন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীর কথা বলার কারণ রয়েছে। ‘নাজাহ্ চৌধুরী প্রাবন্তির’ জন্ম আমেরিকাতে হলেও, যার বেড়ে উঠার বেশীরভাগ সময় এখন কাটছে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন’র জন্মভূমি ময়মনসিংহে। যদিও তার পিতৃভূমি লক্ষ্মীপুরের-রায়পুরে। সবশেষ ‘নাজাহ্’র চিত্রকর্ম আমি যখন দেখছিলাম। পুরোটা সময় অবাক-চোখে তাকিয়ে রইলাম‘। ফোনের ‘¯œ্যাপশর্টে’ পরখ করলাম তার আঁকা প্রকৃতির দৃশ্য। কি ‘অপরূপ’ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাতে রয়েছে একটি নদী ও চিরসবুজ ঘেরা একখন্ড বাংলার চিত্র। তখনই মনে পড়ে গেলো ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন’ আর ‘প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়্যুম চৌধুরী’র কথা। ভাবলাম হয়তো ‘জয়নুল’ জন্মভূমির ছোঁয়া লেগেছে ক্ষুদে এ বাংলাদেশ-আমেরিকান বালিকার মাঝে। একই সাথে পিতার জন্মভূমির জ্বীনগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার ভেতরে।
আমার বিশ্বাস বৃহত্তর নোয়াখালী-ফেনির ও ময়মনসিংহের দরিরামপুরের প্রকৃতির ছোঁয়ায় যে ভাবে বেড়ে উঠেছেন ‘জয়নুল-কাইয়্যুম’রা। অবদান রেখে গেছেন উপমহাদেশের শিল্পকলা/শিল্পকর্মে। ঠিক তেমনি, ‘নাজাহ্ চৌধুরী প্রাবন্তি’ও একদিন বিশ্ব মাতাবে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘লাল-সবুজ’র বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তুলবে বিশ্ব-দরবারে। বাংলাদেশের পাশাপাশি জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকলায় স্থান করবে তার আঁকা অনেক ‘চিত্রকর্ম’। যার মধ্যদিয়ে পিতার ‘ভালোবাসার-ক্যানভাসে’ আঁকা ‘কন্যার-রঙতুলি’ বেঁচে থাকবে যুগ-যুগ ধরে; প্রজন্মের থেকে প্রজন্মের মাঝে।
অনেক বড় হবে হবে ‘নাজাহ্ চৌধুরী প্রাবন্তি’; এমন প্রত্যাশা। (বাংলা পত্রিকা)