নিউইয়র্ক ১২:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নিউইয়র্কের নয় ওজনপার্ক যেন বাংলাদেশের

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৫৩:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ মার্চ ২০১৬
  • / ১০২৯ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: নিউইয়র্ক সিটির পাঁচ বরোর মধ্যে কুইন্স আর ব্রুকলীন বরোর বাংলাদেশী অধ্যুষিত অন্যতম এলাকা ওজনপার্ক। কুইন্স-ব্রুকলীনেরই একাংশ ওজনপার্ক যেটি সিটি লাইন হিসেবেও পরিচিত। এই ওজনপার্কে দিনে দিনে বাড়ছে বাংলাদেশীদের বসতি। সিটি লাইনের ১০১ এভিনিউ’র ক্রিসেন্ট স্ট্রীট থেকে ১০৪ স্ট্রীট ঘিরে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্য। তাছাড়া পিটকিন এভিনিউতেও রয়েছে বাংলাদেশীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সুবিশাল মসজিদ আল আমানসহ বাংলাদেশীদের উদ্যোগ আর প্রচষ্টায় প্রতিষ্ঠিত আল ফুরকান মসজিদ, আল মামুর জামে মসজিদ, রকমারী শতাধিক স্টোর, সোনালী এক্সচেঞ্জসহ প্লাসিড, স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস ইন্ক নামের মানি ট্রন্সমিটার প্রতিষ্ঠান। আল-আমীন গ্রোসারী ওজনপার্কের প্রথম বাংলাদেশী গ্রোসারী। ওজনপার্কবাসীদের ভাষায়, নিউইয়র্কের ওজনপার্ক এখন বাংলাদেশের ওজনপার্ক। কি নেই এই ওজনপার্কে। রয়েছে বাংলাদেশ বিয়ানীবাজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ ইন্ক’র ছাড়াও বাংলাদেশী আমেরিকান ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল অব নিউইয়র্ক (বিএডিসি) আর বাংলাদেশী-আমেরিকান কমিউনিটি ডেভলেপমেন্ট এন্ড ইয়্যুথ সার্ভিসেস (বাকডাইস) এর মতো মূলধারার সাথে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশী সংগঠন। এক কথায় স্বনির্ভরতায় বসবাস করছেন ওজনপার্কের প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তাছাড়া হাত বাড়ালেই রয়েছে জন এফ কেনেডী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ওজনপার্ক থেকে এই বিমানবন্দর গাড়ীতে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০/১৫ মিনিট।
উইকিপেডিয়ার তথ্য মতে ১৮৮২ সালে ওজনপার্কের নামকরণ। মূলত: কুইন্স কাউন্টির উডহ্যাভেন বুলেভার্ড, রিচমন্ড হিল, সাউথ ওজনপার্ক, হাওয়ার্ড বীচ আর সিটি লাইন এবং ব্রুকলীন বরোর আটলান্টিক এভিনিউ, সাউথ কন্ডুইট এভিনিউ আর ১০৮ ষ্ট্রীট এলাকাকেই উইকিপেডিয়া তথ্য দিয়েছে। আর জেএফকে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রকওয়ে বুলেভার্ড, রিচমন্ডহীল ঘিরেই সাউথ ওজনপার্ক ধরা হয়েছে। ২০১০ সালের হিসেব মতে ওজনপার্কের জনসংখ্যা ২১ হাজার ৩৭৬। এরমধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগ স্প্যানিশ, ৩০ দশমিক ৫ ভাগ সাদা, ১৯ দশমিক চার ভাগ এশিয়ান, পাঁচ দশমিক ছয় ভাগ কালো আর ৩ দশমিক চার ভাগ অন্যান্য বর্ণের মানুষের বসবাস। অপরদিকে ২০০০ সালের হিসেব মতে সাউথ ওজনপার্কের জনসংখ্যা হচ্ছে ৪৫ হাজার ৪৯৮ জন। এরমধ্যে শতকরা ৪৫ দশমিক ৭ ভাগ ভারতীয়, ২৫ দশমিক ছয় ভাগ কালো, ১২ দশমিক আট ভাগ এশিয়ান, ১২ দশমিক সাত ভাগ হিস্প্যানিক আর ৭ দশমিক আট ভাগ সাদা বর্ণের মানুষের বসবাস।
ওজনপার্কে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের বসবাস থাকলেও নাইনটিনথ সেঞ্চুরীর শেষের দিকে ফ্রেঞ্চ ইমিগ্রান্টরাই প্রথম এখানে বসবাস শুরু করেন। ওজনপার্ক গড়ে তুলেন জার্মান আর আইরিস ইমিগ্র্যান্টরা। এরপর জায়গা করে নেন ইতালিয়ান ইমিগ্রান্টরা। এই ইতালিয়ান ইমিগ্র্যান্টরা এক সময় এই এলাকার নামকরণ করেছিলো ‘দ্য লিটল ইতালী অব কুইন্স’। পরবর্তীতে পোলিশ ইমিগ্র্যান্টদের উল্লেখযোগ্য অংশ বসবাস শুরু করেন এই ওজনপার্কে। বাংলাদেশীসহ ল্যাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আমেরিকার (ইন্দো-গায়নিজ আর ইন্দো সুরিনামেস) ইমিগ্র্যান্টদের বসবাস শুরু টোইন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরীতে।
ওজনপার্কে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রসার, কল্যাণ, সামাজিক কর্মকান্ড, মানুষের আপদে-বিপদে যাদের সরব ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন: বাংলাদেশ সোসাইটি, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ও বিয়ানীবাজার সমিতির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকার সভাপতি বদরুল হোসেন খান, সাবেক সভাপতি আজমল হোসেন কুনু, বিয়ানীবাজার সমিতির সাবেক সভাপতি আজিমুর রহমান বুরহান, সাবেক সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, মাশুকুল ইসলাম খান ও বুরহান উদ্দিন কপিল, বর্তমান সভাপতি মাসুদুল হক সানু, সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি হাজী গৌছ খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিসবহ আহমেদ, মো: আনোয়ার হোসেন, এম এ হাকিম ও মো: ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার সহ হাজী নিজাম উদ্দিন, মুজাহিদুল ইসলাম, মকবুল রহিম চনুই, আ. শাকুর মাখন, আবুল কালাম, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ ইলিয়াস খসরু প্রমুখ।
অতি সম্প্রতি ওজনপার্ক/সাউথ ওজনপার্ক এলাকায় সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার লোকজনই প্রথম এই এলাকায় বসতি গড়ে তুলেন। অনেকের মতে ওজনপার্ক এলাকায় ৩/৪ হাজারের মতো বাংলাদেশী পরিবার রয়েছে। সেই হিসেবে জনসংখ্যার পরিমান দাঁড়াবে ২০/২৫ হাজার। বিগত ১০/১৫ বছরে ওজনপার্কে বাংলাদেশীদের বসবাস দ্রুত গতিতে বেড়েছে। এক হিসেবে জানা গেছে নিউইয়র্ক সিটিতে এশিয়ানদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সূত্র মতে, ২০০০ সালে যেখানে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিলো ১৯ হাজার ২০১০ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার। যদিও এই হিসেব কাগজ-কলমের। কেননা, প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে অনেকেই রেজিষ্টার্ড ভোটার নন, বা ভোটার হিসেবে রেজেষ্ট্রি করতে আগ্রহী নন। ধারণা করা হচ্ছে এই নিউইয়র্কেই তিন লক্ষাধীক বাংলাদেশীর বসবাস। সূত্র মতে, সিটি লাইনে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে শতকরা ৬৫ জনই সিলেটের বিয়ানীবাজারবাসী।
তবে ছোটখাটো ঘটনা থেকে শুরু করে মাঝে মধ্যেই ওজনপার্কের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন ঐক্যবদ্ধ ওজনপার্কবাসী বাংলাদেশী। বিশেষ করে এই এলাকায় মুসলিম বাংলাদেশীদের বসতি দেখে বেঙলী (বাংলাদেশী) আর নন বেঙলীদের মধ্যে হাতাহাতি-মারামারি নিয়মিত ঘটনা ছিলো। ছিনতাই, গোলাগুলী ঘটতো অহরহ।বিগত কয়েক বছর ধরে এমন ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। বলতে গেলে ওজনপার্ক এলাকায় বাংলাদেশী কমিউনিটি বৃদ্ধির ফলে এলাকায় ঐক্যও বেড়েছে। সহসী হয়েছেন বাংলাদেশীরা। ২০১২ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, এক লাখ লোকের মধ্যে নিউইয়র্ক সিটিতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটেছে ৫২ হাজার ৯৯৩টি। এরমধ্যে ওজনপার্কেই ঘটেছে ৬৩৯টি অপরাধ। এছাড়া সিটির ৪১৯টি খুনের মধ্যে ৫টি খুন ওজনপার্কে, এক হাজার ১৬২টি ধর্ষনের ঘটনার মধ্যে ১৪টি ওজনপার্কে, ২০ হাজার ২০১টি ছিনতাই ঘটনার মধ্যে ২৪৪টি ওজনপার্কে, ৩১ হাজার ২১১টি উত্যক্তের ঘটনায় ৩৭৭টি ওজনপার্কে, এক লাখ ৪২ হাজার ৭৬০টি সম্পত্তি বিষয়ক অপরাধের মধ্যে এক হাজার ৭২২টি ওজনপার্কে এবং ১৮ হাজার ৬৩৫টি চুরির ঘটনার মধ্যে ২২৫টি চুরির ঘটনা ঘটেছে ওজনপার্ক এলাকায়।
Mzanur Rahman Wayওজনপার্কবাসী একজন বাংলাদেশী বললেন, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ভয়-ভীতি পেরিয়ে আমরা বাংলাদেশীরা ওজনপার্কে কমিউনিটির অবস্থান সুদৃঢ় করেছি। সূত্র মতে, ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফটো সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজান অঅর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি নজমুল ইসলামসহ অন্তত ১০জন বাংলাদেশী হত্যার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক মিজান হত্যার শিকার হন ২০০২ সালের ১১ আগষ্ট। সেই সময় একটি বাইসাইকেল নিয়ে বাংলাদেশী আর ল্যাতিনো উঠতি যুবকদের মধ্যে কথা কাটাকাটির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটে। ল্যাতিনো যুবকরা কোথাও বাংলাদেশীদের দেখলেই মারার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সাংবাদিক মিজান কাজ থেকে ওজনপার্কস্থ বাসায় ফেরার পথে লিবার্টি এভিনিউ ও ফরবেল ষ্ট্রীটের কর্ণারে উত্তেজিত যুবকদের কবলে পড়েন এবং তাদের হামলায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মিজান হত্যার ঘটনায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ আর ন্যায় বিচার দাবী করেন। মূলধারার জনপ্রতিনিধিরাও বাংলাদেশীদের দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সাংবাদিক মিজান হত্যার বিচার হয় এবং স্থানীয় কাউন্সিলম্যানের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ফরবেল স্ট্রীটের নাম ‘মিজানুর রহমান ওয়ে’ করা হয়। মিজান হত্যার বিচার দাবীর আন্দোলনে বিয়ানীবাজার সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ’র ভূমিকা ছিলো উল্লেখ করার মতো। সমিতির তৎকালীন সভাপতি বুরহান উদ্দিন কপিলের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা নজমুল ইসলামও দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন ২০১৪ সালে।
ওজনপার্ক/সাউথ ওজনপার্ক এলাকার বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী-আমেরিকান এখন মূলধারার রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্থানীয় ইউএস কংগ্রেসম্যান, ষ্টেট অ্যাসেম্বলীম্যান, সিটি কাউন্সিলম্যানদের কাছে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বেশ জনপ্রিয়। একাধিক বাংলাদেশী এখন সিটির বোর্ড মেম্বার। স্কুল শিক্ষক বাংলাদেশী-আমেরিকান হেলাল শেখ গত নির্বাচনে সিটি কাউন্সিলম্যান প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। এর আগের নির্বাচনেও হেলাল শেখ একই পদে প্রার্থী ছিলেন। আগামী নির্বাচনে হেলাল শেখের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তাকে (হেলাল শেখ) মূলধারার স্থানীয় মিডিয়ায় একজন ‘রাইজিং স্টার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর হেলাল শেখ নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন প্রথম বাংলাদেশী-আমেরিকান সিটি কাউন্সিলম্যান।
১৯৮২ সাল থেকে আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী-আমেরিকান কমিউনিটি ডেভলেপমেন্ট এন্ড ইয়্যুথ সার্ভিসেস (বাকডাইস)-এর সভাপতি বাংলাদেশী-আমেরিকান মিসবা আবদীন বলেন, সিটি লাইনে তার বাবাই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বসবাস এবং ব্যবসা শুরু করেন। স্থানীয় ফরবেল স্ট্রীটে (বর্তমানে এই ষ্ট্রীটের নাম মিজানুর রহমান ওয়ে) ক্রয় করেন নিজস্ব বাড়ী। এক এক করে এখন তাদের পরিবারের সবাই আমেরিকাবাসী। ওজনপার্কে তাদের রয়েছে একাধিক ব্যবসা-বাণিজ্য।
ওজনপার্কের বাসিন্দা ফয়জুর রহমান বলেন, ৬/৭ বছর ধরে তিনি ওজনপার্ক এলাকায় আছেন। এখানে থাকা-খাওয়ায় তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ঘর থেকে বেরুলেই মসজিদ, বাংলাদেশী দোকানপাট। সবকিছুই হাতের নাগালের মধ্যে। বললেন, ভালোই লাগছে।
সারোয়ার আহমেদ নামের এক প্রবাসী বলেন, ৭ বছর ধরে তিনি নিউইয়র্ক প্রবাসী। দেশের বাড়ী বিয়ানীবাজার। এখানে তার ভালোই লাগছে। দেশের মানুষদের পেয়ে তার মনেই হয় না, তিনি আমেরিকায় আছেন। তার মতে, ওজনপার্কের পরিবেশ সুন্দর, দেশের মতো।
নেইবরহুড ভেরাইটি স্টোরের স্বত্তাধিকারী মাহমুদ হোসেন বাবুল বলেন, দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে তিনি আমেরিকাবাসী। সিলেটের বিয়ানীবাজারের সন্তান আমেরিকা আসার পর ১৭ বছর কাটিয়েছেন নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায়। এখন স্থায়ীবাস ওজনপার্কে। মা, ৫ ভাই আর ২ বোনসহ তার পরিবারের সবাই এখন ওজনপার্কের বাসিন্দা। তিনি বলেন, সবাই মিলে-মিশে একই এলাকায় বসবাসের ফলে মনে হচ্ছে নিউইয়র্কের ওজনপার্কে নয়, সিলেটের বিয়ানীবাজারেই বাস করছি। প্রবাসে থেকেও যেন দেশে আছি। তিনি বলেন, ওজনপার্কে বিয়ানীবাজার উপজেলার অধিকাংশ মানুষ বাস করায় এখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী পরিবেশ। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় একে অপরের সাথে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মা, চাচাী, খালা, ফুফু, বোনেরা দেশের পরিবেশে বসবাস করায় তারাও শালিনতার মধ্যদিয়ে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলেছেন। আবার বিয়ানীবাজার সমিতি ভবন এখানেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অনেক সামাজিক কর্মকান্ডও হচ্ছে। তিনি বলেন, সমিতির সভাপতি আজিমুর রহমান বুহানের নেতৃত্বে বিয়ারীবাজার সমিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো এবং সুন্দর চলছে। তিনি বলেন, আগে কালো, স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান বখাটেদের উৎপাতে আমাদেরকে অনেক হয়রানী-নির্যাতনের শিকার হেেত হয়েছে। ফটো সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজান নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু আগের মতো পরিবেশ ওজনপার্কে এখন আর নেই।
Shajalal Supar Market & Halal Meatওজনপার্কের শাহজালাল সুপার মার্কের অন্যতম স্বত্তাধিকারী মো: দেলোয়ার হোসেন। আমেরিকায় বসবাস ২২ বছর ধরে। আমেরিকায় আসার পর ৪ বছর রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন। পরবর্তীর্তে সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার। তিনি বলেন, আমরা ওজনপার্কের বাংলাদেশীরা ভালোই আছি, শান্তিতে আছি। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, ২০০০ সালে ফটো সাংবাদিক মিজানুর রহমান হত্যার ঘটনাটি খুবই দু:খজনক এবং ১৯৭৭ অহাদ নামে আরো একজন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো পরিবেশ ওজনপার্কে নেই। বলতে গেলে ওজনপার্ক বাংলাদেশীদের দখলে।
ওজনপার্কবাসী বাংলাদেশী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ থেকে কেউ আমেরিকা আসলে প্রথমে সে তার নেইবার (বাংলাদেশী কমিউনিটি) খোঁজে। তারপর খোঁজে মসজিদ কোথায়। তিনি বলেন, আমি আমেরিকা আসার পর প্রথমে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে ছিলাম ৮ বছর। পরবর্তীতে ওজনপার্কে বাংলাদেশীদের বসতি, মসজিদ, ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠলে সিটি লাইন এলাকায় বসতি গড়ে তুলি। তিনি আরো বলেন, মূলত: আমার সন্তানদের মাঝে বাংলাদেশী শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টির পরশ ধরে রাখতেই ওজনপার্কে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেই। তার ভাষায়, ওজনপার্কে বাস করা মানে বাংলাদেশেই বাস করা।
জহুর উদ্দিন জানান, ২/৩ বছর ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এবং ওজনপার্কে বসবাস করছেন। তার অভিজ্ঞতায় তিনি মনে করেন, ওজনপার্কে বাংলাদেশী কমিউনিটি বেড়ে উঠায়, প্রবাসীদের মধ্যে ঐক্য, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে। একজনের আপদ-বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসছেন। বসবাসের জন্য ওজনপার্কে সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে।
সবুজ নামের এক কিশোর বলেন, ৬/৭ বছর ধরে তিনি আমেরিকা এসেছেন। কমিউনিটির প্রায় সকল সভা-সমাবেশ আর খেলার মাঠে তার উপস্থিতি লক্ষনীয়। তার ভাষায়- সে নিউইয়র্ক নয়, যেন বিয়ানীবাজারে বসবাস করছেন। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

নিউইয়র্কের নয় ওজনপার্ক যেন বাংলাদেশের

প্রকাশের সময় : ০৭:৫৩:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ মার্চ ২০১৬

নিউইয়র্ক: নিউইয়র্ক সিটির পাঁচ বরোর মধ্যে কুইন্স আর ব্রুকলীন বরোর বাংলাদেশী অধ্যুষিত অন্যতম এলাকা ওজনপার্ক। কুইন্স-ব্রুকলীনেরই একাংশ ওজনপার্ক যেটি সিটি লাইন হিসেবেও পরিচিত। এই ওজনপার্কে দিনে দিনে বাড়ছে বাংলাদেশীদের বসতি। সিটি লাইনের ১০১ এভিনিউ’র ক্রিসেন্ট স্ট্রীট থেকে ১০৪ স্ট্রীট ঘিরে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্য। তাছাড়া পিটকিন এভিনিউতেও রয়েছে বাংলাদেশীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সুবিশাল মসজিদ আল আমানসহ বাংলাদেশীদের উদ্যোগ আর প্রচষ্টায় প্রতিষ্ঠিত আল ফুরকান মসজিদ, আল মামুর জামে মসজিদ, রকমারী শতাধিক স্টোর, সোনালী এক্সচেঞ্জসহ প্লাসিড, স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস ইন্ক নামের মানি ট্রন্সমিটার প্রতিষ্ঠান। আল-আমীন গ্রোসারী ওজনপার্কের প্রথম বাংলাদেশী গ্রোসারী। ওজনপার্কবাসীদের ভাষায়, নিউইয়র্কের ওজনপার্ক এখন বাংলাদেশের ওজনপার্ক। কি নেই এই ওজনপার্কে। রয়েছে বাংলাদেশ বিয়ানীবাজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ ইন্ক’র ছাড়াও বাংলাদেশী আমেরিকান ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল অব নিউইয়র্ক (বিএডিসি) আর বাংলাদেশী-আমেরিকান কমিউনিটি ডেভলেপমেন্ট এন্ড ইয়্যুথ সার্ভিসেস (বাকডাইস) এর মতো মূলধারার সাথে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশী সংগঠন। এক কথায় স্বনির্ভরতায় বসবাস করছেন ওজনপার্কের প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তাছাড়া হাত বাড়ালেই রয়েছে জন এফ কেনেডী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ওজনপার্ক থেকে এই বিমানবন্দর গাড়ীতে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০/১৫ মিনিট।
উইকিপেডিয়ার তথ্য মতে ১৮৮২ সালে ওজনপার্কের নামকরণ। মূলত: কুইন্স কাউন্টির উডহ্যাভেন বুলেভার্ড, রিচমন্ড হিল, সাউথ ওজনপার্ক, হাওয়ার্ড বীচ আর সিটি লাইন এবং ব্রুকলীন বরোর আটলান্টিক এভিনিউ, সাউথ কন্ডুইট এভিনিউ আর ১০৮ ষ্ট্রীট এলাকাকেই উইকিপেডিয়া তথ্য দিয়েছে। আর জেএফকে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রকওয়ে বুলেভার্ড, রিচমন্ডহীল ঘিরেই সাউথ ওজনপার্ক ধরা হয়েছে। ২০১০ সালের হিসেব মতে ওজনপার্কের জনসংখ্যা ২১ হাজার ৩৭৬। এরমধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগ স্প্যানিশ, ৩০ দশমিক ৫ ভাগ সাদা, ১৯ দশমিক চার ভাগ এশিয়ান, পাঁচ দশমিক ছয় ভাগ কালো আর ৩ দশমিক চার ভাগ অন্যান্য বর্ণের মানুষের বসবাস। অপরদিকে ২০০০ সালের হিসেব মতে সাউথ ওজনপার্কের জনসংখ্যা হচ্ছে ৪৫ হাজার ৪৯৮ জন। এরমধ্যে শতকরা ৪৫ দশমিক ৭ ভাগ ভারতীয়, ২৫ দশমিক ছয় ভাগ কালো, ১২ দশমিক আট ভাগ এশিয়ান, ১২ দশমিক সাত ভাগ হিস্প্যানিক আর ৭ দশমিক আট ভাগ সাদা বর্ণের মানুষের বসবাস।
ওজনপার্কে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের বসবাস থাকলেও নাইনটিনথ সেঞ্চুরীর শেষের দিকে ফ্রেঞ্চ ইমিগ্রান্টরাই প্রথম এখানে বসবাস শুরু করেন। ওজনপার্ক গড়ে তুলেন জার্মান আর আইরিস ইমিগ্র্যান্টরা। এরপর জায়গা করে নেন ইতালিয়ান ইমিগ্রান্টরা। এই ইতালিয়ান ইমিগ্র্যান্টরা এক সময় এই এলাকার নামকরণ করেছিলো ‘দ্য লিটল ইতালী অব কুইন্স’। পরবর্তীতে পোলিশ ইমিগ্র্যান্টদের উল্লেখযোগ্য অংশ বসবাস শুরু করেন এই ওজনপার্কে। বাংলাদেশীসহ ল্যাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আমেরিকার (ইন্দো-গায়নিজ আর ইন্দো সুরিনামেস) ইমিগ্র্যান্টদের বসবাস শুরু টোইন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরীতে।
ওজনপার্কে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রসার, কল্যাণ, সামাজিক কর্মকান্ড, মানুষের আপদে-বিপদে যাদের সরব ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন: বাংলাদেশ সোসাইটি, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ও বিয়ানীবাজার সমিতির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকার সভাপতি বদরুল হোসেন খান, সাবেক সভাপতি আজমল হোসেন কুনু, বিয়ানীবাজার সমিতির সাবেক সভাপতি আজিমুর রহমান বুরহান, সাবেক সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, মাশুকুল ইসলাম খান ও বুরহান উদ্দিন কপিল, বর্তমান সভাপতি মাসুদুল হক সানু, সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি হাজী গৌছ খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিসবহ আহমেদ, মো: আনোয়ার হোসেন, এম এ হাকিম ও মো: ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার সহ হাজী নিজাম উদ্দিন, মুজাহিদুল ইসলাম, মকবুল রহিম চনুই, আ. শাকুর মাখন, আবুল কালাম, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ ইলিয়াস খসরু প্রমুখ।
অতি সম্প্রতি ওজনপার্ক/সাউথ ওজনপার্ক এলাকায় সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার লোকজনই প্রথম এই এলাকায় বসতি গড়ে তুলেন। অনেকের মতে ওজনপার্ক এলাকায় ৩/৪ হাজারের মতো বাংলাদেশী পরিবার রয়েছে। সেই হিসেবে জনসংখ্যার পরিমান দাঁড়াবে ২০/২৫ হাজার। বিগত ১০/১৫ বছরে ওজনপার্কে বাংলাদেশীদের বসবাস দ্রুত গতিতে বেড়েছে। এক হিসেবে জানা গেছে নিউইয়র্ক সিটিতে এশিয়ানদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সূত্র মতে, ২০০০ সালে যেখানে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিলো ১৯ হাজার ২০১০ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার। যদিও এই হিসেব কাগজ-কলমের। কেননা, প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে অনেকেই রেজিষ্টার্ড ভোটার নন, বা ভোটার হিসেবে রেজেষ্ট্রি করতে আগ্রহী নন। ধারণা করা হচ্ছে এই নিউইয়র্কেই তিন লক্ষাধীক বাংলাদেশীর বসবাস। সূত্র মতে, সিটি লাইনে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে শতকরা ৬৫ জনই সিলেটের বিয়ানীবাজারবাসী।
তবে ছোটখাটো ঘটনা থেকে শুরু করে মাঝে মধ্যেই ওজনপার্কের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন ঐক্যবদ্ধ ওজনপার্কবাসী বাংলাদেশী। বিশেষ করে এই এলাকায় মুসলিম বাংলাদেশীদের বসতি দেখে বেঙলী (বাংলাদেশী) আর নন বেঙলীদের মধ্যে হাতাহাতি-মারামারি নিয়মিত ঘটনা ছিলো। ছিনতাই, গোলাগুলী ঘটতো অহরহ।বিগত কয়েক বছর ধরে এমন ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। বলতে গেলে ওজনপার্ক এলাকায় বাংলাদেশী কমিউনিটি বৃদ্ধির ফলে এলাকায় ঐক্যও বেড়েছে। সহসী হয়েছেন বাংলাদেশীরা। ২০১২ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, এক লাখ লোকের মধ্যে নিউইয়র্ক সিটিতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটেছে ৫২ হাজার ৯৯৩টি। এরমধ্যে ওজনপার্কেই ঘটেছে ৬৩৯টি অপরাধ। এছাড়া সিটির ৪১৯টি খুনের মধ্যে ৫টি খুন ওজনপার্কে, এক হাজার ১৬২টি ধর্ষনের ঘটনার মধ্যে ১৪টি ওজনপার্কে, ২০ হাজার ২০১টি ছিনতাই ঘটনার মধ্যে ২৪৪টি ওজনপার্কে, ৩১ হাজার ২১১টি উত্যক্তের ঘটনায় ৩৭৭টি ওজনপার্কে, এক লাখ ৪২ হাজার ৭৬০টি সম্পত্তি বিষয়ক অপরাধের মধ্যে এক হাজার ৭২২টি ওজনপার্কে এবং ১৮ হাজার ৬৩৫টি চুরির ঘটনার মধ্যে ২২৫টি চুরির ঘটনা ঘটেছে ওজনপার্ক এলাকায়।
Mzanur Rahman Wayওজনপার্কবাসী একজন বাংলাদেশী বললেন, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ভয়-ভীতি পেরিয়ে আমরা বাংলাদেশীরা ওজনপার্কে কমিউনিটির অবস্থান সুদৃঢ় করেছি। সূত্র মতে, ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফটো সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজান অঅর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি নজমুল ইসলামসহ অন্তত ১০জন বাংলাদেশী হত্যার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক মিজান হত্যার শিকার হন ২০০২ সালের ১১ আগষ্ট। সেই সময় একটি বাইসাইকেল নিয়ে বাংলাদেশী আর ল্যাতিনো উঠতি যুবকদের মধ্যে কথা কাটাকাটির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটে। ল্যাতিনো যুবকরা কোথাও বাংলাদেশীদের দেখলেই মারার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সাংবাদিক মিজান কাজ থেকে ওজনপার্কস্থ বাসায় ফেরার পথে লিবার্টি এভিনিউ ও ফরবেল ষ্ট্রীটের কর্ণারে উত্তেজিত যুবকদের কবলে পড়েন এবং তাদের হামলায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মিজান হত্যার ঘটনায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ আর ন্যায় বিচার দাবী করেন। মূলধারার জনপ্রতিনিধিরাও বাংলাদেশীদের দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সাংবাদিক মিজান হত্যার বিচার হয় এবং স্থানীয় কাউন্সিলম্যানের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ফরবেল স্ট্রীটের নাম ‘মিজানুর রহমান ওয়ে’ করা হয়। মিজান হত্যার বিচার দাবীর আন্দোলনে বিয়ানীবাজার সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ’র ভূমিকা ছিলো উল্লেখ করার মতো। সমিতির তৎকালীন সভাপতি বুরহান উদ্দিন কপিলের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা নজমুল ইসলামও দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন ২০১৪ সালে।
ওজনপার্ক/সাউথ ওজনপার্ক এলাকার বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী-আমেরিকান এখন মূলধারার রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্থানীয় ইউএস কংগ্রেসম্যান, ষ্টেট অ্যাসেম্বলীম্যান, সিটি কাউন্সিলম্যানদের কাছে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বেশ জনপ্রিয়। একাধিক বাংলাদেশী এখন সিটির বোর্ড মেম্বার। স্কুল শিক্ষক বাংলাদেশী-আমেরিকান হেলাল শেখ গত নির্বাচনে সিটি কাউন্সিলম্যান প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। এর আগের নির্বাচনেও হেলাল শেখ একই পদে প্রার্থী ছিলেন। আগামী নির্বাচনে হেলাল শেখের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তাকে (হেলাল শেখ) মূলধারার স্থানীয় মিডিয়ায় একজন ‘রাইজিং স্টার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর হেলাল শেখ নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন প্রথম বাংলাদেশী-আমেরিকান সিটি কাউন্সিলম্যান।
১৯৮২ সাল থেকে আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী-আমেরিকান কমিউনিটি ডেভলেপমেন্ট এন্ড ইয়্যুথ সার্ভিসেস (বাকডাইস)-এর সভাপতি বাংলাদেশী-আমেরিকান মিসবা আবদীন বলেন, সিটি লাইনে তার বাবাই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বসবাস এবং ব্যবসা শুরু করেন। স্থানীয় ফরবেল স্ট্রীটে (বর্তমানে এই ষ্ট্রীটের নাম মিজানুর রহমান ওয়ে) ক্রয় করেন নিজস্ব বাড়ী। এক এক করে এখন তাদের পরিবারের সবাই আমেরিকাবাসী। ওজনপার্কে তাদের রয়েছে একাধিক ব্যবসা-বাণিজ্য।
ওজনপার্কের বাসিন্দা ফয়জুর রহমান বলেন, ৬/৭ বছর ধরে তিনি ওজনপার্ক এলাকায় আছেন। এখানে থাকা-খাওয়ায় তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ঘর থেকে বেরুলেই মসজিদ, বাংলাদেশী দোকানপাট। সবকিছুই হাতের নাগালের মধ্যে। বললেন, ভালোই লাগছে।
সারোয়ার আহমেদ নামের এক প্রবাসী বলেন, ৭ বছর ধরে তিনি নিউইয়র্ক প্রবাসী। দেশের বাড়ী বিয়ানীবাজার। এখানে তার ভালোই লাগছে। দেশের মানুষদের পেয়ে তার মনেই হয় না, তিনি আমেরিকায় আছেন। তার মতে, ওজনপার্কের পরিবেশ সুন্দর, দেশের মতো।
নেইবরহুড ভেরাইটি স্টোরের স্বত্তাধিকারী মাহমুদ হোসেন বাবুল বলেন, দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে তিনি আমেরিকাবাসী। সিলেটের বিয়ানীবাজারের সন্তান আমেরিকা আসার পর ১৭ বছর কাটিয়েছেন নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায়। এখন স্থায়ীবাস ওজনপার্কে। মা, ৫ ভাই আর ২ বোনসহ তার পরিবারের সবাই এখন ওজনপার্কের বাসিন্দা। তিনি বলেন, সবাই মিলে-মিশে একই এলাকায় বসবাসের ফলে মনে হচ্ছে নিউইয়র্কের ওজনপার্কে নয়, সিলেটের বিয়ানীবাজারেই বাস করছি। প্রবাসে থেকেও যেন দেশে আছি। তিনি বলেন, ওজনপার্কে বিয়ানীবাজার উপজেলার অধিকাংশ মানুষ বাস করায় এখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী পরিবেশ। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় একে অপরের সাথে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মা, চাচাী, খালা, ফুফু, বোনেরা দেশের পরিবেশে বসবাস করায় তারাও শালিনতার মধ্যদিয়ে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলেছেন। আবার বিয়ানীবাজার সমিতি ভবন এখানেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অনেক সামাজিক কর্মকান্ডও হচ্ছে। তিনি বলেন, সমিতির সভাপতি আজিমুর রহমান বুহানের নেতৃত্বে বিয়ারীবাজার সমিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো এবং সুন্দর চলছে। তিনি বলেন, আগে কালো, স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান বখাটেদের উৎপাতে আমাদেরকে অনেক হয়রানী-নির্যাতনের শিকার হেেত হয়েছে। ফটো সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজান নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু আগের মতো পরিবেশ ওজনপার্কে এখন আর নেই।
Shajalal Supar Market & Halal Meatওজনপার্কের শাহজালাল সুপার মার্কের অন্যতম স্বত্তাধিকারী মো: দেলোয়ার হোসেন। আমেরিকায় বসবাস ২২ বছর ধরে। আমেরিকায় আসার পর ৪ বছর রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন। পরবর্তীর্তে সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার। তিনি বলেন, আমরা ওজনপার্কের বাংলাদেশীরা ভালোই আছি, শান্তিতে আছি। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, ২০০০ সালে ফটো সাংবাদিক মিজানুর রহমান হত্যার ঘটনাটি খুবই দু:খজনক এবং ১৯৭৭ অহাদ নামে আরো একজন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো পরিবেশ ওজনপার্কে নেই। বলতে গেলে ওজনপার্ক বাংলাদেশীদের দখলে।
ওজনপার্কবাসী বাংলাদেশী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ থেকে কেউ আমেরিকা আসলে প্রথমে সে তার নেইবার (বাংলাদেশী কমিউনিটি) খোঁজে। তারপর খোঁজে মসজিদ কোথায়। তিনি বলেন, আমি আমেরিকা আসার পর প্রথমে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে ছিলাম ৮ বছর। পরবর্তীতে ওজনপার্কে বাংলাদেশীদের বসতি, মসজিদ, ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠলে সিটি লাইন এলাকায় বসতি গড়ে তুলি। তিনি আরো বলেন, মূলত: আমার সন্তানদের মাঝে বাংলাদেশী শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টির পরশ ধরে রাখতেই ওজনপার্কে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেই। তার ভাষায়, ওজনপার্কে বাস করা মানে বাংলাদেশেই বাস করা।
জহুর উদ্দিন জানান, ২/৩ বছর ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এবং ওজনপার্কে বসবাস করছেন। তার অভিজ্ঞতায় তিনি মনে করেন, ওজনপার্কে বাংলাদেশী কমিউনিটি বেড়ে উঠায়, প্রবাসীদের মধ্যে ঐক্য, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে। একজনের আপদ-বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসছেন। বসবাসের জন্য ওজনপার্কে সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে।
সবুজ নামের এক কিশোর বলেন, ৬/৭ বছর ধরে তিনি আমেরিকা এসেছেন। কমিউনিটির প্রায় সকল সভা-সমাবেশ আর খেলার মাঠে তার উপস্থিতি লক্ষনীয়। তার ভাষায়- সে নিউইয়র্ক নয়, যেন বিয়ানীবাজারে বসবাস করছেন। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)