নিউইয়র্কের ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল কবর স্থানে দাফন
- প্রকাশের সময় : ০৭:০১:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই ২০১৮
- / ৬১৫ বার পঠিত
নিউইয়র্ক (ইউএনএ): বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। গত ১৫ জুলাই রোববার রাত ১টা ৪০ মিনিটে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে কন্যার বাড়িতে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এসময় পরিবারের সদস্যরা তার পাশে ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র ও তিন কন্যা সহ বহু আতœীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্খী রেখে গেছেন। মরহুমার স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। সমাজ ও মানুষের সেবায় তাঁরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করেছেন আজীবন। দীর্ঘদিন ধরে লং আইল্যান্ডস্থ কন্যা রাহাত হোসেন নাজু আর কন্যা জামাতা সাঈদ জাকি হোসেনের বাসায় বসবাস করছিলেন।
জানা গেছে, অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ একজন অগ্রণী বিদুষী নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে যাঁর অবদান সুবিদিত। বাংলাদেশের সিলেটের নারীশিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে ১৯৫০ সালের দিকে কাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে সিলেট মহিলা কলেজ ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। দীর্ঘ ৩২ বছর তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠকে এগিয়ে নিতে মেধা, শ্রম দিয়ে কাজ করেছেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ওই অঞ্চলে তথা সমগ্র নারী প্রগতিতে ধারাবাহিক অবদান রেখে চলেছে। খবর ইউএনএ’র।
অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ তাৎক্ষণিক শোক জানান। অনেকেই তাঁদের শোকবার্তায় মরহুমাকে ‘রতœগর্ভা মা’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং একজন সমাজসেবী বিশেষ করে নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন বলে জানান। তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর সন্তানদেরও দেশ ও দশের কাজে নিজেদের উৎসর্গ করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
নামাজে জানাজা: এদিকে অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদের নামাজে জানাজা সোমবার (১৬ জুলাই) বাদ এশা (রাত সোয়া ১০টা) জামাইকা মুসলিম সেন্টারে (জেএমসি) অনুষ্ঠিত হয়। মরহুমার নামাজে জানাজায় বিভিন্ন মিডিয়ার সম্পাদক ও সাংবাদিক ছাড়াও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ সহ সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশীরা অংশ নেন। নিউইয়র্কের পাঁচ বরো ছাড়াও টাইষ্টেট এলাকা বিশেষ করে কানেকটিকাট, নিউজার্সী, পেনসেলভেনিয়া প্রভৃতি অঙ্গরাজ্য থেকেও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী নর-নারী জানাজায় যোগ দেন। জানাজা নামাজে ইমামতি করেন লং আইল্যান্ড মুসলিম সোসাইটি (লিমস) পরিচালিত মসজিদের ইমাম আহমেদ করীম উল্লাহ। মরহুমার নামাজে জানাজার আগে জেএমসি-তে উপস্থিত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জেএমসি পরিচালনা কমিটির সভাপতি ডা. মোহাম্মদ রহমান, লিমস-এর সভাপতি রফিকুর রহমান, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসের ভাইস কনসাল মোহাম্মদ আসিফ ও মরহুমার পুত্র অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। এই পর্ব পরিচালনা এবং জেএমসি’র পক্স থেকে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন জেএমসি’র সেক্রেটারী মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
দাফন: মহুমা হুসনে আরা আহমেদ-এর মরদেহ মঙ্গলবার (১৭ জুলাই) বেলা দেড়টার দিকে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডস্থ ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল কবরস্থানে দাফন করা হয়। এসময় তার পরিবারের সদস্য ও আত্বীয়-স্বজন এবং কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ সহ দেড় শতাধিক মুসল্লী উপস্থিত ছিলেন।
শোক প্রকাশ: অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ-এর ইন্তেকালে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ক্লাবের সভাপতি ডা. ওয়াজেদ এ খান ও সাধারণ সম্পাদক শিবলী চৌধুরী কায়েস গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে মরহুমার বিদেহী আতœার শান্তি কামনা করেছেন।
এছাড়াও অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ-এর ইন্তেকালে শোক ও সমবেদনা প্রকাশকারী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রয়েছেন- বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক’র সাবেক সভাপতি ডা. ওয়াদুদ ভুইয়া, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা’র সম্পাদক ও টাইম টেলিভিশন-এর সিইও আবু তাহের, সাপ্তাহিক ঠিকানা’র সাবেক সম্পাদক সাঈদ-উর রব, প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, সাপ্তাহিক বাঙালী সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, প্রথম আলো’র উত্তর আমেরিকা বুরো প্রধান ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী, বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন খান, জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা’র সভাপতি বদরুল হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চৌধুরী, লেখক-কলামিস্ট মাহমুদ রেজা চৌধুরী, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন-এর পক্ষে বিশ্বজিত সাহা প্রমুখ।
অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী: সিলেটের সন্তান হুসনে আরা আহমেদ পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকজুড়ে সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক-সাংগঠনিক উদ্যোগের আয়োজন ও নেতৃত্বদানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সিলেট অঞ্চলে নারী শিক্ষার অগ্রণী নেত্রী ও একজন বিদূষী ব্যক্তিত্ব। বৃহত্তর সিলেটের প্রথম মুসলিম নারী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে তিনি বাংলায় এম এ পাশ করে মেধার পরিচয় দেন। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট জেলার একমাত্র মেয়েদের কলেজ ‘সিলেট মহিলা কলেজ’ পাকিস্তান হবার পরে ১৯৫০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। আবার বেসরকারী ভাবে সেটাকে চালু করা হলে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে সুচনাকালীন ক্ষুদ্র অবয়ব থেকে সেটাকে ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। পরে কলেজটি সরকারী করণ হলে এর নাম হয় ‘সিলেট সরকারী মহিলা কলেজ’। দীর্ঘ বত্রিশ বছর ধরে এই বিদ্যাপীঠের অগ্রগমনে তিনি তাঁর মেধা, শ্রম এবং স্বপ্ন বিনিয়োগ করেছেন। ফলে সিলেট ‘সরকারি মহিলা কলেজ’ ঐ অঞ্চল তথা সমগ্র জাতির নারী-প্রগতিতে ধারাবহিক অবদান রেখে চলেছে। বিদ্যায়তনিক শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নের পাশাপাশি নীতিবোধ ও মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধনে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনি একাধারে কুমিল্লা বোর্ডের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মহিলা সিনেট সদস্য এবং ঢাকায় জাতীয় শিক্ষা পরিবেশ পরিষদের সদস্য। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় এবং সাহসী ভূমিকা রেখে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। তিনি সিলেটের নারীসমাজকে নারী নেতৃত্বের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় সিলেটে নারীদের সমন্বয় করা থেকে শুরু করে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশক জুড়ে সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক-সাংগঠনিক উদ্যোগের আয়োজন ও নেতৃত্ব প্রদানে তিনি রেখেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। উল্লেখ্য তাঁর স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সিলেট মেডিকেল কলেজের সার্জারীর প্রধান শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। নারী শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নকাজে তার চিকিৎসক স্বামীর ছিল সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগ। সমাজ ও মানুষের সেবায় তাঁরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করে গেছেন আজীবন। ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অনুপ্রেরণায় তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ‘হুসনে আরা ফাউন্ডশন’ বিভিন্নভাবে সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে সদ্য সমাপ্ত নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় তাঁকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।