এ্যাপস ভিত্তিক গাড়ির রেজিস্টেশন আগামী এক বছর বন্ধ ॥ ক্যাবীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া : সিটিতে পার্কিং মিটার রেট ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২ থেকে ৪ ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত

- প্রকাশের সময় : ০১:৩৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অগাস্ট ২০১৮
- / ৮২৪ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পাশ হলো নিউইয়র্ক সিটি ট্যাক্সি ক্যাবি আইন। গত ৮ আগষ্ট বুধবার সিটি হলে উত্থাপিত প্রস্তাবিত ‘ফর-হায়ার ভিকেলস-এফএইচভি-২০১৮’ আইনটি পাশে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে মত দেন বেশীরভাগ জনপ্রতিনিধি। আইনটি পাশের ফলে, সিটিতে আগামী ১ বছর কোন ‘টিএলসি নাম্বার রেজিস্ট্রেশন ও প্লেট’ বরাদ্দ দেয়া হবে না। সেই সাথে কোন অ্যাপস-ভিত্তিক কোম্পানী ক্যাবিদের নাম নিবন্ধন করতে পারবে না বলেও আইনটি বলা হয়েছে। এর ফলে সিটির প্রায় ১ লাখ চালক লাভবান হবে বলে দাবি মেয়র ব্লাজিও’র। আইনটি পাশে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা ক্যাবীরা। দাবি জানিয়েছেন, বৈষম্য দূরিকরণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের। সিটির এই নতুন সিদ্ধান্তে ক্যাবীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সিটির নতুন সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ ভালো হয়েছে বলে আখ্যায়িত করেছেন, আবার কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেক ক্যাবী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলেও প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন। অপরদিকে সিটিতে পার্কিং মিটার রেট ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২ থেকে ৪ ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি প্রশাসন।
নিউইয়র্ক সিটি অভিবাসীদের এ স্বর্গরাজ্যে বসবাসকারী তথা পর্যটকদের অন্যতম প্রধান বাহন হচ্ছে, ট্রাক্সি ও বিভিন্ন অ্যাপস ভিত্তিক কোম্পানীর ‘টিএলসি’ গাড়ি। বাড়তি আয়ের আশায় ট্যাক্সি ক্যাবী পেশাটিকে বেছে নেন বেশীরভাগ অভিবাসী। পরিসংখ্যান বলছে, নিউইয়র্ক সিটিতে এশিয়ান ও আফ্রিকানদের মধ্যে বাংলাদেশী চালকদের সংখ্যা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশী। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে টিএলসি লাইসেন্সধারী বাংলাদেশী ক্যাবীদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার ছাড়ি গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘উবার, লিফট’সহ অ্যাপস ভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা রকর্ড পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায়; ম্যাডেলিয়ন নির্ভর চালকরাও ঝুঁকছেন এর দিকে। ফলে, সিটিতে গাণিতিক হারে বাড়ছে- ‘টিএলসি-নির্ভর ‘এফএইচভি-ভিকেল’। এতে, কোম্পানীগুলো লাভবান হলেও চালকদের মাঝে বেড়েছে বৈষম্য আর হতাশা। ক্যাবিদের চলমান বৈষম্য দুরিকরণে একটি নতুন আইন বাস্তবায়নের দাবি উঠে। দফায় দফায় সিটি হলের সামনে কর্মসূচি পালন করে ক্যাবিদের অধিকার রক্ষাকারি সংগঠন ‘নিউইয়র্ক টেক্সি ওয়ার্কার্স এলায়েন্স’। সব ধরণের অ্যাপস ভিত্তিক কোম্পানি এবং মেডেলিয়ন গাড়ির নূন্যতম ভাড়া একই রাখার পক্ষে সোচ্চার আওয়াজ তোলে সংগঠনটি। বুধবার (৮ আগষ্ট) সিটি হলে উত্থাপিত প্রস্তাবিত ‘ফর-হায়ার ভিকেলস-এফএইচভি-২০১৮’ আইনটি পাশে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে, ৩৯ জন হ্যাঁ ভোট দিলেও মাত্র ৬ জন ছিলেন বিপক্ষে। আইনটি পাশ হওয়ার পরপরই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কাজ করছে নিউইয়র্ক ‘ট্যাক্সি এন্ড লিমোজিন কমিশন-টিএলসি’। নতুন আইনে বলা আছে, ‘এফএইচভি’ বা টিএলসি নির্ভর কোন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং নাম্বার প্লেট আগামি এক বছরের জন্য বন্ধ থাকবে।
আইনটি পাশের পর মেয়র বিল ডি ব্লাজিও দাবি করেন, এর মধ্য দিয়ে সিটির প্রায় ১ লাখেরও বেশী চালক উপকৃত হবেন। সেই সাথে সিটির ট্রাফিক ব্যবস্থাও একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকবে। তবে, নিবন্ধিত ক্যাবিদের প্রাপ্য মজুরি কি হবে তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। গ্যারেজ ও বিভিন্ন অ্যাপস ভিত্তিক কোম্পানী গুলোর সাথে বিষয়টি নির্ধারণ ও নীতিমালা প্রণয়নে কাজ শুরু করেছে ‘ট্যাক্সি এন্ড লিমোজিন কমিশন-টিএলসি’।
‘ফর-হায়ার ভিকেলস-এফএইচভি-২০১৮’ আইন পাশের পর এর কার্যকর বাস্তবায়ন দেখতে চান চালকরা। তাদের আশা এর মধ্য দিয়ে ক্যাবিদের স্বার্থ রক্ষাও ভাড়ার বিপীরতে কোম্পানীর গুলোর কমিশন বৈষম্য কমাতে হবে। একই সাথে গ্যারেজে গাড়ির সংখ্যা নিদিষ্ট করার দাবিও জানান অনেকে। অ্যাপস ভিত্তিক কোম্পানিগুলোর চালকদের ব্যবহার করে কাড়ি কাড়ি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে; এমন অভিযোগও উঠেছে। ফলে, নতুন আইনে বিষয়টিও নজরদারিতে আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বাংলাদেশী এক ক্যাবী বলছেন, ‘ওয়ান-কার, ওয়ান-ড্রাইভার’ এ নীতি বাস্তবায়ন হলে চালকদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কোম্পানী ও সিটি প্রশাসন লাভবান হবে। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমানে গ্রীন, ইয়োলো কিংবা উবার’সহ যে কোন অ্যাপস নির্ভর চালকরা প্রতি ঘন্টায় যে আয় করছেন, গাড়ির ম্যান্টেইনেন্স, গ্যাস তথা ফুয়েল বাদ দিয়ে ঘন্টা হিসেবে তা নূন্যতম আয়ের নীচে চলে যায়। সিটি হলের নতুন আইনে সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হবে বলেও বিশ্বাস তাদের।
চালকদের অধিবার রক্ষাকারী সংগঠণ-‘নিউইয়র্কের ট্যাক্সি ওয়ার্কাস এল্যাইন্স’ও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। বলা হচ্ছে- অ্যাপস ভিত্তিক গাড়িগুলোর কোম্পানীর সাথে মিলে ড্রাইভারদের ভাড়া নির্ধারণে টিএলসি শিগগিরই একটি নীতিমালা প্রনয়ণ করবে।
এদিকে নিউইয়ক সিটিতে এ্যাপস ভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা নিদিষ্ট করে দেয়ার লক্ষ্যে আগামী এক বছর তাদের রেজিস্টেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্তকে জনগণের বিজয় হিসেবে দেখছেন মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। নতুন এই আইকে ঠেকাতে সব ধরনের প্রচেস্টা চালিয়েছে এ্যাপস ভিত্তিক ট্যাক্সি কোম্পানিগুলো। কিন্তু জনগণের সাথে একাত্ততা পোষণ করে নিউ ইয়র্কের জনপ্রতিনিধিরা দেখিয়ে দিয়েছেন, বিশাল কিংবা ক্ষমতাবান কোন লোভী গোষ্টিই জনস্বার্থের বিরুদ্বে কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না। আর এই জন্যই নিউ ইয়র্ক বিশ্বের মধ্যে গ্রেট। সিটি হলে সামনে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের এক সমাবেশে এমন কথা বলেন মেয়র ব্লাজিও। এক সময় নিউ ইয়ক শহর দাপট দেখানো সেই ইয়েলো ক্যাবই কঠিন সংকটের মুখে। প্রযুক্তি নির্ভর অ্যাপস ভিত্তিক ক্যাবের কাছে হেরে যাচ্ছেন তারা। ইয়েলো কিংবা গ্রিন ক্যাবে যেমন সব নিয়ম কানুন মেনে, কর দিয়ে চালাতে হয়। উবার, লিফট, জুনু’র মতো অ্যাপস ভিত্তিক ট্যাক্সি সেবাতে তার দরকার নেই।
নিউইয়র্কে বর্তমানে এক লাখ ৮০ হাজার টিএলসি ড্রাইভার থাকলেও নিবন্ধিত গাড়ি আছে একলাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে ১৩৫৫৭ টি মেডালিয়ান। আর অ্যাপস ভিত্তিক শুধু উবারের সংখ্যাই ৬০ হাজারের বেশি। প্রতি মাসেই দ্ইু হাজার ফর হায়ার ভেইকল রাস্তায় নামছে। নিউইয়ক ট্যাক্সি ওয়ার্কার অ্যালায়েন্স বলছে, গেল ৫ বছরে তাদের আয় নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে।
সবশেষ পরিসংখ্যানে উঠে আসে খোদ নিউইয়র্ক সিটিতে গেল ৭ মাসে ৬ জন ক্যাবির আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর এসব হত্যাকান্ডের জন্য ট্যাক্সি অ্যান্ড লিমোজিন কমিশন-টিএলসি এবং নিউইয়র্ক সিটি প্রশাসনের উদাসীনতাই দায়ী। অভিযোগ আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের।
নিউইয়ক সিটির ঐতিহ্য ইয়োল ক্যাবসহ সব ধরনের ক্যাবিদের আয়ের নিরাপত্তা ও সমতা বিধানের লক্ষ্যে গেল প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে ট্যাক্সি। দাবি ছিলো, সব ধরনের ট্যাক্সির জন্য একই নূন্যতম ভাড়া নিধারণ, মেডালিয়নের মতো এ্যাপসের ভাড়া গাড়ির সংখ্যাও নিদিষ্ট করে দেয়া, ক্যাবিদের জন্য আনইমপ্লয়মেন্টের সুবিধা। যার প্রায় সব গুলোই থাকছে নতুন আইনে। আর এটা কার্যকর হবে আক্টোবর থেকে।
এক বছরের জন্য নিউইয়ক সিটিতে নতুন কোন গাড়ির রেজিস্টেশন করতে পারবে না উবার সহ অ্যাপস ভিত্তিক কোম্পানিগুলো। মেনে চলতে হবে ম্যাডালিয়ন গড়ির নিয়মও। নতুন আইনকে জনগণের বিজয় হিসেবেই দেখছেন কাউন্সিল মেম্বাররা।
ট্রাক্সি ওয়ার্কাস এ্যালায়েন্সের চেয়ারপারসন ভৈরবী দেশাই বলেন, উবার-লিফটের মতো করপোরেট গোষ্টি বিরুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে প্রমান হয়েছে ক্ষমতা বা অর্থ নয়, মনবতাই সবার আগে।
নিউইয়র্ক: ইউনিয়ন স্কয়ারে বক্তব্য রাখছেন মেয়র ডি ব্লাজিও
মেয়র ব্লাসিও বলেন, তিন বছর ধরেই আমরা শক্তিশালী করপোরেট গ্রুপের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছি..শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছি। জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে বিশ্বের ব্যাপক ক্ষমতাধর করপোরেট গোষ্টিকেও হারিয়ে দিতে হয়। নতুন আইনের মাধ্যমে ১০০ হাজার মানুষ সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। আর এই আইন কার্যকর হবে অক্টোবর থেকে। যাতে ড্রাইভারদের মিনিমান ইনকাম হয় সেই রুলও রাখা হবে।
অপরদিকে এ্যাপস ভিত্তিক নতুন গাড়ির রেজিস্টেশন এক বছর বন্ধ রাখার পর এবার পার্কিং-এর মিটার রেট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিউইয়ক সিটি প্রশাসন। সর্বপ্রথম ব্রুকলীনে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এর পর ধাপে ধাপে নিউইয়কের অন্যান্য বোরো’তেও মিটার রেট বাড়ানো হবে। ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২ থেকে ৪ ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাড়বে ম্যানহাটনে। সেপ্টেম্বর থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
বিশ্বে ব্যয় বহুল শহরের তালিকায় নিউইয়ক শীষ স্থানের মধ্যেই আছে। চাকচিক্য ময়তার পাশাপাশি এই শহরে জীবন ধারনের ব্যায় নির্বাহে হিম-শীম খেতে হয়, অনেক নাগরিককেই। মেয়র বিল ডি ব্লাজিও’র ভিশন জিরো পরিকল্পনার আওতায়, শহরকে আরো বেশি জনগণের কাছে স্বাচ্ছন্দময় করে গড়ে তুলতে নানা কার্যক্রম নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, শহরের যানজট কমানো। এরই আওতায় এ্যাপস ভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা যেমন নিদিষ্ট করে দেয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে যাচ্ছে তেমনি ব্যক্তিগত যানের চেয়ে গণপরিবহন ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করার পরিকল্পনাও আছে।
ভিশন জিরো পরিকল্পনার আওতায়ই, নিউ ইয়র্কের পাচটি বোরো’তে পাকিং মিটারের রেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি প্রশাসন। ম্যানহ্যাটনের লোয়ার এবং মিড টাউনে বাণিজ্যিক ভাড়া ঘন্টা ২ ডলার থেকে বেড়ে সাড়ে চার ডলার করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিঘন্টার ভাড়া বাড়বে আরো ১ থেকে ৫ ডলার পর্যন্ত। প্যাসেজ্ঞার পাকিং এও ভাড়া বাড়ছে, ঘন্টায় সাড়ে তিন ডলার থেকে বেড়ে সাড়ে চার ডলার করা হচ্ছে। সাথে প্রতিঘন্টায় যোগ হবে বাড়তি ভাড়া।
ম্যানহাটনের বাণিজ্যিক এলাকায় দ্বিতীয় ঘন্টা থেকে সাড়ে ৭ ডলার পর্যন্ত করা হচ্ছে। পার্কিং মিটারের ভাড়া বাড়ানোর সিটির এই সিদ্ধান্তে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শহরবাসী। ব্রঙ্কস, ব্রুকলীন, কুইন্স এবং স্টেটেন আইল্যান্ডেও ঘন্টায় ১ থেকে ২ ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। ব্রুকলীনে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে, ম্যানহ্যাটনে ১ অক্টোবর এবং কুইন্সে ১ নভেম্বর থেকে পাকিং মিটারের রেট বাড়ানো হবে। ব্রঙ্কস ও স্টেট্যান আইল্যান্ডে মিটার ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ৩ ডিসেম্বর থেকে।(বাংলা পত্রিকা)