নিউইয়র্ক ০১:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আরো এগিয়ে যেতে রনি’র চাই আর্থিক সাহায্য

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:১৫:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮
  • / ৮৪২ বার পঠিত

সালাহউদ্দিন আহমেদ॥ নাম তার মাহবুবুর রহমান রনি। বাবা’র নাম মোহাম্মদ সাদুল্লাহ বাচ্চু। আর মা’র নাম রাবেয়া খানম রুবি। গ্রাম- বাহুবল, খাদিননগর, সিলেট। জন্ম- ১ মে ১৯৮৯। ৩ বোন। পরিবারে সবার বড়। কিন্তু জন্মান্ধ। তারপরও রনি’র জীবন থেনে নেই। অন্ধত্ব, নানান জনের নানা সমালোচনা আর ভয় উপেক্ষা করে জয় করে চলেছেন জীবনের নানা অর্জন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শেষে উচ্চ শিক্ষার্থে রনি ঘুরছেন দেশ-বিদেশ। ইতিমধ্যেই নরওয়ে থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের একটি স্কুলে অধ্যয়নরত। তার স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজন আর্থিক সহযোগিতা। গত ২৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপকালে রনি জানান তার জীবনের নানা কথা। খবর ইউএনএ’র।
জন্মান্ধ মাহবুবুর রহমান রনি বলেন, অন্ধ হয়ে আমার জন্মটা মা-বাবা তথা তার পরিবরের জন্য ট্র্যাজিক ঘটনা ছিলো। কেননা তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। শত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও আমার মা-বাবা আমাকে বড় করার চেষ্টা করেন। আমি স্বাভাবিক ছিলাম না, তাই আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা বিভিন্ন মাদ্রাসায় দেন লোখাপড়ার জন্য। বাসাও মওলানাও রেখে দেন। তাতেও পড়াশুনা করতে পারছিলাম না। পরবর্তীতে এক প্রতিবেশী জানালেন অন্ধরাও পড়াশুনা করতে পারে। তখন আমার বয়স ১১ বছর।
তিনি বলেন, প্রতিবেশীর কথা আর পরামর্শে ১৯৯৫ সালে ঢাকায় মিরপুর ১৪ নম্বরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেখানে প্রাইমারী পাশ করার পর সিলেটে ফিরে আসি। সেখান থেকেই মানসিকভাবে নিজেকে গড়ার সকল সুযোগ পাই।
রনি বলেন, ছোট বেলায় আমার বয়সী সবাই বিকেলে বাইরে খেলাল মাঠে আর আমি একা, সন্ধ্যায় পড়তে বসে, আমি পড়তে পাড়ি না। এসব ঘটনা আমাকে কষ্ট দেয়। বলেন, ব্যাডমিন্টন আমার প্রিয় খেলা। এই খেলায় ছন্দ আছে। খেলার ছন্দ আমাকে আলোড়িত করে। কিন্তু কোনদিন ব্যাডমিন্টন খেলতে পারিনি। রনি বলেন, শব্দ আর গন্ধ দিয়েই চলি।
রনি আরো বলেন, ছোট দুই বোন পড়ার সময় তাদের পাশে বসে থাকতাম। বাবা বই এনে দিতেন, মা সেই বই পড়ে বলে দিতেন, আমি মুখস্ত করতাম- অ তে অজগর, আ-তে আম—–। কিন্তু আমি যে আরো পড়তে পারবো তা জানতাম না।
তিনি জানান, ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর সিলেটে অন্ধদের জন্য স্কুল থাকলেও হোস্টেল ছিলো না। তাই মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্ধ হোস্টেল থাকায় সেখানে চলে গেলাম। সেটা ২০০০ সালের ঘটনা। সেখারে ব্রেল সিস্টেম (অন্ধদের পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা) পাচ্ছিলাম না। পড়া রেকর্ড করে করে পড়তে হয়েছে। সমন্বনিত স্কুলে রোল নম্বর ১-৫ নম্বরে থাকতাম। জানান ২০০৫ সালে মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্প থেকে মানবিক বিভাকে এই স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এসএসপি পাশ করেন।
রনি বলেন, পরবর্তীতে মৌলভীবাজার থেকে সিলেটে চলে আসি। জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ-এ ভর্তির চিন্তা, ইচ্ছে করলাম এবং আমিই প্রথম অন্ধ ছাত্র হলাম। ভার্তি হলাম। কিন্তু আমি ভালো রেজাল্ট করার পরও অনেক পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। যা অমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। পরবর্তীতে শারমীন ম্যাডাম ও মাহবুব স্যার ক্লাশের বাইরেও সাহায্য করতেন। সেখান থেকে ২০০৭ সাথে এইচএসসি পাশ করি। মানবিক শাখায় ৪.৪০ মার্ক পেয়ে এ গ্রেডে পাশ করি।
এইচএসসি পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যুদ্ধ শুরু হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অন্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য কোন প্রস্তুতির (কোচিং) ব্যবস্থা ছিলো। বন্ধুদের প্রাইভেট পড়ার লেকচার শীট ধার করে এনে তা ছোট বোন রেকর্ড করে দিলে তা থেকে শিখতাম। এভাবেই চলতে থাকে আমার অনিশ্চিত জীবনের সংগ্রাম।
রনি বলেন, মেধা তালিকায় ১৬৫ তম স্থান নিয়ে ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরেজী বিভাগের জন্য মনোনীত হয়। আমার মা আর আমার ইচ্ছে মতো শিক্ষক হওয়ার জন্য ইরেজী বেছে নেই। বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিলো বড় চ্যালেঞ্জিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ৪৯ রুমে থাকতাম। পরিবারে খরচে অনার্স মাস্টার্স শেষ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্সক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ড. ফখরুল আলম, ড. রুবিনা খান, প্রফেসর তাহমিনা আহমেদ, তাসনিম মাহবুব সিরাজ স্যার আমাকে আর্থিক ও মানসিকভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
রনি বলেন, ২০১১ সালে প্রথম শ্রেনীতে ইরেজী সাহিত্যে অনার্স শেষে করে, ২০১৩ সালে ইরেজী ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং এ প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স করি। কিন্তু সব বন্ধুরা চাকরী পেলেও, অন্ধ হওয়ার কারণে আমি চাকরি পাচ্ছি না। অনেক ব্যাংককেও যোগাযোগ করেছি। চাকরি পেতে যেয়ে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে, খারাপ লেগেছে। ফলে হতাশাও কাছ করতো। কিন্তু দমে যাইন, আবার যুদ্ধ শুরু করি।
বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একটি প্রকল্পের আন্ডারে সিলেটের গোয়াইনঘাট মডেল স্কুলে প্রথম চাকরী পাই। চাকরী পাওয়ার পর জীবনের প্রতি আতœবিশ্বাস বেড়ে যায়। কারণ আমার সকল শিক্ষার্থীরা চোখে দেখতো, আমি চোকে দেখতে পারতাম না। আমি অন্ধ হয়েও শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে পারছি- এই আনন্দ আমাকে সাহস যোগায়। এই চাকরীতে থাকাবস্থায় পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেই এবং ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল ৩৪তম বিসিএস-এ মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেই। ইতিমধ্যে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলো থেকে ফুল স্কালশীল সহ মাস্টার্স (এমফিল) করার আমন্ত্রণ পাই ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল। ফলে ২০১৫ সালের আগষ্টে ভিসা নিয়ে পরাশুনা করতে নরওয়ে যাই। এটাই জীবনে প্রথম দেশের বাইর যাওয়া, প্লেনে ওঠা।
রনি জানান, জীবনের প্রথম বিদেশ সফরের দিন ভয় পেয়েছিলাম। ৪ আগষ্ট ২০১৫ নরওয়ে পৌছে সেখানকার স্বাদ, গন্ধ পেয়ে ভালো ছিলাম। নরওয়েতে ষ্পেশাল শিক্ষা নিয়ে দুই বছর পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করে দেশে ফিরি।
দেশে ফিলে ২০১৭ সালে ১ ডিসেম্বর সিলেট সরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর আরো ডিগ্রি নিতে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন কলেজের লিঞ্চ স্কুল অব এডকেশন ফ্রাকাল্টির কারিকুলাম এন্ড ইনট্রাকশন ডিপার্টমেন্টে পিএইডডি’র জন্য আবেদন করলে ওরা আংশিক স্কারশীপ দিয়ে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ দেয়। পিএইডি করতে হলো ১জিআরই’ লাখে কিন্তু বাংলাদেশের অন্ধরা ‘জিআরই’ দিতে পারে না। জানান ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বস্টন আসি এবং বিদেশী ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। বস্টনের ডর্চচেষ্টারে বাসা ভাড়া করে থাকছি আর পড়াশুনা করছি। জানান, তার টিউশন ফি পার ক্রেডিট ১,৪৭৮ ডলার। পড়াশুনা করতে ৩০ ক্রেডিট লাগবে। ৯ ক্রেডিট শেষ করেছি। আরো জানান, যুক্তরাষ্ট্র আসার সময় তার পরিবার থেকে ৩,০০০ ডলার নিয়ে আসে। সামনে আরো ২১ ক্রেডিট লাগবে। এরজন্য ৩১ হাজার ৩৮ ডলার প্রয়োজন। আমার আছে ৮,৭০০ ডলারের মতো। সব মিলিয়ে আরো ২২ হাজার ডলারের মতো লাগবে।
রনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এনজিওতে কথা বলেছি। কিন্তু আমি অমেরিকান নাগরিক না থাকায় তারা সাহায্য করতে পারছেন না। এজন্যই অর্থের দরকার। অর্থ সাহায্য না পেলে পাড়াশুনা চালাতে পারেবা না। আগামী ১৪ জানুয়ারী মধ্যে ১৩ হাজার ডলারের মতো লাগবে পরবর্তী সেমিস্টারের রেজিষ্ট্রেশনের জন্য। জানান, বস্টোনে কাজও পাচ্ছি না। বস্টন কলেজ কোন অন্ধকে ‘ফেস’ করেনি। ফলে নানা প্রতিবন্ধকাতার শিকার হচ্ছি।
রনি স্কুলের ছুটিতে নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে আছেন এক আত্বিয়ের বাসায়। জানান, তার এক বোন সিলেটের শাহ পরান হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক এবং বিবাহিতা। আরেক বোন সিলেটের মইনুদ্দীন মহিলা কলেজে বাংলায় অনার্স করছে। ছোট আরেক বোন ২০১৯ সালে সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
এই প্রতিনিধির এক প্রশ্নের উত্তরে রনি বলেন, ‘চোখে না দেখা, পড়তে না পাড়া আর প্রিয় মাকে না দেখা জীবনের বড় কষ্ট’। এছাড়াও অন্ধ হওয়ার কারণে আমাকে আলাদা মনে হয়, আলাদা করা হয়। অধিকাংশ মানুষের কাছে সত্যিকারের ভালোবাসা পাইনা। সবাই সহযোগিতার হাত বাড়ায়, নিজেকে অসহায় মনে হয়।
আরো জানান, স্কাইপতে মায়ের কাছ থেকে শিখে সকল রান্না শিখেছি। পোলাও-গরুর মাসং প্রিয় খাবার। প্রিয় মানুষ মা। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর প্রিয় লেখক। অনেক সময় গুণ গুণ করে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি। এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ মনে হয়। এতোদূর আসতে পারবো জানলে আরো ভালো করতাম। রনি তার স্বপ্ন পূরণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহযোগিতা চান। মাহবুবুর রহমান রনি’র সাথে যোগাযোগের নম্বর- ৯২৯-৪৬২-২৯৩৩
এদিকে জন্মান্ধ মাহবুবুর রহমান রনি’র স্বপ্ন আর সমস্যার কথা শুনে জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চৌধুরী এগিয়ে এসেছেন। তিনি রনির সমস্যা সমাধানে কমিউনিটির সহযোগিতা কামনা করেছেন। আরো এগিয়ে এসেছেন কমিউনিটির পরিচিত মুখ ও সমাজসেবী অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

আরো এগিয়ে যেতে রনি’র চাই আর্থিক সাহায্য

প্রকাশের সময় : ০৮:১৫:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

সালাহউদ্দিন আহমেদ॥ নাম তার মাহবুবুর রহমান রনি। বাবা’র নাম মোহাম্মদ সাদুল্লাহ বাচ্চু। আর মা’র নাম রাবেয়া খানম রুবি। গ্রাম- বাহুবল, খাদিননগর, সিলেট। জন্ম- ১ মে ১৯৮৯। ৩ বোন। পরিবারে সবার বড়। কিন্তু জন্মান্ধ। তারপরও রনি’র জীবন থেনে নেই। অন্ধত্ব, নানান জনের নানা সমালোচনা আর ভয় উপেক্ষা করে জয় করে চলেছেন জীবনের নানা অর্জন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শেষে উচ্চ শিক্ষার্থে রনি ঘুরছেন দেশ-বিদেশ। ইতিমধ্যেই নরওয়ে থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের একটি স্কুলে অধ্যয়নরত। তার স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজন আর্থিক সহযোগিতা। গত ২৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপকালে রনি জানান তার জীবনের নানা কথা। খবর ইউএনএ’র।
জন্মান্ধ মাহবুবুর রহমান রনি বলেন, অন্ধ হয়ে আমার জন্মটা মা-বাবা তথা তার পরিবরের জন্য ট্র্যাজিক ঘটনা ছিলো। কেননা তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। শত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও আমার মা-বাবা আমাকে বড় করার চেষ্টা করেন। আমি স্বাভাবিক ছিলাম না, তাই আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা বিভিন্ন মাদ্রাসায় দেন লোখাপড়ার জন্য। বাসাও মওলানাও রেখে দেন। তাতেও পড়াশুনা করতে পারছিলাম না। পরবর্তীতে এক প্রতিবেশী জানালেন অন্ধরাও পড়াশুনা করতে পারে। তখন আমার বয়স ১১ বছর।
তিনি বলেন, প্রতিবেশীর কথা আর পরামর্শে ১৯৯৫ সালে ঢাকায় মিরপুর ১৪ নম্বরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেখানে প্রাইমারী পাশ করার পর সিলেটে ফিরে আসি। সেখান থেকেই মানসিকভাবে নিজেকে গড়ার সকল সুযোগ পাই।
রনি বলেন, ছোট বেলায় আমার বয়সী সবাই বিকেলে বাইরে খেলাল মাঠে আর আমি একা, সন্ধ্যায় পড়তে বসে, আমি পড়তে পাড়ি না। এসব ঘটনা আমাকে কষ্ট দেয়। বলেন, ব্যাডমিন্টন আমার প্রিয় খেলা। এই খেলায় ছন্দ আছে। খেলার ছন্দ আমাকে আলোড়িত করে। কিন্তু কোনদিন ব্যাডমিন্টন খেলতে পারিনি। রনি বলেন, শব্দ আর গন্ধ দিয়েই চলি।
রনি আরো বলেন, ছোট দুই বোন পড়ার সময় তাদের পাশে বসে থাকতাম। বাবা বই এনে দিতেন, মা সেই বই পড়ে বলে দিতেন, আমি মুখস্ত করতাম- অ তে অজগর, আ-তে আম—–। কিন্তু আমি যে আরো পড়তে পারবো তা জানতাম না।
তিনি জানান, ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর সিলেটে অন্ধদের জন্য স্কুল থাকলেও হোস্টেল ছিলো না। তাই মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্ধ হোস্টেল থাকায় সেখানে চলে গেলাম। সেটা ২০০০ সালের ঘটনা। সেখারে ব্রেল সিস্টেম (অন্ধদের পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা) পাচ্ছিলাম না। পড়া রেকর্ড করে করে পড়তে হয়েছে। সমন্বনিত স্কুলে রোল নম্বর ১-৫ নম্বরে থাকতাম। জানান ২০০৫ সালে মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্প থেকে মানবিক বিভাকে এই স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এসএসপি পাশ করেন।
রনি বলেন, পরবর্তীতে মৌলভীবাজার থেকে সিলেটে চলে আসি। জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ-এ ভর্তির চিন্তা, ইচ্ছে করলাম এবং আমিই প্রথম অন্ধ ছাত্র হলাম। ভার্তি হলাম। কিন্তু আমি ভালো রেজাল্ট করার পরও অনেক পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। যা অমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। পরবর্তীতে শারমীন ম্যাডাম ও মাহবুব স্যার ক্লাশের বাইরেও সাহায্য করতেন। সেখান থেকে ২০০৭ সাথে এইচএসসি পাশ করি। মানবিক শাখায় ৪.৪০ মার্ক পেয়ে এ গ্রেডে পাশ করি।
এইচএসসি পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যুদ্ধ শুরু হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অন্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য কোন প্রস্তুতির (কোচিং) ব্যবস্থা ছিলো। বন্ধুদের প্রাইভেট পড়ার লেকচার শীট ধার করে এনে তা ছোট বোন রেকর্ড করে দিলে তা থেকে শিখতাম। এভাবেই চলতে থাকে আমার অনিশ্চিত জীবনের সংগ্রাম।
রনি বলেন, মেধা তালিকায় ১৬৫ তম স্থান নিয়ে ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরেজী বিভাগের জন্য মনোনীত হয়। আমার মা আর আমার ইচ্ছে মতো শিক্ষক হওয়ার জন্য ইরেজী বেছে নেই। বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিলো বড় চ্যালেঞ্জিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ৪৯ রুমে থাকতাম। পরিবারে খরচে অনার্স মাস্টার্স শেষ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্সক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ড. ফখরুল আলম, ড. রুবিনা খান, প্রফেসর তাহমিনা আহমেদ, তাসনিম মাহবুব সিরাজ স্যার আমাকে আর্থিক ও মানসিকভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
রনি বলেন, ২০১১ সালে প্রথম শ্রেনীতে ইরেজী সাহিত্যে অনার্স শেষে করে, ২০১৩ সালে ইরেজী ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং এ প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স করি। কিন্তু সব বন্ধুরা চাকরী পেলেও, অন্ধ হওয়ার কারণে আমি চাকরি পাচ্ছি না। অনেক ব্যাংককেও যোগাযোগ করেছি। চাকরি পেতে যেয়ে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে, খারাপ লেগেছে। ফলে হতাশাও কাছ করতো। কিন্তু দমে যাইন, আবার যুদ্ধ শুরু করি।
বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একটি প্রকল্পের আন্ডারে সিলেটের গোয়াইনঘাট মডেল স্কুলে প্রথম চাকরী পাই। চাকরী পাওয়ার পর জীবনের প্রতি আতœবিশ্বাস বেড়ে যায়। কারণ আমার সকল শিক্ষার্থীরা চোখে দেখতো, আমি চোকে দেখতে পারতাম না। আমি অন্ধ হয়েও শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে পারছি- এই আনন্দ আমাকে সাহস যোগায়। এই চাকরীতে থাকাবস্থায় পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেই এবং ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল ৩৪তম বিসিএস-এ মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেই। ইতিমধ্যে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলো থেকে ফুল স্কালশীল সহ মাস্টার্স (এমফিল) করার আমন্ত্রণ পাই ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল। ফলে ২০১৫ সালের আগষ্টে ভিসা নিয়ে পরাশুনা করতে নরওয়ে যাই। এটাই জীবনে প্রথম দেশের বাইর যাওয়া, প্লেনে ওঠা।
রনি জানান, জীবনের প্রথম বিদেশ সফরের দিন ভয় পেয়েছিলাম। ৪ আগষ্ট ২০১৫ নরওয়ে পৌছে সেখানকার স্বাদ, গন্ধ পেয়ে ভালো ছিলাম। নরওয়েতে ষ্পেশাল শিক্ষা নিয়ে দুই বছর পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করে দেশে ফিরি।
দেশে ফিলে ২০১৭ সালে ১ ডিসেম্বর সিলেট সরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর আরো ডিগ্রি নিতে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন কলেজের লিঞ্চ স্কুল অব এডকেশন ফ্রাকাল্টির কারিকুলাম এন্ড ইনট্রাকশন ডিপার্টমেন্টে পিএইডডি’র জন্য আবেদন করলে ওরা আংশিক স্কারশীপ দিয়ে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ দেয়। পিএইডি করতে হলো ১জিআরই’ লাখে কিন্তু বাংলাদেশের অন্ধরা ‘জিআরই’ দিতে পারে না। জানান ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বস্টন আসি এবং বিদেশী ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। বস্টনের ডর্চচেষ্টারে বাসা ভাড়া করে থাকছি আর পড়াশুনা করছি। জানান, তার টিউশন ফি পার ক্রেডিট ১,৪৭৮ ডলার। পড়াশুনা করতে ৩০ ক্রেডিট লাগবে। ৯ ক্রেডিট শেষ করেছি। আরো জানান, যুক্তরাষ্ট্র আসার সময় তার পরিবার থেকে ৩,০০০ ডলার নিয়ে আসে। সামনে আরো ২১ ক্রেডিট লাগবে। এরজন্য ৩১ হাজার ৩৮ ডলার প্রয়োজন। আমার আছে ৮,৭০০ ডলারের মতো। সব মিলিয়ে আরো ২২ হাজার ডলারের মতো লাগবে।
রনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এনজিওতে কথা বলেছি। কিন্তু আমি অমেরিকান নাগরিক না থাকায় তারা সাহায্য করতে পারছেন না। এজন্যই অর্থের দরকার। অর্থ সাহায্য না পেলে পাড়াশুনা চালাতে পারেবা না। আগামী ১৪ জানুয়ারী মধ্যে ১৩ হাজার ডলারের মতো লাগবে পরবর্তী সেমিস্টারের রেজিষ্ট্রেশনের জন্য। জানান, বস্টোনে কাজও পাচ্ছি না। বস্টন কলেজ কোন অন্ধকে ‘ফেস’ করেনি। ফলে নানা প্রতিবন্ধকাতার শিকার হচ্ছি।
রনি স্কুলের ছুটিতে নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে আছেন এক আত্বিয়ের বাসায়। জানান, তার এক বোন সিলেটের শাহ পরান হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক এবং বিবাহিতা। আরেক বোন সিলেটের মইনুদ্দীন মহিলা কলেজে বাংলায় অনার্স করছে। ছোট আরেক বোন ২০১৯ সালে সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
এই প্রতিনিধির এক প্রশ্নের উত্তরে রনি বলেন, ‘চোখে না দেখা, পড়তে না পাড়া আর প্রিয় মাকে না দেখা জীবনের বড় কষ্ট’। এছাড়াও অন্ধ হওয়ার কারণে আমাকে আলাদা মনে হয়, আলাদা করা হয়। অধিকাংশ মানুষের কাছে সত্যিকারের ভালোবাসা পাইনা। সবাই সহযোগিতার হাত বাড়ায়, নিজেকে অসহায় মনে হয়।
আরো জানান, স্কাইপতে মায়ের কাছ থেকে শিখে সকল রান্না শিখেছি। পোলাও-গরুর মাসং প্রিয় খাবার। প্রিয় মানুষ মা। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর প্রিয় লেখক। অনেক সময় গুণ গুণ করে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি। এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ মনে হয়। এতোদূর আসতে পারবো জানলে আরো ভালো করতাম। রনি তার স্বপ্ন পূরণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহযোগিতা চান। মাহবুবুর রহমান রনি’র সাথে যোগাযোগের নম্বর- ৯২৯-৪৬২-২৯৩৩
এদিকে জন্মান্ধ মাহবুবুর রহমান রনি’র স্বপ্ন আর সমস্যার কথা শুনে জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চৌধুরী এগিয়ে এসেছেন। তিনি রনির সমস্যা সমাধানে কমিউনিটির সহযোগিতা কামনা করেছেন। আরো এগিয়ে এসেছেন কমিউনিটির পরিচিত মুখ ও সমাজসেবী অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ।