নিউইয়র্ক ০১:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

সাবেক সেনাপ্রধানরা সাহস দেখালে শেখ হাসিনা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতেন না

হককথা ডেস্ক
  • প্রকাশের সময় : ০৩:১১:৩৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৪
  • / ১২৭ বার পঠিত

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পরিচালকের পদে ছিলেন ডিসেম্বর ২০০৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত। একই সংস্থার মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ২৩ জুন ২০১১ থেকে ৭ মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত। অনেকেরই অভিযোগ, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকার কায়েমে তারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ে তার সময়কাল ও পরবর্তী সময়ে সংস্থাটি এবং দেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন—

আপনি দুই মেয়াদে ডিজিএফআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ পদে ছিলেন। ওই সময়কালে ডিজিএফআই বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাই।

ডিজিএফআইয়ে যে দুই মেয়াদে ছিলাম এর মধ্যে আবার দুটি ভিন্ন দায়িত্বে ছিলাম। ২০০৭ সালে আমাকে ডিজিএফআইয়ে ফোর্সেস সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (এফএসআইবি) অফিসার ছিলাম। এখানে দায়িত্ব হলো ডিজিএফআইয়ের সব যোগাযোগ দেখাশোনা করা। পরে জুন, ২০০৮ সালে অর্থাৎ ওয়ান-ইলেভেন চলার সময় কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিআইবি) দায়িত্ব পাই। ওই সময় আমি ডিজিএফআইয়ের ডিজিকে রাজি করাই। সে সময় ডিজি ছিলেন জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। উনি আবার তখন সেনাবাহিনীর প্রধানকে রাজি করান এবং আমরা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করি। এরপর তো ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হলো। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর আমি আরো এক বছর ডিজিএফআইয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম। পরে আল্লাহর রহমতে প্রমোশন পেয়ে লগ এরিয়া কমান্ডার হিসেবে চলে যাই।

পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে ডিজি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এরপর এখানে এক বছর আট মাস চাকরি করি। ২০১৩ সালের ৭ মার্চের প্রোগ্রাম থেকে বাসায় এসে হঠাৎ করে শুনি আমাকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার সময় আপনি ডিজিএফআইয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। এ ঘটনা ঘটার আগে এ বিষয়ে কোনো তথ্য কি আপনি পেয়েছিলেন?

বিজিবিতে রাইফেলস সিকিউরিটি ইউনিট (আরএসইউ) নামে একটি ইউনিট আছে। ওখানে আমাদের দায়িত্ব ছিল অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে। তবে একটি লিফলেট ছড়ানোর বিষয় জানতাম। এ তথ্য ২২-২৩ ফেব্রুয়ারির দিকে আমাদের কাছে আসে। লিফলেটে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ছিল। ডাল-ভাতের কর্মসূচির কথাও ছিল। ঢাকা ডিটাচমেন্ট কমান্ডার যখন তথ্যটি দেয় তখন এটি বিজিবির আরএসইউকে জানানো হয়। তখন সে বলেছিল এ লিফলেটের ঘটনা তারাও জানে। ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমার কাছে এতটুকুই তথ্য ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে হয়তো তদন্ত করে অনেক কিছু বের হয়েছে। জেনারেল জাহাঙ্গীর হয়তো উনার তদন্ত এখন প্রকাশ করবেন।

সে সময় আপনারা যে তথ্য দিয়েছিলেন সে অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল?

আরএসইউ জানে বলেছিল, নিশ্চয় তাদের পদক্ষেপ ছিল। কারণ ওখানে একটি বড় প্রোগ্রাম হওয়ার কথা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে যাবেন। প্রথমদিন ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী যাবেন তখন হয়তো সব সিকিউরিটি ছিল—এসএসএফ, এনএসআই। ২৫ ফেব্রুয়ারি হয়তো নিরাপত্তা আগের দিনের মতো ছিল না। ওখানে হয়তো নিরাপত্তায় কিছু গলদ ছিল, সেজন্যই হয়তো ঘটনাটি ঘটে গেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আপনার কোন কোন স্মৃতি মনে আছে?

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন শুনলাম বিজিবিতে এমন একটি ঘটনা ঘটছে তখন সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলাম। প্রথমে সাত মসজিদ রোড দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যেহেতু এটি সরাসরি, ওই দিকে অস্ত্রশস্ত্র তাক করা আছে। তখন আমি ধানমন্ডির দিক থেকে আসলাম। ওখানে মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও শেখ ফজলে নূর তাপসসহ আরো কিছু লোকজন এল।

একই সময়ে সেনা ও নৌবাহিনীর প্রধানরা যমুনায় ছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর অফিস যমুনায় ছিল। ডিজিএফআইয়ের সে সময়ের ডিজি, এনএসআইয়ের ডিজি, বিজিবির ডিজিও ওখানে ছিলেন। মঈন ইউ আহমেদ তখন যমুনায় ছিলেন। আর আমি পুরোটা সময় গ্রাউন্ডে ছিলাম। শুনছি আর্মির লোক আবাহনীর মাঠ পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু হচ্ছিল না। তারপর দেখলাম তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এলেন। শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানকদের কাছে জানতে চাইলাম কী হচ্ছে। তারা বলল ডিজিএফআইয়ের লোকের এখানে দরকার নেই, আমরা এখানে মিটিং করব। বুঝতে পারছিলাম যেহেতু মিলিটারির সঙ্গে তাদের খারাপ স্মৃতি আছে তাই আমাদের যুক্ত করবে না। আমাদের চোখের সামনেই তারা মিটিংয়ে ঢুকেছিলেন।

পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত আসছিল না। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কিছু হচ্ছে না কেন? তখন শুনছি এই হচ্ছে, ওই হচ্ছে, ফোর্স চলে আসছে, সাভার থেকে ট্যাংক আসছে।

ওই সময়ে সিদ্ধান্তের জন্য আপনারা অপেক্ষা করছিলেন? এ সিদ্ধান্ত না আসাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

এতদিন পর আমি এখনো মনে করি যে সেনাবাহিনী দ্রুত অ্যাকশন নিলে হয়তো কিছু পরিমাণে হলেও ক্ষতি কমানো যেত। এমন একটি ঘটনার তথ্য আমাদের কাছে না থাকা কিংবা আরএসইউর চোখে না পড়ার বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিকই মনে হয়। এক্ষেত্রে মিলিটারিকে আমি কোনোভাবেই দোষ দেব না। যারা গ্রাউন্ডে ছিল তারা সিদ্ধান্তের জন্য তৈরি ছিল। কিন্তু ওই সময়টা কোনো সিদ্ধান্তই আসেনি। সবাই ক্রোধান্বিত ছিল যে কেন সিদ্ধান্ত আসছে না। দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে বারোটার দিকে ফোর্স চলে আসছিল। আর ক্যান্টনমেন্ট খুব একটা দূরে না। তাদের মোবিলাইজ করলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসতে পারে।

সে সময় সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সেনাসদস্যরা। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমরা পরে দেখেছি যেদিন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ পরের দিন মিটিং ডাকেন। পরের দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যখন ডাকেন তখনো ওখানে কিন্তু অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেন আর্মিকে যেতে দেয়া হলো না। ওই ক্ষোভ কিন্তু আজ পর্যন্ত মেটেনি।

আপনি যখন ডিজিএফআইয়ের ডিজি সে সময় গুমের ঘটনা ঘটেছে। এর দায় কি আপনি এড়াতে পারেন?

ইলিয়াস আলীর ঘটনাটি ঘটার পর আমি শুনেছি এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এটি আমি নিশ্চিত যে আমাদের কেউ সে সময় ওইখানে ছিল না। এটি থাকলে আমার জানার কথা। সুতরাং কোনোভাবে আমি কানেক্ট করতে পারিনি কে করেছে, কীভাবে করেছে। সুতরাং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সে যেটা জানছিলাম সেটা এমন যে ইলিয়াস আলীর একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমরা নিজেরা যেহেতু যুক্ত ছিলাম না সেজন্য আমরা এটির বিস্তারিত জানি না। অনেকেই এটা বলত যে ডিজিএফআই জানে। কিন্তু ২০১১ সালের ২৩ জুন থেকে ২০১৩ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত কোনো ধরনের গুম বা এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের কোনো ধরনের ঘটনা ডিজিএফআই কর্তৃক সংঘটিত হয়নি। এটি আমি আবারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই। আমি ৭ মার্চ ডিজির দায়িত্ব থেকে চলে গিয়েছি। টেরোরিস্টদের প্রয়োজন হলে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু এখানে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আনা হয়নি।

আমি ভাগ্যবান যে আমার সময়টি সংক্ষিপ্ত ছিল। ওই সময়ের মধ্যেই চলে আসছি। ২০১৪ ইলেকশনটায় আল্লাহর রহমতে আমি ছিলাম না। এ নির্বাচনে তো ১৫৩টা সিটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। এ ধরনের একটি নির্বাচনে যুক্ত না থাকাটা আল্লাহর একটি আশীর্বাদ ছিল।

একজন ডিজিএফআইয়ের কার্যকাল কখনো এক বছর আট মাস হয় না। জেনারেল মোহাম্মদ আকবর হোসেন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিলেন, চার বছর ছিল তার মেয়াদকাল। তারপর মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন আসেন, যিনি তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। ডিজির স্বাভাবিক মেয়াদ তিন বছর। সেখানে এক বছর আট মাস ছিল আমার মেয়াদ। কর্তৃপক্ষ আমাকে একটু প্রিম্যাচিউরলি সরিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমরা সুইডেনভিত্তিক একটি গণমাধ্যম নেত্র নিউজের রিপোর্ট দেখেছি। তখন জানতে পারলাম ইলিয়াস আলীর গুমের সঙ্গে র‍্যাব জড়িত।

২০১০-এর ডিসেম্বরে চৌধুরী আলমের গুমের ঘটনা ঘটেছিল। তখন আপনি পরিচালক ছিলেন ডিজিএফআইয়ের। সেখানে হাত ছিল কি ডিজিএফআইয়ের?

চৌধুরী আলম গুমের ঘটনাও একটি রাজনৈতিক ঘটনা। সে ব্যাপারেও আমরা ওরকমভাবে শুনেছি। ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের গুমের সময় আমি ডিজিএফআইয়ে ছিলাম। সুতরাং এখানে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যে এখানে ডিজিএফআইয়ের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

ইলিয়াস আলীর ঘটনায় র‍্যাবের জড়িত থাকার কথা বললেন। ঊর্ধ্বতন মহল থেকে এ ধরনের কোনো কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আপনাকে বলা হয়েছিল?

সত্যি কথা বলছি, আমার কাছে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আসেনি। কারণ তখন হয়তো বুঝতে পেরেছে যে আমি পারব না বা করব না। তখন জেনারেল মতিন উনি বোধ হয় কাউকে বলেছিলেন যে মামুন খালেদ এ রকম চেঞ্জ হয়েছে। আরো চার-পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০১২ তে আমাকে পোস্টিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সুতরাং এটিও কিন্তু একটি লক্ষণ। সে সময় মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক (প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা) বলেছেন যে ডিজি ডিজিএফআইকে পরিবর্তন করতে হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে পরে এমনটা শুনেছিলাম। তখন হয়তো নিশ্চয় ভেবেছে, ‌‘একে দিয়ে হবে না। আমরা যা করতে চাই তা করতে পারব না। অতএব একে পরিবর্তন করে ফেলো। নতুন সেটআপ আনো।’

২০১৮ সালে আপনাকে সেনাপ্রধান না করে জেনারেল আজিজ আহমেদকে করা হলো। কেন এমনটি করা হয়েছিল?

আমার অতীতের রেকর্ড দেখেই বুঝতে পারছেন কেন হতে পারিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেনারেল আজিজ যে পারফরম্যান্স দিয়েছেন, সেটি আমি করতে পারতাম না। অথবা ২০১৪ সালে জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া যে ভূমিকা রেখেছেন, কিংবা ২০২৪ সালে জেনারেল এসএম সফিউদ্দিন আহমেদ যে ভূমিকা রেখেছেন, সেটি সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগের আগে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করতেন। অতএব ২০১৩ সালে যখন মেয়াদ পূর্ণের আগে ডিজিএফআইয়ের ডিজি থেকে আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমার সেনাপ্রধান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে অনেককেই তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠছে। অনেকের কোর্ট মার্শাল হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে?

সেনাবাহিনীর সিস্টেমটা রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর প্রধানের। সেনাবাহিনী প্রধান ভালো হলে সংগঠনটি ভালো করে। উনি যদি সেটি না করেন তাহলে উনি তো উনার সংগঠনের ক্ষতি করলেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমি বোর্ডে ছিলাম। সেনাবাহিনীতে সবসময়ই বোর্ডে প্রমোশন হয়। কিন্তু জেনারেল আজিজের সময় দেখলাম বোর্ডের বাইরেও কিছু প্রমোশন হচ্ছে। তখন আমি শুনলাম তারা একটি নোট বানিয়ে নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে প্রমোশন দেয়া হচ্ছে। সেটিকেই বলা হতো নোট শিট প্রমোশন। ২০১৬-১৭ সালের আগ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রমোশন হয়নি। যেটা জেনারেল আজিজ শুরু করেছেন।

সেনাবাহিনীতে পিএসসি না করলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হতে পারবে না বলে আমাদের এখানে সিস্টেমই আছে। কিন্তু কাউকে কাউকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রধান এগুলো প্রমোট করেছেন। আর্মিতে কিন্তু এগুলো খুবই স্বচ্ছ ছিল একটা সময় পর্যন্ত।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে বঙ্গভবনে নিয়ে গেছেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির সামনে অ্যাটর্নি জেনারেল জোর করছেন। কিন্তু উনি তো ছাড়েননি। উনি বলেছেন, না, আমি এটা করতে পারব না। এ রকম সাহসিকতা দেখিয়েছেন বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

উনি তো জেনারেল মুস্তাফিজের জামাই। শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু উনি উনার সততা দেখিয়েছেন। বাহিনীর আগের প্রধানরা কেন দেখাননি? কেন তারা অযোগ্য লোককে প্রমোশন দিলেন? যারা প্রমোশন পেয়েছে শুধু তাদের দোষ দিলেই হবে না। যারা দিয়েছেন তাদেরও দোষ দিতে হবে। মিডিওকার (মাঝারি মানের) যখন শাসন করা শুরু করে তখন তারা মিডিওকারকে প্রমোট করা শুরু করে।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাহসের কথা বলছেন। উনার জায়গায় আপনি থাকলে কি শেখ হাসিনাকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন?

এটি ভেতরের ব্যাপার তো। ঠিক বলতে পারব না যে কোন পরিস্থিতিতে, কী কারণে ভারতে পাঠালেন? উনি হয়তো তখন শর্ত দিয়েছেন যে আমি পদত্যাগ করতে পারি তবে আমাকে ভারতে পাঠাতে হবে। উনি (শেখ হাসিনা) হয়তো এ শর্ত দিয়েছিলেন। তখন তো দেশ বাঁচাতে হবে। সেই সময় আরো গোলাগুলি হতে পারত। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তাকে বিদেশ পাঠানো আমি সঠিক মনে করি। কারণ সবার আগে দেশ।

আপনাকে তিন বা চার বছর না রেখে একদম নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সরিয়ে দেয়ার কারণগুলো যদি বিস্তারিত বলতেন।

সঠিক কারণ বলতে পারব না। সে সময় পারফরম্যান্স ভালো ছিল না বলে আমি মনে করি। ডিজি ডিজিএফআই হিসেবে সরকারের যে আশা ছিল সেটি পূরণ করতে পারিনি। সরাসরি কোনো কারণ জানা যায়নি। এটি প্রিম্যাচিউর পোস্টিং দেখেই বুঝতে হবে। যদি কেউ অন প্রমোশন পোস্টিংয়ে যায় তাহলে সেটি ঠিক আছে। কিন্তু একই র‍্যাংকে অন্য জায়গায় পোস্টিং দেয়া হয়, সেটি অগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেয়া হয় তাহলে বুঝতে হবে হয়তো কোনো কারণে আমি পারফর্ম করতে পারছিলাম না। সে সময় আমার কোনো ফেইলিউর ছিল না। হঠাৎ করে আমার পোস্টিং দেখলাম।

আপনার পারফরম্যান্সের কোন দিকটার জন্য এমন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

হয়তো সরকার মনে করেছে সামনে নির্বাচন আসছে ওখানে অনেক ধরনের তৎপরতা লাগবে। হয়তো ওকে দিয়ে করানো যাবে না বা ও করবে না। তা না হলে ইলেকশনের আগে এ রকম জায়গায় পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল না। এরপর আমি ভালো কোনো পোস্টিংও পাইনি। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) গেলাম। সেখান থেকে বিইউএফ, তারপর এনডিসি। আমাকে আর্মির হেডকোয়ার্টার্সে কিংবা কোনো অর্গানাইজেশনের প্রধানের দায়িত্বেও দেয়া হয়নি।

ডিজিএফআই কীভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হলো?

আমার কাছে মনে হয় এখানে যে অর্ডার দেয় এবং যে বাস্তবায়ন করে দুজনকেই দায়ী করব। অর্থাৎ হাতিয়ার যে করেছে এবং যে হয়েছে দুজনই দায়ী। কেননা কোনো অনৈতিক কমান্ড না মানলে কাউকে বের করে দেয়া হয় না। হয়তো অগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং দিয়ে দেবে। যেভাবে আমাকে দেয়া হয়েছিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল যাতে আসে সেজন্য কাজ করেছি। আমি ইন্টেলিজেন্সের জায়গা থেকে কাজ করেছি। সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় আমি নিজেই গিয়েছি। উনাকে আসার কথা বলেছি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে কেন বহুদলীয় নির্বাচন হয়নি? এ সময়গুলোয় ডিজিএফআইয়ের ডিজিদের জিজ্ঞেস করেন তারা কেন এ বিষয়ে চেষ্টা করলেন না।

প্রতিটি সংগঠন যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তাদের সেভাবেই ব্যবহার করা উচিত বলে আমি মনে করি। এখন মেজর জেনারেল ফয়জুর রহমান তো সবার কথা শুনছেন না। তিনি রাজনীতির কিছুতেই নেই। কারণ প্রফেসর ইউনূস বোঝেন। তাই তিনি ডিজিএফআইকে রাজনীতিতে যুক্ত করছেন না।

আমি যখন তরুণ অফিসার ছিলাম তখন সকাল বেলা পিটি আর ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া আর কিছু বুঝতাম না। ২০১২ সাল থেকে আর্মি নানা রকম কাজে যুক্ত হওয়া শুরু করল। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব জায়গায় সেনাবাহিনীর সদস্য দেখা যায়। সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যেই থাকা উচিত। কোনো ইমার্জেন্সি বা বন্যার মতো পরিস্থিতিতে আর্মি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসবে। এ বছরের পর আর্মিকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনতে হবে। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে সুপারভাইজ করার জন্য আর্মিকে ব্যবহার করা উচিত না।

২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ডিজিএফআই ভূমিকা রেখেছিল এমন অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

এটিতে কোনো ধরনের স্পন্সরশিপ আমাদের ছিল না। সে সময় ওখানে কী হচ্ছে দেখার জন্যই আমি যাই।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দ্বিদলীয় রাজনীতির পরিবর্তন ঘটবে বলে কি আপনি মনে করেন? নতুন রাজনীতি তৈরি হবে কি?

যেহেতু এ বিপ্লব স্বাধীনতা দিয়েছে তাই আমার কাছে মনে হয় রাজনৈতিক দল আসার কথা। যত রাজনৈতিক দল আসবে ততই ভালো হবে। জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে আসা দরকার। কানাডা, নিউজিল্যান্ডে কিন্তু এমনটিই ঘটছে। আমাদের এখানে একটি প্রবণত আছে, দায়িত্ব পেলেই আর ছাড়তে চায় না। এটির পরিবর্তন করা দরকার।

প্রফেসর ইউনূস এখন শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে সবাইকে যুক্ত করছেন। অর্থাৎ আমাদের এখানেও মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। সামনের দিনে তাই হবে বলে আমি মনে করি। ফাহাম আব্দুস সালাম দুটি বিষয়ে বলেছেন, মেরিটোক্রেসি এবং রুল অব ল। আর এর সঙ্গে আমি যোগ করব একটি—সততা।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনীর হাতে ঘটা হত্যাকাণ্ডকে কীভাবে বিচার করবেন?

আমি এটিকে নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব। একটি সঠিক নেতৃত্ব থাকলে একটি দেশের এ অবস্থা হতো না। যেসব দেশে গুড ট্রানজিশন হয়েছে সবগুলোয়ই সঠিক নেতৃত্ব ছিল। যেমন সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া। এখন ড. ইউনূস ভালো নেতৃত্বের মাধ্যমে যদি পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। নেতৃত্বটি একটি টপ-ডাউন প্রসেস। ওপরের দিকে নেতৃত্ব ভালো হলে সবসময়ই নিচের দিকে ভালো হবে।

অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের জন্য পুলিশকে জনগণের বিপক্ষে নামানো হলো। পুলিশকে লিথাল (প্রাণঘাতী) অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেয়া ঠিক হয়নি। ফলে অনেক বেসামরিক প্রাণহানি হলো। তিউনিশিয়া, মিসর থেকে দেখা গেছে, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে সাধারণ মানুষ তো ক্ষুব্ধ ছিল। তিনটি নির্বাচন করা হয়েছে, যেখানে বিরোধী কেউ অংশগ্রহণ করেনি। এটি তাদের বোঝা উচিত ছিল যে একপর্যায়ে মানুষ বিদ্রোহ করবে। এখানে তাই হয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কী করবে? সামনে তো আসতে হবে তখন।

তবে উনার (শেখ হাসিনার) লিডারশিপটা আরো ভালো হতে পারত। উনার চারপাশে চারজনের কথা ইদানীং বলছেন অনেকে। কিন্তু উনি আসলে একা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। উনার আশপাশের লোকগুলো যদি আরো জ্ঞানী, বিবেকী মানুষজন হতেন অনেক আগেই জিনিসটা ধরতে পারতেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে হয়তো হেরে যেতেন কিন্তু তারপর আসার পথ খোলা থাকত। আপনি ১৫৩টি সিটে নির্বাচন ছাড়াই জয়ী হয়েছেন। ২০১৮ সালে রাতে নির্বাচন করে ফেললেন। আবার ২০২৪ সালে হলো নতুন ধারার ডামি নির্বাচন। এমনভাবে কোনো গণতান্ত্রিক দেশ তো নির্বাচন করে না।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুনর্বাসন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাই।

শেখ হাসিনার যে বয়স হয়েছে রাজনীতিতে পুনর্বাসন হতে পারবে না। তবে আওয়ামী লীগ যেভাবে ১৫ বছর ধরে চলেছে সেখান থেকে রিফর্ম করতে হবে। এ সময়ের ঘটনাগুলো মানুষ অত সহজে ভুলে যাবে না। তবে তাদের অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ফিরে আসতে পারবে।

রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। এ নিয়ে আপনার মতামত কী?

আমার কাছে মনে হয় সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য এক বছর বা দুই বছর লাগার কথা। এরপর যেই আসবে সেই ফলো করবে। না হলে তাদের কাছে এটি স্পষ্ট যে তারা যদি তৈরি করা সিস্টেমটি ফলো না করে তাহলে জনগণ জেগে উঠবে।

এখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় দ্রুতই পরিবর্তন করতে হবে। আর অগুরুত্বপূর্ণ পোস্টগুলো থাকুক। যেই পরিবর্তন অলরেডি করা হচ্ছে। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ে পরিবর্তন হয়েছে। এটাতে পাঁচ-সাত বছর লাগবে পরিবর্তন করতে। কারণ ১৫ বছরে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা এখন পরিচালক পর্যায়ে চলে এসেছে। তারা আস্তে আস্তে অবসরে যাবে। তাই সিস্টেমটি যখনই শুরু হয় এরপর পাঁচ বছর লাগবে। তাই আজকেই শুরু করা ভালো। প্রফেসর ইউনূস সাহেব শুরু করেছেন। পরে কী হবে তা জনগণই ঠিক করবে।

 

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

সাবেক সেনাপ্রধানরা সাহস দেখালে শেখ হাসিনা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতেন না

প্রকাশের সময় : ০৩:১১:৩৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৪

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পরিচালকের পদে ছিলেন ডিসেম্বর ২০০৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত। একই সংস্থার মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ২৩ জুন ২০১১ থেকে ৭ মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত। অনেকেরই অভিযোগ, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকার কায়েমে তারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ে তার সময়কাল ও পরবর্তী সময়ে সংস্থাটি এবং দেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন—

আপনি দুই মেয়াদে ডিজিএফআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ পদে ছিলেন। ওই সময়কালে ডিজিএফআই বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাই।

ডিজিএফআইয়ে যে দুই মেয়াদে ছিলাম এর মধ্যে আবার দুটি ভিন্ন দায়িত্বে ছিলাম। ২০০৭ সালে আমাকে ডিজিএফআইয়ে ফোর্সেস সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (এফএসআইবি) অফিসার ছিলাম। এখানে দায়িত্ব হলো ডিজিএফআইয়ের সব যোগাযোগ দেখাশোনা করা। পরে জুন, ২০০৮ সালে অর্থাৎ ওয়ান-ইলেভেন চলার সময় কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিআইবি) দায়িত্ব পাই। ওই সময় আমি ডিজিএফআইয়ের ডিজিকে রাজি করাই। সে সময় ডিজি ছিলেন জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। উনি আবার তখন সেনাবাহিনীর প্রধানকে রাজি করান এবং আমরা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করি। এরপর তো ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হলো। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর আমি আরো এক বছর ডিজিএফআইয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম। পরে আল্লাহর রহমতে প্রমোশন পেয়ে লগ এরিয়া কমান্ডার হিসেবে চলে যাই।

পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে ডিজি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এরপর এখানে এক বছর আট মাস চাকরি করি। ২০১৩ সালের ৭ মার্চের প্রোগ্রাম থেকে বাসায় এসে হঠাৎ করে শুনি আমাকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার সময় আপনি ডিজিএফআইয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। এ ঘটনা ঘটার আগে এ বিষয়ে কোনো তথ্য কি আপনি পেয়েছিলেন?

বিজিবিতে রাইফেলস সিকিউরিটি ইউনিট (আরএসইউ) নামে একটি ইউনিট আছে। ওখানে আমাদের দায়িত্ব ছিল অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে। তবে একটি লিফলেট ছড়ানোর বিষয় জানতাম। এ তথ্য ২২-২৩ ফেব্রুয়ারির দিকে আমাদের কাছে আসে। লিফলেটে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ছিল। ডাল-ভাতের কর্মসূচির কথাও ছিল। ঢাকা ডিটাচমেন্ট কমান্ডার যখন তথ্যটি দেয় তখন এটি বিজিবির আরএসইউকে জানানো হয়। তখন সে বলেছিল এ লিফলেটের ঘটনা তারাও জানে। ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমার কাছে এতটুকুই তথ্য ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে হয়তো তদন্ত করে অনেক কিছু বের হয়েছে। জেনারেল জাহাঙ্গীর হয়তো উনার তদন্ত এখন প্রকাশ করবেন।

সে সময় আপনারা যে তথ্য দিয়েছিলেন সে অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল?

আরএসইউ জানে বলেছিল, নিশ্চয় তাদের পদক্ষেপ ছিল। কারণ ওখানে একটি বড় প্রোগ্রাম হওয়ার কথা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে যাবেন। প্রথমদিন ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী যাবেন তখন হয়তো সব সিকিউরিটি ছিল—এসএসএফ, এনএসআই। ২৫ ফেব্রুয়ারি হয়তো নিরাপত্তা আগের দিনের মতো ছিল না। ওখানে হয়তো নিরাপত্তায় কিছু গলদ ছিল, সেজন্যই হয়তো ঘটনাটি ঘটে গেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আপনার কোন কোন স্মৃতি মনে আছে?

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন শুনলাম বিজিবিতে এমন একটি ঘটনা ঘটছে তখন সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলাম। প্রথমে সাত মসজিদ রোড দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যেহেতু এটি সরাসরি, ওই দিকে অস্ত্রশস্ত্র তাক করা আছে। তখন আমি ধানমন্ডির দিক থেকে আসলাম। ওখানে মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও শেখ ফজলে নূর তাপসসহ আরো কিছু লোকজন এল।

একই সময়ে সেনা ও নৌবাহিনীর প্রধানরা যমুনায় ছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর অফিস যমুনায় ছিল। ডিজিএফআইয়ের সে সময়ের ডিজি, এনএসআইয়ের ডিজি, বিজিবির ডিজিও ওখানে ছিলেন। মঈন ইউ আহমেদ তখন যমুনায় ছিলেন। আর আমি পুরোটা সময় গ্রাউন্ডে ছিলাম। শুনছি আর্মির লোক আবাহনীর মাঠ পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু হচ্ছিল না। তারপর দেখলাম তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এলেন। শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানকদের কাছে জানতে চাইলাম কী হচ্ছে। তারা বলল ডিজিএফআইয়ের লোকের এখানে দরকার নেই, আমরা এখানে মিটিং করব। বুঝতে পারছিলাম যেহেতু মিলিটারির সঙ্গে তাদের খারাপ স্মৃতি আছে তাই আমাদের যুক্ত করবে না। আমাদের চোখের সামনেই তারা মিটিংয়ে ঢুকেছিলেন।

পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত আসছিল না। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কিছু হচ্ছে না কেন? তখন শুনছি এই হচ্ছে, ওই হচ্ছে, ফোর্স চলে আসছে, সাভার থেকে ট্যাংক আসছে।

ওই সময়ে সিদ্ধান্তের জন্য আপনারা অপেক্ষা করছিলেন? এ সিদ্ধান্ত না আসাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

এতদিন পর আমি এখনো মনে করি যে সেনাবাহিনী দ্রুত অ্যাকশন নিলে হয়তো কিছু পরিমাণে হলেও ক্ষতি কমানো যেত। এমন একটি ঘটনার তথ্য আমাদের কাছে না থাকা কিংবা আরএসইউর চোখে না পড়ার বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিকই মনে হয়। এক্ষেত্রে মিলিটারিকে আমি কোনোভাবেই দোষ দেব না। যারা গ্রাউন্ডে ছিল তারা সিদ্ধান্তের জন্য তৈরি ছিল। কিন্তু ওই সময়টা কোনো সিদ্ধান্তই আসেনি। সবাই ক্রোধান্বিত ছিল যে কেন সিদ্ধান্ত আসছে না। দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে বারোটার দিকে ফোর্স চলে আসছিল। আর ক্যান্টনমেন্ট খুব একটা দূরে না। তাদের মোবিলাইজ করলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসতে পারে।

সে সময় সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সেনাসদস্যরা। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমরা পরে দেখেছি যেদিন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ পরের দিন মিটিং ডাকেন। পরের দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যখন ডাকেন তখনো ওখানে কিন্তু অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেন আর্মিকে যেতে দেয়া হলো না। ওই ক্ষোভ কিন্তু আজ পর্যন্ত মেটেনি।

আপনি যখন ডিজিএফআইয়ের ডিজি সে সময় গুমের ঘটনা ঘটেছে। এর দায় কি আপনি এড়াতে পারেন?

ইলিয়াস আলীর ঘটনাটি ঘটার পর আমি শুনেছি এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এটি আমি নিশ্চিত যে আমাদের কেউ সে সময় ওইখানে ছিল না। এটি থাকলে আমার জানার কথা। সুতরাং কোনোভাবে আমি কানেক্ট করতে পারিনি কে করেছে, কীভাবে করেছে। সুতরাং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সে যেটা জানছিলাম সেটা এমন যে ইলিয়াস আলীর একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমরা নিজেরা যেহেতু যুক্ত ছিলাম না সেজন্য আমরা এটির বিস্তারিত জানি না। অনেকেই এটা বলত যে ডিজিএফআই জানে। কিন্তু ২০১১ সালের ২৩ জুন থেকে ২০১৩ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত কোনো ধরনের গুম বা এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের কোনো ধরনের ঘটনা ডিজিএফআই কর্তৃক সংঘটিত হয়নি। এটি আমি আবারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই। আমি ৭ মার্চ ডিজির দায়িত্ব থেকে চলে গিয়েছি। টেরোরিস্টদের প্রয়োজন হলে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু এখানে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আনা হয়নি।

আমি ভাগ্যবান যে আমার সময়টি সংক্ষিপ্ত ছিল। ওই সময়ের মধ্যেই চলে আসছি। ২০১৪ ইলেকশনটায় আল্লাহর রহমতে আমি ছিলাম না। এ নির্বাচনে তো ১৫৩টা সিটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। এ ধরনের একটি নির্বাচনে যুক্ত না থাকাটা আল্লাহর একটি আশীর্বাদ ছিল।

একজন ডিজিএফআইয়ের কার্যকাল কখনো এক বছর আট মাস হয় না। জেনারেল মোহাম্মদ আকবর হোসেন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিলেন, চার বছর ছিল তার মেয়াদকাল। তারপর মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন আসেন, যিনি তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। ডিজির স্বাভাবিক মেয়াদ তিন বছর। সেখানে এক বছর আট মাস ছিল আমার মেয়াদ। কর্তৃপক্ষ আমাকে একটু প্রিম্যাচিউরলি সরিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমরা সুইডেনভিত্তিক একটি গণমাধ্যম নেত্র নিউজের রিপোর্ট দেখেছি। তখন জানতে পারলাম ইলিয়াস আলীর গুমের সঙ্গে র‍্যাব জড়িত।

২০১০-এর ডিসেম্বরে চৌধুরী আলমের গুমের ঘটনা ঘটেছিল। তখন আপনি পরিচালক ছিলেন ডিজিএফআইয়ের। সেখানে হাত ছিল কি ডিজিএফআইয়ের?

চৌধুরী আলম গুমের ঘটনাও একটি রাজনৈতিক ঘটনা। সে ব্যাপারেও আমরা ওরকমভাবে শুনেছি। ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের গুমের সময় আমি ডিজিএফআইয়ে ছিলাম। সুতরাং এখানে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যে এখানে ডিজিএফআইয়ের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

ইলিয়াস আলীর ঘটনায় র‍্যাবের জড়িত থাকার কথা বললেন। ঊর্ধ্বতন মহল থেকে এ ধরনের কোনো কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আপনাকে বলা হয়েছিল?

সত্যি কথা বলছি, আমার কাছে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আসেনি। কারণ তখন হয়তো বুঝতে পেরেছে যে আমি পারব না বা করব না। তখন জেনারেল মতিন উনি বোধ হয় কাউকে বলেছিলেন যে মামুন খালেদ এ রকম চেঞ্জ হয়েছে। আরো চার-পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০১২ তে আমাকে পোস্টিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সুতরাং এটিও কিন্তু একটি লক্ষণ। সে সময় মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক (প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা) বলেছেন যে ডিজি ডিজিএফআইকে পরিবর্তন করতে হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে পরে এমনটা শুনেছিলাম। তখন হয়তো নিশ্চয় ভেবেছে, ‌‘একে দিয়ে হবে না। আমরা যা করতে চাই তা করতে পারব না। অতএব একে পরিবর্তন করে ফেলো। নতুন সেটআপ আনো।’

২০১৮ সালে আপনাকে সেনাপ্রধান না করে জেনারেল আজিজ আহমেদকে করা হলো। কেন এমনটি করা হয়েছিল?

আমার অতীতের রেকর্ড দেখেই বুঝতে পারছেন কেন হতে পারিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেনারেল আজিজ যে পারফরম্যান্স দিয়েছেন, সেটি আমি করতে পারতাম না। অথবা ২০১৪ সালে জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া যে ভূমিকা রেখেছেন, কিংবা ২০২৪ সালে জেনারেল এসএম সফিউদ্দিন আহমেদ যে ভূমিকা রেখেছেন, সেটি সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগের আগে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করতেন। অতএব ২০১৩ সালে যখন মেয়াদ পূর্ণের আগে ডিজিএফআইয়ের ডিজি থেকে আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমার সেনাপ্রধান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে অনেককেই তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠছে। অনেকের কোর্ট মার্শাল হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে?

সেনাবাহিনীর সিস্টেমটা রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর প্রধানের। সেনাবাহিনী প্রধান ভালো হলে সংগঠনটি ভালো করে। উনি যদি সেটি না করেন তাহলে উনি তো উনার সংগঠনের ক্ষতি করলেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমি বোর্ডে ছিলাম। সেনাবাহিনীতে সবসময়ই বোর্ডে প্রমোশন হয়। কিন্তু জেনারেল আজিজের সময় দেখলাম বোর্ডের বাইরেও কিছু প্রমোশন হচ্ছে। তখন আমি শুনলাম তারা একটি নোট বানিয়ে নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে প্রমোশন দেয়া হচ্ছে। সেটিকেই বলা হতো নোট শিট প্রমোশন। ২০১৬-১৭ সালের আগ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রমোশন হয়নি। যেটা জেনারেল আজিজ শুরু করেছেন।

সেনাবাহিনীতে পিএসসি না করলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হতে পারবে না বলে আমাদের এখানে সিস্টেমই আছে। কিন্তু কাউকে কাউকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রধান এগুলো প্রমোট করেছেন। আর্মিতে কিন্তু এগুলো খুবই স্বচ্ছ ছিল একটা সময় পর্যন্ত।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে বঙ্গভবনে নিয়ে গেছেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির সামনে অ্যাটর্নি জেনারেল জোর করছেন। কিন্তু উনি তো ছাড়েননি। উনি বলেছেন, না, আমি এটা করতে পারব না। এ রকম সাহসিকতা দেখিয়েছেন বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

উনি তো জেনারেল মুস্তাফিজের জামাই। শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু উনি উনার সততা দেখিয়েছেন। বাহিনীর আগের প্রধানরা কেন দেখাননি? কেন তারা অযোগ্য লোককে প্রমোশন দিলেন? যারা প্রমোশন পেয়েছে শুধু তাদের দোষ দিলেই হবে না। যারা দিয়েছেন তাদেরও দোষ দিতে হবে। মিডিওকার (মাঝারি মানের) যখন শাসন করা শুরু করে তখন তারা মিডিওকারকে প্রমোট করা শুরু করে।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাহসের কথা বলছেন। উনার জায়গায় আপনি থাকলে কি শেখ হাসিনাকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন?

এটি ভেতরের ব্যাপার তো। ঠিক বলতে পারব না যে কোন পরিস্থিতিতে, কী কারণে ভারতে পাঠালেন? উনি হয়তো তখন শর্ত দিয়েছেন যে আমি পদত্যাগ করতে পারি তবে আমাকে ভারতে পাঠাতে হবে। উনি (শেখ হাসিনা) হয়তো এ শর্ত দিয়েছিলেন। তখন তো দেশ বাঁচাতে হবে। সেই সময় আরো গোলাগুলি হতে পারত। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তাকে বিদেশ পাঠানো আমি সঠিক মনে করি। কারণ সবার আগে দেশ।

আপনাকে তিন বা চার বছর না রেখে একদম নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সরিয়ে দেয়ার কারণগুলো যদি বিস্তারিত বলতেন।

সঠিক কারণ বলতে পারব না। সে সময় পারফরম্যান্স ভালো ছিল না বলে আমি মনে করি। ডিজি ডিজিএফআই হিসেবে সরকারের যে আশা ছিল সেটি পূরণ করতে পারিনি। সরাসরি কোনো কারণ জানা যায়নি। এটি প্রিম্যাচিউর পোস্টিং দেখেই বুঝতে হবে। যদি কেউ অন প্রমোশন পোস্টিংয়ে যায় তাহলে সেটি ঠিক আছে। কিন্তু একই র‍্যাংকে অন্য জায়গায় পোস্টিং দেয়া হয়, সেটি অগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেয়া হয় তাহলে বুঝতে হবে হয়তো কোনো কারণে আমি পারফর্ম করতে পারছিলাম না। সে সময় আমার কোনো ফেইলিউর ছিল না। হঠাৎ করে আমার পোস্টিং দেখলাম।

আপনার পারফরম্যান্সের কোন দিকটার জন্য এমন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

হয়তো সরকার মনে করেছে সামনে নির্বাচন আসছে ওখানে অনেক ধরনের তৎপরতা লাগবে। হয়তো ওকে দিয়ে করানো যাবে না বা ও করবে না। তা না হলে ইলেকশনের আগে এ রকম জায়গায় পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল না। এরপর আমি ভালো কোনো পোস্টিংও পাইনি। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) গেলাম। সেখান থেকে বিইউএফ, তারপর এনডিসি। আমাকে আর্মির হেডকোয়ার্টার্সে কিংবা কোনো অর্গানাইজেশনের প্রধানের দায়িত্বেও দেয়া হয়নি।

ডিজিএফআই কীভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হলো?

আমার কাছে মনে হয় এখানে যে অর্ডার দেয় এবং যে বাস্তবায়ন করে দুজনকেই দায়ী করব। অর্থাৎ হাতিয়ার যে করেছে এবং যে হয়েছে দুজনই দায়ী। কেননা কোনো অনৈতিক কমান্ড না মানলে কাউকে বের করে দেয়া হয় না। হয়তো অগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং দিয়ে দেবে। যেভাবে আমাকে দেয়া হয়েছিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল যাতে আসে সেজন্য কাজ করেছি। আমি ইন্টেলিজেন্সের জায়গা থেকে কাজ করেছি। সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় আমি নিজেই গিয়েছি। উনাকে আসার কথা বলেছি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে কেন বহুদলীয় নির্বাচন হয়নি? এ সময়গুলোয় ডিজিএফআইয়ের ডিজিদের জিজ্ঞেস করেন তারা কেন এ বিষয়ে চেষ্টা করলেন না।

প্রতিটি সংগঠন যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তাদের সেভাবেই ব্যবহার করা উচিত বলে আমি মনে করি। এখন মেজর জেনারেল ফয়জুর রহমান তো সবার কথা শুনছেন না। তিনি রাজনীতির কিছুতেই নেই। কারণ প্রফেসর ইউনূস বোঝেন। তাই তিনি ডিজিএফআইকে রাজনীতিতে যুক্ত করছেন না।

আমি যখন তরুণ অফিসার ছিলাম তখন সকাল বেলা পিটি আর ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া আর কিছু বুঝতাম না। ২০১২ সাল থেকে আর্মি নানা রকম কাজে যুক্ত হওয়া শুরু করল। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব জায়গায় সেনাবাহিনীর সদস্য দেখা যায়। সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যেই থাকা উচিত। কোনো ইমার্জেন্সি বা বন্যার মতো পরিস্থিতিতে আর্মি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসবে। এ বছরের পর আর্মিকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনতে হবে। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে সুপারভাইজ করার জন্য আর্মিকে ব্যবহার করা উচিত না।

২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ডিজিএফআই ভূমিকা রেখেছিল এমন অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

এটিতে কোনো ধরনের স্পন্সরশিপ আমাদের ছিল না। সে সময় ওখানে কী হচ্ছে দেখার জন্যই আমি যাই।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দ্বিদলীয় রাজনীতির পরিবর্তন ঘটবে বলে কি আপনি মনে করেন? নতুন রাজনীতি তৈরি হবে কি?

যেহেতু এ বিপ্লব স্বাধীনতা দিয়েছে তাই আমার কাছে মনে হয় রাজনৈতিক দল আসার কথা। যত রাজনৈতিক দল আসবে ততই ভালো হবে। জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে আসা দরকার। কানাডা, নিউজিল্যান্ডে কিন্তু এমনটিই ঘটছে। আমাদের এখানে একটি প্রবণত আছে, দায়িত্ব পেলেই আর ছাড়তে চায় না। এটির পরিবর্তন করা দরকার।

প্রফেসর ইউনূস এখন শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে সবাইকে যুক্ত করছেন। অর্থাৎ আমাদের এখানেও মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। সামনের দিনে তাই হবে বলে আমি মনে করি। ফাহাম আব্দুস সালাম দুটি বিষয়ে বলেছেন, মেরিটোক্রেসি এবং রুল অব ল। আর এর সঙ্গে আমি যোগ করব একটি—সততা।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনীর হাতে ঘটা হত্যাকাণ্ডকে কীভাবে বিচার করবেন?

আমি এটিকে নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব। একটি সঠিক নেতৃত্ব থাকলে একটি দেশের এ অবস্থা হতো না। যেসব দেশে গুড ট্রানজিশন হয়েছে সবগুলোয়ই সঠিক নেতৃত্ব ছিল। যেমন সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া। এখন ড. ইউনূস ভালো নেতৃত্বের মাধ্যমে যদি পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। নেতৃত্বটি একটি টপ-ডাউন প্রসেস। ওপরের দিকে নেতৃত্ব ভালো হলে সবসময়ই নিচের দিকে ভালো হবে।

অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের জন্য পুলিশকে জনগণের বিপক্ষে নামানো হলো। পুলিশকে লিথাল (প্রাণঘাতী) অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেয়া ঠিক হয়নি। ফলে অনেক বেসামরিক প্রাণহানি হলো। তিউনিশিয়া, মিসর থেকে দেখা গেছে, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে সাধারণ মানুষ তো ক্ষুব্ধ ছিল। তিনটি নির্বাচন করা হয়েছে, যেখানে বিরোধী কেউ অংশগ্রহণ করেনি। এটি তাদের বোঝা উচিত ছিল যে একপর্যায়ে মানুষ বিদ্রোহ করবে। এখানে তাই হয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কী করবে? সামনে তো আসতে হবে তখন।

তবে উনার (শেখ হাসিনার) লিডারশিপটা আরো ভালো হতে পারত। উনার চারপাশে চারজনের কথা ইদানীং বলছেন অনেকে। কিন্তু উনি আসলে একা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। উনার আশপাশের লোকগুলো যদি আরো জ্ঞানী, বিবেকী মানুষজন হতেন অনেক আগেই জিনিসটা ধরতে পারতেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে হয়তো হেরে যেতেন কিন্তু তারপর আসার পথ খোলা থাকত। আপনি ১৫৩টি সিটে নির্বাচন ছাড়াই জয়ী হয়েছেন। ২০১৮ সালে রাতে নির্বাচন করে ফেললেন। আবার ২০২৪ সালে হলো নতুন ধারার ডামি নির্বাচন। এমনভাবে কোনো গণতান্ত্রিক দেশ তো নির্বাচন করে না।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুনর্বাসন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাই।

শেখ হাসিনার যে বয়স হয়েছে রাজনীতিতে পুনর্বাসন হতে পারবে না। তবে আওয়ামী লীগ যেভাবে ১৫ বছর ধরে চলেছে সেখান থেকে রিফর্ম করতে হবে। এ সময়ের ঘটনাগুলো মানুষ অত সহজে ভুলে যাবে না। তবে তাদের অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ফিরে আসতে পারবে।

রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। এ নিয়ে আপনার মতামত কী?

আমার কাছে মনে হয় সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য এক বছর বা দুই বছর লাগার কথা। এরপর যেই আসবে সেই ফলো করবে। না হলে তাদের কাছে এটি স্পষ্ট যে তারা যদি তৈরি করা সিস্টেমটি ফলো না করে তাহলে জনগণ জেগে উঠবে।

এখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় দ্রুতই পরিবর্তন করতে হবে। আর অগুরুত্বপূর্ণ পোস্টগুলো থাকুক। যেই পরিবর্তন অলরেডি করা হচ্ছে। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ে পরিবর্তন হয়েছে। এটাতে পাঁচ-সাত বছর লাগবে পরিবর্তন করতে। কারণ ১৫ বছরে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা এখন পরিচালক পর্যায়ে চলে এসেছে। তারা আস্তে আস্তে অবসরে যাবে। তাই সিস্টেমটি যখনই শুরু হয় এরপর পাঁচ বছর লাগবে। তাই আজকেই শুরু করা ভালো। প্রফেসর ইউনূস সাহেব শুরু করেছেন। পরে কী হবে তা জনগণই ঠিক করবে।