ঢাকার পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে?
- প্রকাশের সময় : ০৩:৩১:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ৪১ বার পঠিত
রাজধানীর গণপরিবহনকে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হয়েছিল নগর পরিবহন। সেই সার্ভিস এখন বন্ধ। বাসের ভাড়া নৈরাজ্য কমাতে চালু হয়েছিল ই-টিকেটিং পদ্ধতি। এখন এই পদ্ধতিও মানা হচ্ছে না। সড়কে বাসের যাত্রী ওঠা-নামা করতে করা হয়েছিল বাস স্টপেজ, যাত্রী ছাউনি। কিন্তু এসব স্থানে এখন আর বাস থামে না। বাস থামে রাস্তার মাঝখানেই। যাত্রী ওঠানামা করানো হয় রাস্তার ওপর। ফ্লাইওভারগুলোতে যাত্রী ওঠা-নামা নিষিদ্ধ থাকলেও সেখানেই বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা নামা করানো হয়। রাজধানীর রাস্তার মোড়গুলো এখনো নিরাপদ হয়নি। রাস্তার মোড়গুলোতে যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দীর্ঘসময়। মোড়গুলোতে বাস দীর্ঘসময় দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা নামা করানোর কারণে পেছনে পরিবহনের লম্বা সারি সৃষ্টি হয়। যানজটের কবলে পড়েন নগরবাসী। ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের মনের কোণে প্রতিদিনকার প্রশ্ন গণপরিবহনের নৈরাজ্য বন্ধ হয়ে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে?
রাজধানী ঢাকার সড়কের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ঢাকায় ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কর বাস দুর্দান্ত প্রতাপে চলছে। সারাদেশে ফিটনেসবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ৫ লাখের বেশি যানবাহন সড়কে চলাচল করছে। রাজধানী ঢাকার সড়কে এখন সাড়ে ৩ হাজার বাস-মিনিবাস যাত্রী পরিবহন করছে। রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা কত সেই সঠিক হিসেব নেই কারো কাছে। এমন পরিস্থিতিতেই ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা আনতে আব্দুল্লাহপুর হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করা ২১টি কোম্পানির বাস টিকিট কাউন্টার ভিত্তিতে পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম। তিনি বলেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার টিকিট কাউন্টার ভিত্তিক বাস পরিচালনা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে। এই রুটে প্রায় দুই হাজার ৬১০টি বাস চলবে। সবগুলো বাস একই রঙের (গোলাপি) হবে। এসব বাসে টিকিট ছাড়া কেউ উঠতে পারবেন না। যত্রতত্র বাসে ওঠা-নামাও করা যাবে না। গতকাল মঙ্গলবার সংগঠনটির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সাইফুল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১৬ বছর ধরে ঢাকা শহরে বাস-মিনিবাস চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করছে। এতে গাড়ি চলাচলে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামা করার কারণে সড়কে যানজট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, গত ১৯ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরে যানজট নিরসন এবং বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মালিকরা গাড়ি চালকদের সঙ্গে ট্রিপ ভিত্তিক চুক্তি না করে পাক্ষিক বা মাসিক ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। তাই আগামী বৃহস্পতিবার প্রাথমিকভাবে গাজীপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে টিকেট কাউন্টার ভিত্তিতে চালকরা গাড়ি চালাবেন। চলতি মাসের মধ্যে মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুরে চলাচল করা বাসগুলো টিকিট কাউন্টারের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে জানিয়ে সাইফুল আলম বলেন, এখন থেকে বাস কাউন্টার পদ্ধতিতে চালাতে হবে এবং যাত্রীদেরকে নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে গাড়িতে যাতায়াত করতে হবে। নির্দিষ্ট স্টপিজ ছাড়া গাড়ি দাঁড় করানো যাবে না এবং যাত্রী উঠানো যাবে না। যাত্রীরাও নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠবেন।
টিকেট কাউন্টার ভিত্তিতে গাড়ি পরিচালনায় বাস চালক এবং সহকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, টিকিট পদ্ধতিতে যাত্রী পরিবহনে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবহন শ্রমিকরা যাতে যাত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন, তা বলা হয়েছে। যাত্রীরা জানান, লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহন রাস্তায় চলছে। রাস্তায় চলাচল করতে হয় বলে বাধ্য হয়েই তারা ওঠেন। সরকার বাসগুলোর দিকে নজর দেবেন বলে প্রত্যাশা তাদের। একটা দেশের রাজধানীতে চলাচল করা বাস এত লক্কড়-ঝক্কড় হতে পারে, তা কল্পনাতীত। সাম্প্রতিক সময়ে নানা ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করছি। অথচ আমাদের নগরবাসীরা কীভাবে চলাচল করছেন তা নিয়ে সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই। এখন যেসব নতুনভাবে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা সঠিকভাবে পরিচালনা করলে হয়ত ভালো কিছু আশা করা যাবে। তবে নগরবাসীকে সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা উপহার দিতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
জানা যায়, ঢাকায় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে প্রায় ৬ বছর আগে শুরু হয়েছিল বাস রুট রেশনালাইজেশনের কার্যক্রম। কিন্তু এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এবার বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজিং প্রকল্প সফল করতে চায় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মরহুম মেয়র আনিসুল হক রুট ভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি মারা গেলে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির দায়িত্ব পান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি ১১টি সভা করেন। এরপর সংস্থাটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস কমিটির দায়িত্ব পান। তার তত্ত্বাবধানে ২৭তম সভা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশপনের প্রশাসক নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ কমিটির সবশেষ ২৯তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি মোট দুটি সভা করেছেন। সবগুলো বাস কোম্পানিকে কয়েকটির মাধ্যমে পরিচালনা করার উদ্যোগের নামই বাস রুট রেশনালাইজেশন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে চেষ্টা ছিল ধীরে ধীরে পুরো রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা একটি কোম্পানির আওতায় আনা। এছাড়া ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় বাস সড়ক থেকে তুলে নিয়ে আধুনিক মানের বাস নামানো, শহরের বাইরের চারিদিকে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, ডিপো নির্মাণ করা। ঢাকার জন্য কোম্পানিভিত্তিক বাস সেবা প্রবর্তনের রূপরেখা তৈরি করে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। বাসগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকার কথা ছিল নির্দিষ্ট কোম্পানির। সেই কোম্পানিগুলো গঠন করা হয় জয়েন্ট ভেঞ্চার পদ্ধতিতে। ২০২১ সালে সেই কার্যক্রম সফল দেয়নি।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত সরকারের আমলে পরিবহন নেতারা খুবই প্রভাবশালী ছিল, তারা চাইতো না ঢাকা নগর পরিবহন চালু হোক। তারা সব সময় এর বিরোধিতা করতো। কোনো বাস মালিক রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ঢাকা নগর পরিবহনে তাদের বাস ঢুকতে চাইলে পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা তাকে নানাভাবে হয়রানি করতো, বাধা দিত। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সারাদেশে এখন ৫ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে গণপরিবহনকে স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট গণপরিবহনের বিকল্প নেই। গণপরিহনের মান উন্নত করতে হবে। সরকার চাইলেই সবকিছু সম্ভব। তেমনি সরকার চাইলেই সড়কে ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন বন্ধ করা সম্ভব।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. শামসুল হক বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট কোনো লোক নেই। যাদের এসব দেখভালের কথা তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। সড়কে যানবাহন সমস্যা সমাধানে যদি ধ্যান-জ্ঞান না থাকে তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না। ঢাকার ভেতরেই হাতিরঝিলে সুশৃঙ্খল গণপরিবহন আছে। বাস স্টপেজে লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা দেয়। কাজেই দায়িত্বশীলরা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাইলে তা সম্ভব। সড়কে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের চলাচল বন্ধ করলেই অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব।