পাহাড় কাটছে চমেক!

- প্রকাশের সময় : ০৪:৫৭:১২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৬৮ বার পঠিত
- ১৫০ শয্যার বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণ করা হবে স্থানটিতে
- আমরা পাহাড় কাটছি না। পাহাড়টি রক্ষার জন্য রিটেনিং দেয়াল নির্মাণ করব: কর্তৃপক্ষ
সরকারি সংস্থার প্রকল্পেই সাবাড় হচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। ডিটি-বায়েজিদ সংযোগ সড়কে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৬ পাহাড় কাটার ঘটনাটি এখনো সুরাহা হয়নি। খাড়া পাহাড়গুলোকে অর্ধকাটা অবস্থায় রেখে দেওয়ায় বর্ষাকালে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পাহাড় কেটে কৈবল্যধামে লেকসিটি আবাসিক এলাকা এবং সিটি করপোরেশন দক্ষিণ খুলশীতে ভিআইপি আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছিল। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
জানা যায়, গত বছর ৯ মে একনেকে অনুমোদন পাওয়া ১৫০ শয্যার বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণ করা হবে স্থানটিতে। ২৮৫ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে ১৮০ কোটি অর্থায়ন করবে চীন সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার ১০৫ কোটি টাকা দেবে। এ প্রকল্পের আওতায় একটি ছয়তলা ভবন নির্মিত হবে। তবে ভবনটি পাহাড়ে নয়, সমতলে নির্মিত হবে বলে দাবি করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো ভবনটি সমতলে নির্মাণ করব। পাহাড়টি যাতে ধসে নিচে না পড়তে পারে, সেজন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
নগরীর চট্টেশ্বরী রোডে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের পশ্চিমে গোয়াছি বাগান দিয়ে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার একটি রাস্তা ছিল। এখন সেখানে গেট নির্মাণ করে পাহারার দায়িত্বে আনসারকে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। আর ভেতরেই চলছিল পাহাড় কাটা। গত শনিবার ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে আনসারের বাধার মুখে পড়তে হয়। পরে ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, পাহাড়ের ওপর দুটি এক্সকাভেটর (পাহাড় কাটার যন্ত্র) কাজ করছে। এক্সকাভেটর দুটি দিয়ে দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে। উঁচু পাহাড়টি ওপর থেকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাটাও হয়ে গেছে। দুজন শ্রমিক পাহাড়ের ওপরে থাকা গাছগুলো কাটছে।
পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পাহাড় কাটছি না। পাহাড়টি রক্ষার জন্য রিটেনিং দেয়াল নির্মাণ করব। আর দেয়ালটি প্রকৌশলগতভাবে যাতে মজবুত হয়, সেজন্য চীনা প্রকৌশলীদের ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণ করা হবে। এতে পাহাড়টি অক্ষত থাকবে। পাশে যখন আমরা ভবন নির্মাণ করব তখন এ পাহাড়টি আর ধসে পড়বে না।’
এ সময় তিনি এই প্রতিবেদকে পাহাড়ের গায়ে রিটেনিং দেয়াল নির্মাণের নকশাও দেখান। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে প্রাকৃতিক এ পাহাড়টি কাটা কিংবা ড্রেসিং (মোচন) করার আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সেই অনুমোদন ছাড়া পাহাড় কাটা যায় না। এক্সকাভেটর দিয়ে এভাবে কাটার অনুমোদন কি রয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘পরিবেশ অদিধদপ্তর থেকে আমরা টর (টার্ফ অব রেফারেন্স) অনুমোদন নিয়েছি। কিন্তু এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) এখনো জমা দেওয়া হয়নি। সেটা জমা দিলে আমরা অনুমোদন পাব বলে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিকেও (বেলা) আমরা বিষয়টি অবগত করেছি।’
টর অনুমোদন পাহাড় কাটার অনুমোদন বলে সার্টিফাইড করে কি না, জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক বেগম সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘পাহাড় কাটার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। আর সেই অনুমোদন এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পায়নি। আমি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি। তাদের তো পাহাড় কাটার কথা নয়।’ পরিবেশ নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। যেখানেই পাহাড় কাটা সেখানেই বেলার সরব প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। বর্তমানের বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন। এ বিষয়ে বেলার পক্ষে জানতে চাওয়া হয় এর নেটওয়ার্ক মেম্বার আলিউর রহমানের কাছে।
তিনি বলেন, ‘সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারের কোনো সংস্থাও পাহাড় কাটতে পারে না। যদি কোনো সংস্থা পাহাড় কাটে তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়ার পরেই কাটতে হবে। আমরা যতদূর জানি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো সেই অনুমোদন পায়নি। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
পরিবেশ আইনে কী রয়েছে?
২০১০ সালে ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করা হয়। সেই সংশোধনী আইনের ৪ নম্বর ধারায় পাহাড় কাটা বিষয়ে ১৯৯৫ সালের আইনের ৬ (খ) ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন, দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইতে পারে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালের এ আইনের পর পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো পাহাড় কর্তনের অনুমোদন দেয়নি। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের আওতায় সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এলাকার ১২টি পাহাড় অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সিডিএ ১৬টি পাহাড় কেটে ডিটি-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক নামে যে চার লেনের সড়ক নির্মাণ করেছে, সেই পাহাড়গুলো কাটার অনুমোদন কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর এখনো দেয়নি। কিন্তু সিডিএ পাহাড়-জঙ্গল সাবাড় করে সড়ক বানিয়ে ফেলেছে। সিডিএকে এজন্য ২০২০ সালে ১০ কোটি টাকা এবং রাস্তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সকে ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ৪০ বছরে হারিয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়। পাহাড় কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক জিএন তানজিনা হাসনাত ও একই বিভাগের মোহাম্মদ আলী বাবু ‘আরবান ল্যান্ডস্কেপ চেঞ্জ ডিটেকশন ইউজিং জিআইএস অ্যান্ড আর এস’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। ২০২২ সালে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নগরীর মাত্র ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন ৪৫ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর গত ৩০ বছরের ভূমির বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল।
তার মতে, চট্টগ্রামে পাহাড় কাটায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আর তাদের নেতৃত্বে পাহাড়গুলো সাবাড় হয়েছে। বর্তমানে যে ৭ থেকে ৮ শতাংশ পাহাড় রয়েছে সেগুলোও আগামী ১০ বছরের মধ্যে অর্ধেকে নেমে আসবে। সূত্র : দেশ রূপান্তর।