দাবি জাতীয় পার্টির আগ্রহ স্বতন্ত্রদেরও
- প্রকাশের সময় : ০৪:৩৩:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৭৮ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে কারা বসছেন-এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ১১টি আসন নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদেও প্রধান বিরোধী দল হতে চায়।
তবে এক্ষেত্রে বাদ সেধেছেন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সংসদ-সদস্যরা। ৬২টি আসন নিয়ে তারা আলাদা মোর্চা গঠন করে বসতে চান বিরোধী দলের আসনে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিরোধী দল গঠন করতে হলে একটি দল থাকতে হয়। কিন্তু স্বতন্ত্ররা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
তবে শেষ পর্যন্ত কারা বসবেন বিরোধী দলে, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংসদ সচিবালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার আগেই বিষয়টি ফয়সালা করবেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের পথম অধিবেশন বসে। সংবিধান অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে ২৯ জানুয়ারি।
এর আগের দিন ২৮ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার সম্ভাবনা রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী গেজেট আকারে নির্বাচিত সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা প্রকাশের তিনদিনের মধ্যে শপথ এবং শপথ গ্রহণের ৩০ দিনের ভেতরে সংসদ অধিবেশন আহ্বানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি চাইলে এ সময়সীমার ভেতরে থেকে এর আগেও অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন।
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২৩টি আসন জিতে এককভাবে সরকার গঠন করেছেন টানা তিনবারের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১১টি আসন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই শাসক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তারা জয়ী হন ৬২টি আসনে। এছাড়া অন্যান্য ৩। এ অবস্থায় সংসদের প্রধান বিরোধী দল কারা হবে-এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এর আগে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ওই সময়কার নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্ররা মিলে মাত্র সাতটি আসন পায়। সেসময় তারা সাতজন মিলে বিরোধী দল গঠনের দাবি জানালেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা আমলে নেননি। সংখ্যায় কম থাকায় বিরোধী দল হিসাবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
প্রথম সংসদে কোনো বিরোধী দল না থাকলেও ৭ জনের জন্য সংসদ ভবনের ভেতরে একটি রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল গঠিত হয়।
জোটটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১৯টি আসনে জয়ী হয়ে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন ওই বিরোধী দলকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলে অভিহিত করা হতো।
এরও পরে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন, যা আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ মাত্র তিনটি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি ২৭৮টি আসনে জয়লাভ করে। ফ্রিডম পার্টি পায় একটি আসন। আর স্বতন্ত্ররা জয়ী হন ১০টি আসনে।
এছাড়াও আরও ১০টি আসনে ফলাফল স্থগিত করা হয় এবং একটিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। মাত্র ১১ দিন স্থায়ী ওই সংসদেও তখন কোনো বিরোধী দল ছিল না। এক-এগারো পরবর্তী ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০টি আসনে জয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে বিএনপি।
বিএনপিসহ তাদের শরিকদের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৪টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে ১৬ জন প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয়ী হন। আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের নিয়ে আলদা একটি জোট গঠন করেছিলেন তখন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বতন্ত্ররা সংসদে প্রধান বিরোধী দল গঠন করতে চাইলে এবারও এ ধরনের জোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভেতরে ভেতরে এরকম একাধিক উদ্যোগও রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
যদিও দেশের সংবিধান বা কোনো আইন-বিধিতে বিরোধী দল বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। কেবল জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দলীয় নেতা কথাটি উল্লেখ রয়েছে। ‘কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ-সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতো দল বা অধিসংঘের নেতা।’
কার্যপ্রণালি বিধির এই ধারা ব্যাখ্যা করলে স্বতন্ত্র সদস্যরা এক জোট হয়ে সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসতে পারেন। জাতীয় পার্টির সদস্যরাও বসতে পারেন। স্পিকার চাইলে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের স্বীকৃতি প্রদান করতে পারেন। বিষয়টি তার একক এখতিয়ারের বিষয়।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, যত আসনই জিতুক না কেন, তার দলই সংসদে বিরোধী দল হবে।
তিনি আরও বলেন, বিরোধী দল গঠন করতে হলে একটি দল থাকতে হয়। কিন্তু স্বতন্ত্ররা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
অন্যদিকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, জোট গঠনের বিষয়ে স্বতন্ত্ররা তাদের অবস্থান পরিষ্কার না করা পর্যন্ত কে বিরোধী দল হবে, তা বলা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এজন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শনিবার যুগান্তরকে বলেন, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিতরা চাইলে জোট বেঁধে বিরোধী দল হতে পারেন। এতে কোনো বাধা নেই।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দল থেকে ঠিক কতসংখ্যক সদস্য প্রয়োজন, তা নির্ধারিত নেই। তবে ভারতের লোকসভার বিধান ও প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী, বিরোধী দলের স্বীকৃতির জন্য ন্যূনতম দশভাগ, অর্থাৎ ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পেতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন বাধ্যবাধকতা নেই।
যে কারণে একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি ২২টি আসনে জয়ী হলেও দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ফলে এবারও তেমনটি হতে পারে। আবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা বসে তাদের নেতা নির্বাচিত করে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতির জন্য স্পিকারের কাছে লিখিতভাবে অনুরোধ জানাতে পারেন।
স্পিকার তখন বিষয়টি আমলে নিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন। এরকম একটি উদ্যোগ ভেতরে ভেতরে চলছে বলে জানা গেছে। যদি এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ না দেখে, তাহলে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসাবে জাতীয় পার্টিকেই ফের দেখা যাবে পুরোনো ভূমিকায়। সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এতে কোনো আইনি বাধা নেই। সূত্র : যুগান্তর
হককথা/নাছরিন