পলিথিনের দূষণের ভয়াবহতা
- প্রকাশের সময় : ০১:১৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ জুন ২০২৪
- / ১৬৬ বার পঠিত
পলিথিন হচ্ছে প্লাস্টিকেরই এমন একটি পদার্থ যা শুধু স্বাস্থ্যের জন্য নয় বরং পরিবেশদূষণেরও অন্যতম প্রধান একটি উপাদান। নানান রকমের জৈব ও অজৈব অ্যাডিটিভের মিশ্রণে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের সৃষ্টি। এসব অ্যাডিটিভ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ও ক্যানসার তৈরিতে কাজ করে। একই সঙ্গে উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রাখা খাবার পলিথিনে থাকা সিসা ও ক্যাডমিয়ামের সংস্পর্শে আসায় তা শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং চর্মপ্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।
পলিথিন ব্যবহার করে আমরা সেগুলো যত্রতত্র ফেলে দিই। এটি অপচনশীল হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থাকে। ফলে মাটিতে সূর্যালোক, পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করে এটি। পাশাপাশি অপচনশীল হওয়ায় মাটির উর্বরাশক্তি হ্রাস ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরিতেও অন্তরায় এই পলিব্যাগ। এ ছাড়াও জলাবদ্ধতা ও নানা পানিবাহিত রোগ তৈরিতেও এটির ভূমিকা রয়েছে। পলিথিনে মাছ, মাংস, কাঁচা শাকসবজি ও ফলমূল প্যাকিং করলে তাতে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে প্যাকিং করা বস্তু দ্রুত পচে যায়।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পলিথিন দিয়ে মোড়ানো মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য খুব সহজেই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়, যা চর্মরোগ ও ক্যানসার সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। আসুন জেনে নেওয়া যাক পলিথিন ব্যবহারের ফলে মানব সভ্যতার জন্য তা কেমন ক্ষতি বয়ে আনছে-
প্রাণীর মৃত্যু
বছরে শুধু প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের ফলেই ১ লাখ প্রাণী প্রাণ হারায়। এসবের মধ্যে তিমি, ডলফিন, কচ্ছপ, জেলি ফিসসহ আরও বেশ কিছু প্রজাতির স্থল ও সামুদ্রিক প্রাণী রয়েছে।
পেট্রোলিয়াম পদার্থ থেকে প্লাস্টিক ব্যাগের সৃষ্টি
প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরিতে ৬০-১০০ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়। এসব ব্যাগের জন্য জ্বালানি তেল প্রধান কাঁচামাল হওয়ায় ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করে মানব বিশ্বের জন্য বয়ে আনছে চরম হুমকি।
প্লাস্টিক ব্যাগে খাদ্য-পণ্য মজুদ ও রাসায়নিক বিষক্রিয়া
একদল শিক্ষার্থী গবেষক দেখিয়েছেন, যেসব খাদ্য প্লাস্টিকের ব্যাগে সংরক্ষিত করা হয় তেমন খাবার মানবদেহে আলসার, অ্যাজমা, ওবেসিটির পাশাপাশি নিশ্চিত ক্যানসার তৈরি করে থাকে। কারণ এসব ব্যাগে থাকা খাবার যখন গরম করা হয় তখন সুপ্ত রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রাণ ফিরে পায় আর দ্রুত তা খাবারের সঙ্গে মিশে তৈরি করে বিষক্রিয়া। এমনই একটি রাসায়নিক উপাদানের নাম Bisphenol-A (BPA), যা প্লাস্টিককে আরও নরম ও টেকসই করে থাকে। যা মানুষের শরীরের জন্য চরম হুমকি।
প্লাস্টিক তৈরি ও রাসায়নিক বিষক্রিয়া
একটি প্লাস্টিক ব্যাগের উপাদানগুলোর মধ্যে নিউরো টক্সিক, কারসিনোজেনিক ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্টের জন্য বেশকিছু রাসায়নিক উপাদান বিরাজ করে যা আমাদের মানবদেহের ভারসাম্য নষ্টে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে এসব উপাদানের বেশকিছু আবার ইকোসিস্টেমকে সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণেও ভূমিকা রাখছে।
জলাবদ্ধতা
প্লাস্টিক ব্যাগ ড্রেনেজ সিস্টেমে বাধা প্রদান করে জলাবদ্ধতা তৈরিতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এ সমস্যা প্রকট। গবেষণায় দেখা যায়, দুই দশক ধরে পলি ব্যাগ জমে সৃষ্ট জলাবদ্ধতাই বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
শিশুদের ফুসফুস প্রদাহ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মতে, প্লাস্টিকের কারণে গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে পিএইচথ্যালেটস ও বিপিএর প্রভাব বেশি থাকায় জন্মের সময় মাতৃগর্ভ থেকেই শিশুরা ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে জন্ম নেয়। এতে করে অ্যাজমাজনিত সমস্যা ও উচ্চরক্তচাপের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় নবজাতকদের মধ্যে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের গবেষণায় জন্মের পর থেকেই শিশুদের মধ্যে ওবেসিটি ও ডায়াবেটিসের দেখাও মিলছে এই প্ল্যাস্টিকের কারণেই।
সন্তান ধারণে অক্ষমতা
বিপিএ ছাড়াও ওয়েস্ট্রোজেন নামক আরেকটি ভয়াবহ রাসায়নিক উপাদানের ফলে মেয়েদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যতা নষ্টের ফলে সন্তান ধারণক্ষমতা হারাচ্ছেন মেয়েরা। এ ছাড়াও স্তন ক্যানসার, থাইরয়েড ও নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারেও ভুগছেন নারীরা।
পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার
প্লাস্টিক ব্যাগের সংস্পর্শে আসায় নারী ও শিশুর পাশাপাশি পুরুষেরাও রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। হুর গবেষণায় পুরুষদের মধ্যে বিপিএর ফলে প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসেও এসব বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান দায়ী।
ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ
মাটির নিচে মাত্রাতিরিক্ত পলিথিন ব্যাগ জমে থাকায় এসব থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় মাটির তলদেশের পানির স্তর দূষিত হচ্ছে। আর এ পানি ব্যবহারের ফলে আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে নানান রোগ।
খাদ্যশৃঙ্খল ধ্বংসের পথে
প্লাস্টিক দূষণের ফলে আমাদের প্রকৃতিতে থাকা স্বাভাবিক খাদ্য শৃঙ্খলেও দেখা যাচ্ছে অস্থিতিশীলতা। যা স্বাভাবিক খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানোর পাশাপাশি অন্যান্য জীব-জন্তু ও গাছপালার খাদ্য সৃষ্টিতেও দিচ্ছে বাধা। বিশালাকার প্রাণী থেকে অতিক্ষুদ্রাকৃতি প্লাংকটনের জন্যও পলিথিন নিঃসৃত রাসায়নিক বিষক্রিয়া হুমকিস্বরূপ।
২০৫০ সালের মধ্যে মহাসাগরে কমবে মাছ, বাড়বে প্লাস্টিক
২০১৬ সালে ইলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, যেভাবে মানুষ সাগর-মহাসাগরে প্লাস্টিক ফেলে দূষণ তৈরি করছে, সে হিসাবে মহাসাগরগুলোয় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের সন্ধান মিলেছে, আর তা অব্যাহত থাকলে অচিরেই মাছের বদলে এসব সাগর-মহাসাগরে দেখা মিলবে প্লাস্টিকের। পলিথিন ও প্লাস্টিক পলিউশন থেকে আমাদের নিজেদের এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে এখনো যদি সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে না আসে তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে চরম মূল্য। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল