সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন করছে
- প্রকাশের সময় : ০৮:২৫:১৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৩
- / ১৩৫ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : আদালত মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু সেই আদালতকে যখন নিপীড়ন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন একটা দেশের আইনের শাসনে ভরসা করার মতো আর কিছু থাকে না। বর্তমানে ব্যবহার করাটা হচ্ছে ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী ও সর্বনাশা। ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা বা পুলিশ প্রশাসনকে নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সম্মানও ক্ষুণ্ন করার পথে নেমেছে। গতকাল ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, এর খেসারত দিতে হবে। কোনো সমাজে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা যদি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়, তখন ওই সমাজের অনেক অনিষ্ট হয়। তখন আস্তে আস্তে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ‘সাজানো নির্বাচন, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল।
আলোচক হিসেবে ছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ। সমাপনী বক্তব্য দেন প্রফেসর ড. রিদওয়ানুল হক।
প্রফেসর আসিফ নজরুল বলেন, ৭ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার ডামি প্রার্থী ও অনুগত দলগুলোর নির্বাচন হচ্ছে। এটা আসলে কোনো নির্বাচন নয়। এটা বাকশাল-২ বা একদলীয় একটা নির্বাচন। এই সাজানো নির্বাচনটা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে, সোজাসুজি জেলে ঢুকিয়ে দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে।
তিনি বলেন, আজকে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে মামলা, হামলা ও নির্যাতনের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখানে একটা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, স্বাভাবিক যে মানবাধিকার সেটা পর্যন্ত ভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। বেশি উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, এই কাজটা করতে গিয়ে অর্থাৎ বিরোধী দল তথা বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ ছাড়া, ঘরছাড়া করা, জেলে ঢুকানো, নির্যাতন, আতঙ্কে রাখার প্রক্রিয়ায় শুধু পুলিশ বা দলের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হচ্ছে না। এখানে আদালত, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়।
তিনি বলেন, আদালত মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। একটা আদালতকে যখন নিপীড়ন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন একটা দেশের আইনের শাসনে ভরসা করার মতো আর কিছু থাকে না। এবারের ব্যবহার করাটা হচ্ছে ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী ও সর্বনাশা। ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা বা পুলিশ ব্যবস্থাকে নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সম্মানও ক্ষুণ্ন করার পথে নেমেছে।
আফিস নজরুল বলেন, সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে ২০২৪ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছে। সাজানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেষ্টা করছে, যেটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমি মনে করি এ কাজে সরকারকে বিরত রাখতে ও তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে উচ্চ আদালত ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা এ ভূমিকা প্রত্যাশা করি। আমরা প্রত্যাশা করি মানবাধিকার কমিশন, দেশে থাকা বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকারকর্মীরা এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন, উদ্বেগ জানাবেন এবং যা করার আছে করবেন। একইসঙ্গে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও যেভাবে গুরুতর ব্যত্যয় চলমান রয়েছে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উচিত পদত্যাগ করা। তাদের দায়িত্ব পালন করা অথবা দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এটা বলে পদত্যাগ করা। অন্তত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কিছুটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে বলে বিশ্বাস করি। উনি যোগ্য মানুষ। উনার কাছে আবেদন করবো আপনার কাছে যদি কোনো রকম আত্মসম্মানবোধ থাকে অন্তত আপনি পদত্যাগের কথা বিবেচনা করুন।
তিনি বলেন, আইনের শাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। মনজিল মোরসেদ বলেন, সাজানো নির্বাচনের দু’টি অংশ- একটি হলো নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আরেকটি হলো ক্ষমতা। কারণ ক্ষমতা না থাকলে সাজানো যায় না। গণতন্ত্র ও ক্ষমতা দুটোই বিবেচনা করলে দেখতে হবে এখন যে গণতন্ত্র সেটি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে কতোটুকু যায়, সেটা বিবেচনা করতে হবে। কারণ আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ৭-এ বলা হয়েছে- ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। জনসাধারণের ক্ষমতাটা জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। আর্টিকেল ৭২-এ বলা হয়েছে সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন। এর আরেকটি সংশোধনীতে বলা হয়েছে, যদি এই সংবিধান স্থগিত করা হয় তাহলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।
তিনি বলেন, আর্টিকেল ৭-এ গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা এবং জনগণের ক্ষমতার যে কথাটা বলা হয়েছে, তা বর্তমান নির্বাচনের সঙ্গে ট্যাগ করলে দেখা যাবে জনগণের ক্ষমতার অনুপস্থিতি। সেক্ষেত্রে দেখবেন আর্টিকেল ৭’র অনুপস্থিত রয়েছে। এমনকি সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে যে গণতন্ত্র রয়েছে সেটিরও অনুপস্থিত রয়েছে। এ সময় চলমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার রায়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এসব মামলার কারণে জনগণের কাছে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিএনপিকে মাঠের বাইরে বের করে দিয়ে সরকারের বিশেষ উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে কিন্তু এর খেসারত দিতে হবে। কোনো সমাজে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা যদি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়, তখন ওই সমাজের অনেক অনিষ্ট হয়। তখন আস্তে আস্তে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
তিনি বলেন, পুরানে আছে- ‘ন্যায় বিচার শুধু করলেই হবে না। জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। জনগণ বিশ্বাস করবে যে ন্যায় বিচার হয়েছে।’ অথচ আমাদের এখানে আইনের শাসন আছে- যারা সরকারের সমালোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে আইন খুব কড়া। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হয়। কিন্তু যারা সরকার পক্ষের লোক তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হয় না। আইনের শাসনও এখন পার্সিয়াল হয়ে গেছে। তাই বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে। সমাপনী বক্তব্যে প্রফেসর ড. রিদওয়ানুল হক বলেন, একটা দেশের নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক না হয় তাহলে সে দেশে গণতন্ত্র আছে সেটা বলা যাবে না। গণতন্ত্রের সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সূত্র : মানবজমিন
হককথা/নাছরিন